ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৭ মার্চ ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

আজ সাতই মার্চ। স্বাধীনতার মাস মার্চের প্রতিটি দিনই স্মরণযোগ্য। তবে এর মধ্যে বিশেষ দুটি দিন হলো সাত এবং পঁচিশে মার্চ। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) একাত্তরের সাতই মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন সেটি কেবল ঐতিহাসিক বিচারেই তাৎপর্যপূর্ণ নয়, বিশ্বের সর্বকালের সেরা ২৫টি ভাষণের মধ্যে তা আপন গুণে জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও সাতই মার্চে ঢাকার প্রধান প্রধান রাজপথই কেবল নয়, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় মাইকে এই ভাষণ শোনা যাবে। এতগুলো বছর পরেও যখন এই ভাষণ শুনি তখন শিহরিত না হয়ে পারি না। শুনতে শুনতে বরাবরের মতো আমার দুটি প্রতিক্রিয়া হয়। ধারণা করি এমন প্রতিক্রিয়া আমার মতো লক্ষজনেরই। প্রথমত, বাঙালী হিসেবে পরম গৌরব বোধ হয়। যে মহান নেতাকে আমি কখনও চোখে দেখিনি, মানসপটে তাঁর পূর্ণাঙ্গ অবয়ব ভেসে ওঠে। স্পষ্ট যেন দেখতে পাই ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে তিনি বলছেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ দ্বিতীয়ত, চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে এই মানুষটিকেই এ দেশেরই কিছু নাগরিক নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করেছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের জন্ম পঁচাত্তরের অব্যবহিত আগে কিংবা পরে- তারা কি এই ভাষণটির জন্য আবেগ বোধ করে? আজকের তরুণ প্রজন্ম যেন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নির্দেশনা সংবলিত কবিতার মতো আবেদনময় ও হৃদয়স্পর্শী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটির প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে সেজন্য পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাত্র ২০-২৫ মিনিটের সুগ্রন্থিত ভিডিও উপস্থাপনার মাধ্যমেই এটি করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। এ নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা রয়েছে। এতে ইতিহাস বিকৃতির থাবা থেকেও ভবিষ্যত সুরক্ষা পাবে বলে আশা করতে পারি। একাত্তরের লন্ডন ৩রা এপ্রিল ১৯৭১। ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস অভিযান এবং গণহত্যার খবর তখন আসতে শুরু করেছে। লন্ডন প্রবাসী বাঙালীরা হতবিহ্বল। সবাই উদ্বিগ্ন স্বদেশে ফেলে আসা স্বজনদের নিয়ে। কেউ বুঝতে পারছেন না কী ঘটছে, কী করা উচিত। সেদিন লন্ডনের রাস্তায় দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। শাড়ি পরা প্রায় ২শ’ বাঙালী নারী রাস্তায় নেমে এসেছেন তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে। বাচ্চাদের পুশ চেয়ারে বসিয়ে মিছিল করে তারা চলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতর দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দিকে। পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে, সে ব্যাপারে বিশ্ব গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সেটাই প্রথম চেষ্টা। সেদিনের মিছিলে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের এক বিরাট অংশ ছিলেন একেবারে সাধারণ গৃহিণী। তাদের অনেকের জন্য জীবনে সেটাই প্রথম মিছিল। কিন্তু তাদের তেজোদীপ্ত মুখ আর সংকল্প দেখে সেটা মনে হচ্ছিল না। পরদিন ৪ এপ্রিল লন্ডনে বাঙালীদের আরও বড় সমাবেশ হলো ট্রাফালগার স্কোয়ারে। সেই সমাবেশের জন্য আগে থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। সেই মিছিলে যোগ দিলেন কয়েক হাজার মানুষ। সে সময় বাংলাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্যেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই পুরো যুদ্ধের সময় ধরেই এভাবেই লন্ডন পরিণত হয় বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে। লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে এই আন্দোলনে এবং বিশ্বজনমত গঠনে সেদিন বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। আবু সাঈদ চৌধুরী সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বহু অজানা ইতিহাসের সরব সাক্ষী লন্ডন। দূর পরবাসে থেকেও এ সময় বহু মুক্তিকামী বাঙালী ও অবাঙালী নাগরিক বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাঁপিয়েছেন বিলেতের রাজপথ। প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের বিক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী দিনলিপিসহ পুরো সময়কাল নিয়ে আলোকচিত্র ও ঐতিহাসিক স্মারক প্রদর্শনী ‘লন্ডন ১৯৭১’ শুরু হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিলে। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশিরভাগ ছবি ব্রিটিশ আলোকচিত্রী রজার গোয়েন ও বিলেতে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইউসুফ চৌধুরীর তোলা। ওই সময়ের তরুণ রজার গোয়েন নিজ তাগিদেই তাঁর ক্যামেরায় বন্দী করেছেন আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো। এ ছাড়া বেশ কিছু সংগৃহীত ছবিও রয়েছে। সাত বছর ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ছবিগুলো সংগ্রহ করেছেন উজ্জ্বল দাশ। এর বাইরে কিছু পোস্টার, ডাকটিকিট ও প্রচারপত্রও স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থনে বিশ্ব জনমত গঠনে ব্রিটিশ এমপি, রাজনীতিক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, প্রগতিশীল শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণীর মানুষ অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। প্রদর্শনীতে জায়গা করে নিয়েছেন সেই ভিন দেশী বন্ধুরাও। বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ডেভিড অ্যাশলে এই প্রদর্শনীকে অভিহিত করেন অনুপ্রেরণাদায়ী আয়োজন হিসেবে। টক অব দ্য টাউন গত সপ্তাহের একটি ঘটনা তো টক অব দ্য কান্ট্রিই হয়েছিল। ঢাকা যেহেতু দু’কোটি লোকের শহর, তাই পরিবহন ধর্মঘটের মতো কোন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ঢাকায় তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় তীব্র। এক ঘাতক চালককে দ-বিধির আওতায় যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় ঘোষণার পর শুরু হয় তুলকালাম। প্রথমে ছিল রাজধানীর বাইরে। ঢাকার মানুষ ভাবছিল এ দফায় পার পেয়ে যাবে। কিন্তু সেটি হয়নি শেষ পর্যন্ত। এছাড়া রাজধানীর একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় সংঘটিত এক অপ্রীতিকর ঘটনা ছিল গত সপ্তাহের ঢাকার টক অব দ্য টাউন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরের ফেসবুক স্ট্যাটাস তুলে দিলে ঘটনার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। তিনি লিখেছেন, ‘দু‘ছেলে নর্থ সাউথে পড়ত। ওদের সুবিধার জন্য বছর দু’আড়াই আমাদের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় থাকতে হয়েছিল। গিয়েছিলাম আনন্দের সঙ্গে, থেকেছিলাম তিক্ত সব অভিজ্ঞতা পার করতে করতে। নিরাপত্তা প্রহরীসহ ওখানকার সবাই, কতটা বর্বর, অমানবিক, অনৈতিক, বেয়াদব তার কিছু কিছু দেখার সুযোগ হয়েছিল। ওদের গ্রুপের পত্রিকার আজকের যে ট্রিটমেন্ট, তা অন্যরকম হবে, তেমন আশা করিনি। তবে এতটাও হয় তো ভাবিনি। এখন ওখানকার চাকুরে সাংবাদিকদের গালিগালাজ করব? তার আগে, অন্য কোন পত্রিকার সাংবাদিকরা মালিকপক্ষের এমন ঘটনায় কী আচরণ করত, তা জানতে পারলে ভাল হতো।’ ফাল্গুনে বাগানবিলাস বাগান বিলাস বা বুগেনভেলিয়া বসন্তের ফুল না হলেও ঢাকায় এই ফাল্গুনে ফুলটির দাপট লক্ষ্য না করে পারা যায় না। ঋতুরাজ বসন্তের ছটা এসে লাগছে অনেকের চোখমুখে, বিশেষ করে মনের নিভৃত কোণে। সময় করে কেউ যদি প্রায় বিরাণ বৃক্ষের এই মহানগরীর গাছপালায় চোখ রাখেন তাহলে বিপরীতমুখী সৌন্দর্য দৃষ্টিকে খানিকটা আচ্ছন্ন করে তুলবে। ঢাকার উত্তর প্রান্তে বিমানবন্দর সড়কের পাশে পাতাশূন্য দীর্ঘদেহী গাছগুলোর দিকে তাকালে মন উদাস হয়ে যাওয়ারই কথা। পাতা ঝরে পড়া শুরু হয়ে গেছে। আবার প্রকৃতিপ্রেমীদের অনুসন্ধান চলছে বসন্তের পুষ্পপল্লব শোভার। এই ঋতুতে শিরীষ গাছের পত্রবিরল শাখায় রাশি রাশি স্বর্ণাভ শুকনো ফল বিচিত্র এক দৃশ্যের অবতারণা করেছে। আর মেহগনি গাছভর্তি ফল পেকে ফেটে পড়তে শুরু করেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসে প্রপেলারের মতো আকৃতির আবরণে ঢাকা বীজ। বলছিলাম বাগান বিলাসের কথা। বাগান বিলাস ফুলের রং রক্ত লাল বা আগুন লাল হওয়ায় এটি সবার কাছে অনেক পছন্দ। একটি ডাল কেটে লাগালেই বাগান বিলাস আস্তে আস্তে বড় গাছে পরিণত হয়। দূর থেকে বাগান বিলাস ফুলের লাল দেখা যায়। সারা বছরই বাগান বিলাস ফুল দেয়। তবে শরতের শেষ এবং শীতের শুরুতে গাছে গাছে বাগান বিলাসের সমাহার দেখা যায়। এই ফুলের কোন গন্ধ বা সুবাস নেই। চোখে দেখাতেই যত আনন্দ। বাগান বিলাস নিজেই রীতিমতো এক বাগান। কাল নারী দিবস কাল ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবস কি শুধুই নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? তা নয়, বরং নারীর সমান্তরালে নারীভুবন সম্বন্ধে পুরুষদের সচেতনতার একটি সুযোগ নিয়ে আসে এই নারী দিবস। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ কেমন তার ওপরেও নির্ভর করে নারী দিবসের সার্থকতা ও বিফলতা। নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সহাবস্থান, সমানাধিকার এবং সমমর্যাদার বিপক্ষে অবস্থান করতে পারে পুরুষের পাশাপাশি নারীও। একথা নারীবাদীরা হয়ত মানবেন না। তারা সব কিছুর পেছনেই দায়ী করেন পুরুষতন্ত্রকে। পরিবারে নানা অবস্থানে অবস্থানকারী নারীদের ভেতর (বউ-শাশুড়ি-কন্যা-ননদ) সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতার নেপথ্যে পুরুষতন্ত্র ও অর্থনীতি ক্রিয়াশীল থাকে- এটা অমান্যের কিছু নেই। কিন্তু কট্টর নারীবাদীরা কিছুতেই মানতে নারাজ যে নারীরও মানসিক উন্নতি ও সহৃদয়তা জরুরী পারিবারিক সম্পর্কগুলো সুশোভন রাখার প্রয়োজনে। যাহোক, নারী দিবসে ঢাকার নারী সমাজ নিয়ে দুএকটা কথা বলার জন্যই এই গৌরচন্দ্রিকা। সাধারণভাবে ঢাকার বহিরঙ্গের জীবনে বা সোজা কথায় রাস্তাঘাট অফিস-আদালতে যেসব নারী আমরা দেখি তারা তো সম্পর্ক সূত্রে আমাদের তথা পুরুষের অচেনা ও পরিচিত, স্বজন ও সহকর্মীও বটে। সবচেয়ে বড় কথা তারা সহনাগরিক। একথা আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, ঢাকার নারী সমাজ সাধারণভাবে অগ্রসর ও সপ্রতিভ। এক অর্থে তারা পুরুষের পাশাপাশিই চলেছেন। কার্যালয়ে পুরুষের সঙ্গে সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই কর্মপরিবেশ বজায় রাখছেন, পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন। নারী-পুরষেভেদ টেনে যারা নারীর এই সমকক্ষতায় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছেন, সেই গুটিকতক পুরুষ যেমন নারীর প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছেন, তেমনি পুরুষ সহকর্মীদের অনেকেও প্রতিবাদ করছেন। অর্থাৎ বলতে চাইছি, নারী একদিকে সরব হচ্ছেন, অপরদিকে পুরুষদেরও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে। ঢাকার পথেঘাটে আগের তুলনায় বেশি সংখ্যক নারী দেখা যায় যারা ব্যক্তিগত গাড়ি চালাচ্ছেন। মোটরসাইকেল চালক নারীর সংখ্যা অবশ্য তেমন বাড়েনি। নারীর জন্য রাজধানীতে আর আলাদা পেশা বলে কিছু নেই। সব পেশাতেই নারী তাদের কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ সুন্দরভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। আজকের তরুণী ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এমন মানসিকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি পুরুষ যা করছে সেসব কাজ করাকে নিজের অধিকার বলেও ভাবছেন। সর্বক্ষেত্রেই যদি এটা তারা ভাবেন এবং প্রথা ভাংতে সমর্থ হন তাহলে এক ধাক্কায় নারী অনেকটা এগিয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। অনেক পরিবারে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা একটু রাত করে ঘরে ফিরলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই দেখা হচ্ছে। ঢাকায় ইভটিজিং বহুলাংশে কমেছে। পথেঘাটে নারীর চলাচল শতভাগ নিরাপদ হয়েছে এমন দাবি করব না, তবে অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। ৫ মার্চ ২০১৭ [email protected]
×