ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৭ মার্চ ২০১৭

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব

বিশ্বের যাঁরা মহান কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, যাঁরা খ্যাতিমান রাষ্ট্রনায়ক, তাঁদের সকলের মধ্যেই কম-বেশি আমিত্ববোধের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। আমিত্ববোধের মধ্যে ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, নেতিবাচক দিকটিকেও উপেক্ষা করা যায় না। আমিত্ববোধের মধ্যে থাকে অহংবোধ। অহংবোধকে আমরা ইতিবাচক বলেই বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু সেই অহংবোধ যদি অহঙ্কারে রূপান্তরিত হয়, বিপদ সেখানে। আমিত্বকে যখন কেউ মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দিতে পারেন, তখন তিনি মহৎ মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অপরদিকে কারও আমিত্ব যদি আমি-সর্বস্ব হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। তিনি তখন হয়ে ওঠেন ভয়ানক আত্মকেন্দ্রিক, যার মধ্যে একটা হাম্বরা ভাব এসে বাসা বাঁধে, তখন তাকে সমাজে চিহ্নিত করা হয় একজন অতি আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষ হিসেবে। কাজেই বলা যায়, আমিত্বের মধ্যে নানা প্রকারভেদ আছে। আমিত্ব প্রকাশের মধ্যে নানা বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য আছে। প্রসঙ্গক্রমে বাংলা সাহিত্যের দু’জন প্রখ্যাত কবির নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের মধ্যে একটি বিনয়ী ভাব আছে। রবীন্দ্রনাথের আমিত্বের প্রকাশ তাঁর কবিতায় কেমনভাবে এসেছে এখানে দু’একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। ক. আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার/চরণধুলোর তলে। খ. বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়। গ. আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি। অপরদিকে নজরুলের কবিতায় আমিত্বের প্রকাশ ঘটেছে ভিন্নরূপে, ভিন্ন আঙ্গিকে। উদাহরণ নি¤œরূপ : ক. আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ। খ. আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন/আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ছিন্ন। গ. আমি চির বিদ্রোহী বীর/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা- চির উন্নত শির। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কবি, অপরদিকে নজরুলকে আমরা বলে থাকি জাতীয় কবি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহান দুই কবির দ্বারা নানাভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছেন। বিপদে-সঙ্কটে বঙ্গবন্ধু সবসময় রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের কবিতার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতেন। নজরুলের আমিত্ববোধ এবং বঙ্গবন্ধুর আমিত্ববোধের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর আমিত্ববোধের স্বরূপ বুঝতে হলে তাঁর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে। অপরদিকে নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কাজী পরিবারে। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার হলেও তাঁদের সময়কালে পরিবার দুটি ক্ষয়িষ্ণু। নজরুল এবং শেখ মুজিব ছোটবেলায় একটু দুষ্টু বা দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলেন। শেখ মুজিব তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন- ‘ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম’ (পৃ. ৮)। নজরুলের জীবন পাঠেও জানা যায়, ছোটবেলায় তিনিও বেশ দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব নিজেকে মানবসেবায় নিয়োজিত রাখেন। ১৯৩৭ সাল, শেখ মুজিবের বয়স তখন ১৭ বছর। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের যখন তিনি ছাত্র, তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি। মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটি ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন। শেখ মুজিবকে করা হয় ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিব তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন ‘বাড়ি বাড়ি থেকে মুষ্টির চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাউল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ দেয়া হতো’ (পৃ. ৯)। শেখ মুজিবের নেতৃত্বদানের গুণ ছোটবেলা থেকেই লক্ষণীয়। তিনি আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেনÑ ‘আমি ভীষণ একগুঁয়ে ছিলাম। আমার একটা দল ছিল। কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিল না। মারপিট করতাম। আমার দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। আমার আব্বা মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন’ (পৃ. ১০)। ১৯৩৮ সালের ঘটনা। শেখ মুজিবের বয়স তখন ১৮ বছর। শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। বাংলার এই দুই নেতা এক সঙ্গে গোপালগঞ্জে এসেছিলেন একটি এক্সিবিশন উদ্বোধন করতে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শেখ মুজিবের প্রথম সাক্ষাত এবং কথাবার্তার পরই সোহরাওয়ার্দী সাহেব উপলব্ধি করতে পারেন শেখ মুজিবের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী আছে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কলকাতায় গিয়েই শেখ মুজিবকে একটি চিঠি লেখেন, কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন, থাকতেন বেকার হোস্টেলে। এই সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে রাজনীতির পাঠ দিতে থাকেন এবং শেখ মুজিবও গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে সে পাঠ গ্রহণ করতে শুরু করেন। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশমতো কাজ করতে গিয়ে রাজনীতিতে অনেক পরিপক্বতা লাভ করেন। সে সময় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নানা রকম বিভাজন ছিল। সেই বিভাজন ছাত্রদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রদের মধ্যে দুটো দল হয়ে যায়। দলাদলি মিটমাট করার জন্য এক পর্যায়ে ছাত্রদের নিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় কোন একটি বিষয় নিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে শেখ মুজিবের মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং কথা কাটাকাটি হয়। শেখ মুজিব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন- যে ছাত্রটিকে সোহরাওয়ার্দী সাহেব সমর্থন করছেন তিনি তাকে গ্রহণ করবেন না। একথা শুনে উত্তেজিত হয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ইংরেজীতে শেখ মুজিবকে বলে ফেলেন- ‘Who are you? You are nobody.’ শেখ মুজিব অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন- ‘If I am nobody, then why you have invited me, you have no right to insult me. I will prove that I am somebody. Thank you sir, I will never come to you again.’ একথা বলে চিৎকার করতে করতে বৈঠক ছেড়ে বের হয়ে এলাম। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেননি শেখ মুজিব। সোহরাওয়ার্দী সাহেব দ্রুত নিজের ভুল বুঝতে পারেন। এবং শেখ মুজিবকে পথ থেকে ফিরিয়ে আনবার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আহ্বানে ফিরে আসেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব শেখ মুজিবের দাবি মেনে নিয়ে বলেন- ‘যাও তোমরা ইলেকশন কর, দেখ নিজেদের মধ্যে গোলমাল করো না।’ শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতে উল্লেখ আছে- ‘সোহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে আদর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন’- বললেন, আমি তো আর কাউকেই এ কথা বলি নাই, তোমাকে বেশি আদর ও স্নেহ করি বলে তোমাকেই বলেছি’ (পৃ. ২৯)। এভাবেই শেখ মুজিবের আমিত্বের বিজয় শুরু হয়। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছাড়া এই আমিত্ববোধের প্রকাশ ঘটতে পারে না। চলবে...
×