ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুফী মোতাহার হোসেন

৭ মার্চ ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৭ মার্চ ২০১৭

৭ মার্চ ১৯৭১

বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক ঐতিহাসিক অবিস্মরণীয় দিন। শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত পাকিস্তানী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক সদর দফতরের সবগুলো দূরপাল্লার কামান এবং মেশিনগানের নল তাক করে রাখা হয়েছিল রমনা রেসকোর্সের দিকে। উত্তাল জনসমুদ্রের মাথার ওপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছিল সামরিক জান্তার হেলিকপ্টার। ৬ মার্চ মধ্যরাতে পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরের কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে তীব্র হুমকি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘যদি কাল রমনা রেসকোর্স ময়দান থেকে স্বাধীনতার একতরফা ঘোষণা দেয়া হয়- তাহলে জেনারেল অফিসার কমান্ডিংয়ের সব ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হবে জনসভার সবাইকে- প্রয়োজনে ঢাকা শহরকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হবে।’ এসব ভয়ভীতি এবং হুমকিকে উপেক্ষা করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে সেদিন সকাল থেকেই জনতার অবিরাম ঢল নামে রমনা রেসকোর্স অভিমুখে। সারাদেশ থেকেও লঞ্চে, স্টিমারে, ট্রেনে, বাসে চড়ে ও পায়ে হেঁটে মানুষ ‘চলো চলো- রেসকোর্স চলো’ সেøাগান দিয়ে ছুটে চলে ঢাকার দিকে। হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা, কারও হাতে লাঙল-জোয়াল, কারও হাতে স্বাধীন বাংলার নতুন পতাকা ও শহীদ স্মরণে কালোপতাকা, গামছায় বাঁধা চিড়া-মুড়ি নিয়ে লাখ লাখ মানুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বনিতায় ভরে গেল ঘোড়দৌড় খেলার সেই বিশাল ময়দানটি। জনসমুদ্রের এই বিশাল ঊর্মিমালার একপ্রান্ত গিয়ে পৌঁছল ময়দান ছাড়িয়ে প্রেসক্লাব পয়েন্টে। আর অন্যপ্রান্ত গিয়ে ঠেকল শাহবাগ মোড় ছাড়িয়ে পাবলিক লাইব্রেরী ও ঢাকা আর্ট কলেজ পয়েন্ট পর্যন্ত। জনতার এই বিশাল উত্থানে ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানী সামরিক জান্তা মহাসমাবেশ বানচালের জন্য নানা ষড়যন্ত্র এবং হুমকি-ধমকি ছাড়াও সকাল থেকেই ঢাকা শহরে কিছু পরিকল্পিত গুজবও ছড়াল। এর মধ্যে অন্যতম একটি গুজব ছিল রেসকোর্সে আসার পথেই কমান্ডো আক্রমণে হত্যা করা হবে শেখ মুজিবকে। ‘মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছে জনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। সেøাগানের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে। লাখোকণ্ঠে এক আওয়াজ। বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ায় সওয়ার লাখোকণ্ঠের বজ্রশপথ। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে পূর্ববাংলার মানচিত্র অঙ্কিত সবুজ জমিনের ওপর লাল সূর্যের পতাকা। লক্ষহস্তে বজ্রমুষ্টি মুহুর্মুহু উত্থিত হচ্ছে আকাশে। জাগ্রত বীর বাঙালীর সার্বিক সংগ্রামের প্রত্যয়ের প্রতীক, শত কোটি মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ারের বাঁশের লাঠি মুহুর্মুহু সেøাগানের সঙ্গে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে।’ কোন বাধা-বিপত্তি আর গুজব ঠেকিয়ে রাখতে পারল না বাঙালীকে, ঠেকিয়ে রাখতে পারল না বঙ্গবন্ধুকে। বিকেল ৩টার কিছু পরে ধানম-ি ৩২ নম্বর রোডের ঐতিহাসিক বাসভবন থেকে মোটরবহর নিয়ে ইতিহাসের মহানায়ক এসে পৌঁছলেন রৌদ্রকরোজ্জ্বল রেসকোর্স ময়দানে। পাকিস্তানী সামরিক চক্রের সমস্ত হুমকি ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কিছুটা কৌশলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমনি সেদিনের ভাষণে বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, তেমনি আবার সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে সেদিন তিনি রক্ষা করেছিলেন ১০ লক্ষাধিক মানুষের জীবন। ৭ মার্চের জনসভার সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পাশে উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ এবং আরও অনেকে। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সুদক্ষ নেতৃত্ব ও দূরদৃষ্টির কারণে শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়েছিল রমনা রেসকোর্সের মহাসমাবেশ। ৭ মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিকতা জাতির উদ্দেশে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ অনন্ত মহিমায় ভাস্বর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণা সৃষ্টিকারী ভাষণগুলোর অন্যতম ৭ মার্চের ভাষণ। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালী জাতিসত্তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষের মর্যাদা নিয়ে বিশ্বসভায় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়েছে এই ভাষণে। গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ১৮৬৩ সালে প্রদত্ত বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতার সঙ্গে তুলনীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জাতির উদ্দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিকনির্দেশনামূলক ৭ মার্চের ভাষণ। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বাঙালী জাতির সুদীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তদানের গৌরবময় ইতিহাস। উদার মন ও বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশবাসী তাঁর একান্ত আপনজন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশাল জনসভায় সমবেত মুক্তিপাগল দেশবাসীকে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে তিনি সম্বোধন করেন। ভাষণের শুরুতে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন- ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়।’ ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের উল্লেখ করে আবেগ উদ্বেলিত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি বসবে। আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এই দেশকে গড়ে তুলব...। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, গত ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস...।’ ইতিহাস সচেতন বঙ্গবন্ধু বক্তব্যের জের টেনে বলেন, ‘১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভ করেও তারা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে, ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সরকারে ছিলেন তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়Ñ পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না।’ বাঙালী জাতির স্বার্থসংরক্ষণে ৬ দফা অনুযায়ী পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অটল। ঐতিহাসিক ৬ দফা বাঙালী জাতির মুক্তির ‘ম্যাগনাকার্টা’। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ৬ দফায়। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ৬ দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে হুমকি দিয়েছিল : ‘অস্ত্রের ভাষায় ৬ দফা দাবির জবাব দেয়া হবে।’ ৬ দফা দাবি বাংলার গণমানুষের হৃদয় জয় করতে থাকলে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপন করে দায়ের করা হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। শাসকের ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত করেননি বঙ্গবন্ধু। প্রতিবাদ- বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশবাসী। ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন রূপান্তরিত হয় গণঅভ্যুত্থানে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। জাতির মুক্তির প্রশ্নে নির্ভীক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে দাঁড়ায় জেনারেল আইয়ুব। বঙ্গবন্ধুর দাবি অনুযায়ী জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু। শুরু হলো ষড়যন্ত্র। ৬ দফার বিরোধিতা করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষমতা দাবি করলেন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টোর বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘৬ দফা পরিবর্তনের কোন অধিকার আমার নেই। এটা জনগণের সম্পদ।’ ভুট্টো ঘোষণা দিলেন ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলির অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন মেম্বারকে যোগদান করতে দেয়া যাবে না। কেউ যোগদান করলে কসাইখানা হবে এ্যাসেম্বলি। এরপর ১ মার্চ (১৯৭১) এ্যাসেম্বলির অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দেশের উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনাব ইয়াহিয়া সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের ওপরে, বাংলার মানুষের বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কিভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছেÑ আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’ ১০ মার্চের রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যোগদান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব। ৩ (মার্চ) তারিখ পল্টনে আমি অসহযোগের আহ্বান জানালাম। বললাম অফিস-আদালত, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করেন। আপনারা মেনে নিলেন। হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে একজনের (জনাব ভুট্টো) সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি (প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান) করেছেন তাতে সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘২৫ মার্চ তারিখে ইয়াহিয়া খান এ্যাসেম্বলি কল করেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই।... শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এ্যাসেম্বলি কল করেছেন। আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন (মার্শাল ল’) উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব এ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারব কি পারব না।’ তাঁর প্রতি আস্থা আছে কিনা বঙ্গবন্ধু সে কথা জনতার কাছে জানতে চাইলে মুক্তিকামী লাখো জনতা হাত উঠিয়ে আস্থা জ্ঞাপন করে। বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের প্রতি অসহযোগিতার আহ্বান জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না।... ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। পাকিস্তান সরকার এরপরও বাঙালীর আত্মপ্রতিষ্ঠার দাবির বিরোধিতা করতে থাকলে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এরপরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা আছে, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সরকারী কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ দান করে তিনি বলেন, ‘সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার দেশের মুক্তি না হয়Ñ খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলো।’ ঐক্যে বিজয়, বিভেদে পরাজয়। হিন্দু, মুসলমান, বিহারী, বাঙালীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির অপচেষ্টা সম্পর্কে তাই সতর্ক থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘... শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, মিছিলের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী, নন-বাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।... যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন।’ বাঙালী জাতিকে সকল দিক থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেনÑ ‘প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবÑ এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জ্ঞাপনের জন্য ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ হিসেবে অভিহিত করা যুক্তিযুক্ত। সেদিন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার চূড়ান্ত মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাকেই মূর্ত করেছেন ৭ মার্চের ভাষণে। ৭ মার্চের (১৯৭১) ভাষণের এটিই ঐতিহাসিকতা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ঐতিহাসিক তাৎপর্যে ম-িত। আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ এ্যাড্রেসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা হয়। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ (অলিখিত এবং স্বল্প সময়ের) বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষণ। এর আগে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস বিশ্বের সেরা ভাষণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯ নবেম্বর, ১৮৬৩ স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদ যোদ্ধাদের উদ্দেশে জাতীয় সৈনিক সমাধিক্ষেত্র উৎসর্গকরণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গেটিসবার্গ এ্যাড্রেস’ খ্যাত ভাষণটি ছিল লিখিত এবং পরিসর ছিল সীমিত। যার সারমর্ম ছিল জনকল্যাণ করতে পারে ‘জনগণের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকার, যা পৃথিবী থেকে ধ্বংস হবেই না।’ ৭ মার্চের জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির বিষয়বস্তু আরও অনেক বেশি ব্যাপক। রণকৌশল, স্বাধীনতা আদায় ও রক্ষা এবং জনগণকে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তাসহ কূপম-ূকতা থেকে মুক্ত করার দিকনির্দেশনা সুদূরপ্রসারী অঙ্গীকার। কাব্যিক কৌশলে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না। ঘবংিবিবশ পত্রিকার ৭ এপ্রিল ’৭১ সংখ্যায় ভাষণটির জন্য বঙ্গবন্ধুকে চড়বঃ ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপং আখ্যায়িত করেছিল। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ১০ মার্চের প্রস্তাবিত বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেন, সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ থেকে কেন্দ্রীয় শাসনের প্রভাবমুক্ত ও কর্তৃত্বমুক্ত থেকে পূর্ববাংলা স্বাধীন সত্তা অর্জন করে এবং সকল কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন বাংলার মুকুটহীন রাজা। সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যাবে পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী খানের একটি বর্ণনা থেকে। ‘বাংলাদেশের জন্ম’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন : ‘৭ মার্চ প্রদেশের সিনিয়র অফিসাররা যখন নতুন এমএলএ (সামরিক আইন প্রশাসক) জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন, তখন তাদের মনোভাব ছিল উদাসীনের মতো। এটা সুস্পষ্ট ছিল যে, একই উদ্দেশ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তাদের হৃদয়ও চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। এসবের ফলে ইডেন বিল্ডিং-এর পরিবর্তে প্রাদেশিক সচিবালয়ের কাজকর্ম চলছিল শেখ মুজিবের বাসভবন থেকে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ও রেলওয়েসহ সকল সরকারী বিভাগই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের নির্দেশাবলী পালন করছিল।... অসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতা ব্যতীত মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষের পক্ষে কাজকর্ম চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছিল, বিশেষ করে এমন একটি পরিস্থিতিতে যখন প্রদেশের সমগ্র জনগণের মনোভাবই ছিল অমান্য করার।’ লেখক : শিক্ষক
×