ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কুসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল চাঙ্গা করতে চায় বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৬ মার্চ ২০১৭

কুসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দল  চাঙ্গা করতে চায় বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে বিজয়ী হতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিকভাবে দলের জনপ্রিয়তা যাচাই ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে চায় দলটি। এ জন্য বেশ কিছু কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। আর এ কর্মকৌশল বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয়ভাবে দলীয় হাইকমান্ড এবং স্থানীয়ভাবে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সক্রিয় রয়েছেন। সূত্রমতে, গত বছর ২২ ডিসেম্বর অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করে। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। এ নির্বাচন কেমন হবে এ নিয়ে প্রতিদিনই বিএনপির সিনিয়র নেতারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে বক্তব্য প্রদান করছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। আর সরকারী দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সংবিধান অনুসারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। তবে যে সরকারের অধীনেই হোক গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে দলের নিবন্ধন রক্ষা করতে হলে বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। এ পরিস্থিতিতে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে চলে আসায় বিএনপির সকল মনোযোগ এখন এ নির্বাচনকে ঘিরেই। ৩০ মার্চ অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে এবারও মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। কুমিল্লায় সাক্কুর জনপ্রিয়তা এবং সকল দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বিজয়ের ফসল ঘরে তুলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সফলতা অর্জন করতে চায়। এ জন্য ইতিমধ্যেই দলীয় হাইকমান্ড বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতাকে এ নির্বাচন মনিটর করার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ ছাড়া কুমিল্লা শহরে দলীয় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল রয়েছে তা মিটিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এর বাইরে ২০ দলীয় জোটের সকল স্থানীয় নেতাকর্মীকে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে ঘরে ঘরে গণসংযোগ করে ভোট প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। এভাবে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে মনিরুল হক সাক্কুর বিজয় নিশ্চিত করে বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় থাকা বিএনপি কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার দলকে চাঙ্গা করতে চায়। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আমাদের দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা সক্রিয় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের দলের মেয়র প্রার্থী সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু কুমিল্লায় একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। এ ছাড়া ধানের শীষ প্রতীকে তিনি নির্বাচন করছেন বিধায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী তার পক্ষে কাজ করছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিএনপি দলের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করবে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আগেরবারের নির্বাচিত মেয়র দলের কেন্দ্রীয় নেতা মনিরুল হক সাক্কুকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। তবে আগের বার বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় সাক্কু দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করে মেয়র পদে বিজয়ী হন। অবশ্য মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আবার সাক্কুকে দলে ফিরিয়ে নেয়া হয়। আর এবার দল নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়ে মনিরুল হক সাক্কুকে মনোনয়ন দেয়। খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে কুমিল্লার সব দলীয় নেতারাও তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। কুমিল্লার এক বিএনপি নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের আগের নির্বাচনে মনিরুল হক সাক্কু এবারের আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা আফজাল খানকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। সাক্কু তখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তার পক্ষে ছিলেন। এমনকি আফজাল খানের বিপক্ষে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের লোকেরাও সাক্কুকে ভোট দিয়েছেন। এবার আওয়ামী লীগে কোন্দল আগের চেয়েও বেশি। তাই সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত। এদিকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীমকে। এর বিপরীতে বিএনপির সমন্বয়কারী করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে। এ ছাড়া ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এলডিপি মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী রেদওয়ান আহমেদকে। এর বাইরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা কুসিক নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রচার কাজের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া লন্ডন থেকে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি কুমিল্লার স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। সূত্রমতে, বিএনপি মাঠ জরিপ করে দেখেছে নারায়ণগঞ্জের মতো ভোট হলে এবার কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছোট-বড় অন্তত ৬টি গ্রুপ থাকায় এবং এর মধ্যে ক’টি গ্রুপের মনিরুল হক সাক্কুর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় বিএনপি প্রার্থী সুবিধাজনক অবস্থনে থাকবে। এসবকিছু বিবেচনায় নিয়েই বিএনপি সেখানে বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তার পরও স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে মনিরুল হক সাক্কুর প্রতিপক্ষ মোঃ ইয়াসিনসহ সকল নেতাকে ডেকে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বৈঠক করেছেন এবং দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে এখন কুমিল্লার সকল স্থানীয় নেতা মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন বলে জানা গেছে। জানা যায়, কুসিক নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু দিনরাত গণসংযোগ চালিয়ে নগরবাসীর কাছে তার বিগত দিনের কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন। সেইসঙ্গে তিনি বলছেন এবার নির্বাচিত হলে নগরীতে যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প হাতে নেবেন। ইতোমধ্যে তার সময়ের নেয়া কিছু প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। তিনি বিজয়ী হলে আরও নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিয়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী শহর কুমিল্লাকে একটি পরিবেশসম্মত আধুনিক নগরীতে পরিণত করবেন বলে অঙ্গীকার করছেন। এভাবে কেন্দ্রীয় ক’জন নেতাসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগ চালিয়ে ইতিমধ্যেই সাক্কু ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। এদিকে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নতুন নির্র্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বিএনপি তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করলেও এ কমিশনের অধীনেই তারা কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। রবিবার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তাই গণতন্ত্রকে সম্প্রসারিত করতেই আমরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। ইতিমধ্যেই বিএনপির পক্ষ দলের নেতারা বলেছেন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হয় তাহলে আন্দোলন শুরু হবে। তবে নির্বাচন কমিশনকে চাপে রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করার এটি বিএনপির একটি কৌশল বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। জানা যায়, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এখন কাউন্সিলর পদেও একক প্রার্থী দেয়ার চেষ্টা চলছে। এ কাজের জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ক’জন সিনিয়র নেতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের সহযোগিতা করবেন আরও বেশ ক’জন স্থানীয় বিএনপি নেতা। তারা সবাই খালেদা জিয়ার পরামর্শ নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া বৃহত্তর কুমিল্লা ও আশপাশের এলাকায় যাদের বাড়ি বিএনপির এমন কেন্দ্রীয় নেতা ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদেরও কুসিক নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বলা হয়েছে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সমন্বয়কারী ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধভাবে মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে কাজ করছেন। বিএনপি ও মনিরুল হক সাক্কুর জনপ্রিয়তার কারণে এ নির্বাচনে আমরা বিজয়ী হবো বলে আশাবাদী। তবে নির্বাচন যেন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে হয় সে জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। উৎসব আমেজ কুমিল্লায় ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, আগামী ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রমেই কুমিল্লা মহানগর উৎসবের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু না হলেও বসে নেই প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা। কর্মীদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনা, হাটে-ঘাটে ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় ও দোয়া চেয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন উভয় দলের মেয়র প্রার্থী সাক্কু-সীমাসহ কাউন্সিলর প্রার্থীরা। এদিকে রবিবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মেয়র প্রার্থীসহ ৪ জনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হলেও যাচাই-বাছাইয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর (অব) মামুনুর রশিদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়। এছাড়া কাউন্সিলর পদে ২ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এদিকে রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে মনোনয়ন বৈধ ঘোষণার পর ফটোসেশনে দুই মেয়র প্রার্থী মুখোমুখি হন এবং একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
×