ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চূড়ান্ত সময় বেঁধে দেয়া হবে বৃহস্পতিবার

রিভিউ আবেদন খারিজ, বিজিএমইএ ভবন ভেঙ্গে ফেলতেই হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ মার্চ ২০১৭

রিভিউ আবেদন খারিজ, বিজিএমইএ ভবন ভেঙ্গে ফেলতেই হচ্ছে

বিকাশ দত্ত ॥ ভবন নিয়ে চূড়ান্ত আইনী লড়াইয়ে হেরে গেছে বিজিএমইএ (পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি)। জলাধার রক্ষা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় গড়ে ওঠা বিজিএমইএ ভবনটি ভাঙ্গা এখন সময়ের ব্যাপার। বহুতল এ ভবন ভাঙতে কত সময় লাগবে তা আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে আবেদনে জানাতে হবে বিজিএমইএকে। ওইদিনই আপীল বিভাগের আদেশে ভবন ভাঙ্গার চূড়ান্ত সময় বেঁধে দেয়া হবে। ভবন ভাঙ্গার আপীলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপীল বিভাগ। রবিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের আপীল বেঞ্চ এ রায় দেন। আদালতে বিজিএমইএর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী, সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মইনুল ইসলাম। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং রিটকারীর পক্ষে ছিলেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ ওই ভবনটিকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো’ উল্লেখ করে রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এদিকে আদেশের পর এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে তিন বছরের সময় আবেদন করা হয়েছিল। আমরাও গুরুত্ব বিবেচনায় এক বছরের সময় চেয়েছিলাম। এখন বিজিএমইএ বৃহস্পতিবারের মধ্যে সময়ের আবেদন জমা দিলে আদালত ওই বিষয়ে আদেশ দেবেন। তিনি আরও বলেন, একটি অবৈধ জিনিস শুরু করার আগেই বাধা দেয়া উচিত। আমি বলব যেসব পরিবেশবাদী এসব নিয়ে কাজ করেন তাদের এই জায়গায় ভবন শুরু করার আগেই বাধা দেয়া উচিত ছিল। তারা তো জানত এটা একটা অবৈধ জায়গা। তাই কোন অবৈধ কাজ শুরুর আগেই বাধা দেয়া উচিত। তিনি বলেন, বাধা দেয়ার পর না মানলে তখনই তাদের আদালতে আসার দরকার ছিল। অন্যদিকে এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেছেন, রবিবার চূড়ান্ত রায় হয়ে যেতে পারত, কিন্ত এ্যাটর্নি জেনারেল সময় চাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমরা যারা পরিবেশ সচেতন তারা একটু হতাশ। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর মতো একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভবনটি ভাঙ্গার কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য পদক্ষেপ নেবেন। তা না করে উনি ঢিলে করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমরা আশা করি সময় প্রার্থনা করলেও সেই সময়টা আদালত মঞ্জুর করবেন না। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের পূর্ব পাশে অবস্থিত বিজিএমইএ ১৮ তলা ভবনটি অবিলম্বে সংগঠনের নিজ খরচায় ভেঙ্গে ফেলতে রায় দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। আদালতের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় গত বছরের ৮ নবেম্বর প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন বিজিএমইএর সভাপতি। এই আবেদনে আপিলের রায় স্থগিতের পাশাপাশি অন্যত্র স্থানান্তরের জন্য তিন বছরের সময় চাওয়া হয়। এর আগে বিজিএমইএ ভবন ভাঙ্গার নির্দেশ দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্টের রায়ে ওই ভবনটিকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো’ উল্লেখ করে রায় প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙ্গে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় গড়ে ওঠা বিজিএমইএ (পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি) ভবন ভাঙ্গার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আদালতে বলেছিলেন, ‘বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যম-িত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রামিত করবে।’ মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১০ সালের ২ অক্টোবর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ বিষয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মুনিরউদ্দিন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেয়। রুলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙ্গার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এতে স্থগিতাদেশ চেয়ে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ এপ্রিল চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায়ের ওপর ৬ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেয়। পরে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ ভবনটি ভেঙ্গে ফেলতে হাইকোর্টের দেয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ওই বছর ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রীমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপীল করে। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোট রায়ে বেশ কিছু নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, এ জমির মালিকানা স্বত্ব বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষের নেই, সে কারণে তাদের ঐ জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। ভবনটি তৈরি করার কারণে বেগুনবাড়ি খালের পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং হাতিরঝিল প্রকল্পে বিঘœ ঘটাচ্ছে। তাই ভবনটি ভিত থেকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। বেগুনবাড়ি খাল পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে এনে হাতিরঝিল প্রকল্পকে মূল নক্সা অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে বলেছে আদালত। বিজিএমইএ ভবনের কিছু কিছু অংশ ইজারা এবং বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে উল্লেখ করে আদালত বলে, যারা এই ভবনে বিক্রি এবং ইজারার মাধ্যমে দখল পেয়েছেন তাদের বিনিয়োগের আগেই চিন্তা করা উচিত ছিল। তবে তারা চাইলে চুক্তি আইন ও জালিয়াতির অভিযোগে প্রতিকার চাইতে পারেন বলে আদালত জানিয়েছে। এ মামলাটি শুনানির জন্য এলে হাইকোর্ট ১০ আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে নিয়োগ দেন। এরা হলেন- ড. এম এ জহির (বর্তমানে মৃত), সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আকতার ইমাম, এ এফ এম মেজবাহ উদ্দিন, এ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী, এ্যাডভোকেট আনিসুল হক (বর্তমানে আইনমন্ত্রী), ব্যারিস্টার সারা হোসেন, এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ, ইকবাল কবির লিটন (বর্তমানে বিচারপতি) এবং এ্যাডভোকেট সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান। ‘১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ি খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরের ২৮ নবেম্বর ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রযোজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে এর নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনীভাবে প্রদান করে। অথচ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না। ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নক্সা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক বলে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও ভবনটি ভাঙ্গার দাবি জানিয়ে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণী বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে এবং এতে এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে একবার এ ভবনটি ভাঙ্গার উদ্যোগ নেয়া হয়। তৎকালীন এলজিআরডি উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেগুনবাড়ি খাল পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি রাজউক ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে ভবনটি ভাঙ্গার বিষয়ে নির্দেশ দেন। ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ রাজউক বিজিএমইএ ভবনের সামনের টিনশেডের অংশ ভেঙ্গে ফেলে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের অক্টোবরে ভবনটির উদ্বোধন করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ি খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরের ২৮ নবেম্বর ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে এর নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনীভাবে প্রদান করে। অথচ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না। ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নক্সা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক বলে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও ভবনটি ভাঙ্গার দাবি জানিয়ে আসছিল। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণী বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে এবং এতে এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
×