ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা

জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হলো

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৬ মার্চ ২০১৭

জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হলো

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় বলা হয়, দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি এ জঙ্গী সংগঠনটি। এ নিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা ও উগ্র ইসলামী সংগঠন হিসেবে আটটি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হলো। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করা হলে আনসার আল ইসলাম নাম নিয়ে জঙ্গী তৎপরতা শুরু করে। প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক, ব্লগার হত্যাকা-ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে এ জঙ্গী সংগঠনটি। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা নেটওয়ার্কের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ আনসার আল ইসলাম নিজেদের ওই সংগঠনের বাংলাদেশ শাখা বলে দাবি করে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আমির মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী গ্রেফতারের পর দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন। তার অবর্তমানে আনসার আল ইসলাম নাম নিয়ে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেনাবাহিনী থেকে পলাতক চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া। মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের গত ১২ ফেব্রুয়ারির এক বিজ্ঞপ্তিতে জঙ্গী সংগঠনটিকে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় বলা হয়, ‘আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গী দল/সংগঠন ঘোষিত কার্যক্রম দেশের শান্তিশৃঙ্খলা পরিপন্থী। ...সংগঠনটির কার্যক্রম জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হওয়ায় বাংলাদেশে এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামকে নিষিদ্ধ করার জন্য গত বছরের শেষের দিকে পুলিশ সদর দফতর থেকে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। ২০১৫ সালের ২৫ মে পুলিশ সদর দফতরের এক সুপারিশের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) আইনের ১৮(২) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার কারণে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করা হলে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও শান্তি দেয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ হবে। একই সঙ্গে এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মনোবলেও চিড় ধরবে। এছাড়া তাদের নতুন করে সদস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া আটকানো সহজ হবে। এ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে কেউ সাহস পাবে না। একাধিক ব্লগার হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে জঙ্গী সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কথা জানানোর প্রেক্ষাপটে গত বছরের আগস্টে এ জঙ্গী সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এ কথা বলেন তিনি। সেদিন তিনি বলেন, এক সময় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ ছিল। তারা অনলাইনে প্রচার চালাত। এই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমই পরে আনসার আল ইসলাম নামে আত্মপ্রকাশ করে। যারা বাংলা টিমের ব্যানারে কাজ করত, তারা আনসার আল ইসলামে কাজ করা শুরু করে। সংগঠনটির কাজের ধারার বর্ণনা দিয়ে মনিরুল বলেন, এ সংগঠনের শীর্ষপদের নাম সমন্বয়ক। এর তিনটি বিভাগ রয়েছে। তাদের প্রথমটি হলো দাওয়া বিভাগ। এ বিভাগে লজিস্টিক ও রিক্রুটমেন্ট দেখা হয়। দ্বিতীয়টি হলো আসকারি বিভাগ। সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তৃতীয়টি হলো গণমাধ্যম শাখা। এটি আইটি এক্সপার্টরা পরিচালনা করে থাকে। সমন্বয়কের কাজ এ তিনটি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় করা। এছাড়া ‘অপারেশন’-এর জন্য আরও দুটি বিভাগ রয়েছে জানিয়ে মনিরুল বলেন, এগুলো হলো মাশুল এবং মামুর। কোন অপারেশন পরিকল্পনা ও পরিচালনার কাজটি দেখে মাশুল বিভাগ আর অপারেশনে যারা অংশগ্রহণ করে সে সদস্যরা থাকে মামুর বিভাগের অধীনে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ করা নিয়ে এ পর্যন্ত যে সাতটি জঙ্গী সংগঠন নিষিদ্ধ করা হলো তা হচ্ছে- জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকত-উল-জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), শাহাদাৎ-ই আল হিকমা, হিযবুত তাহ্রীর ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ হয় জেএমবিসহ চারটি জঙ্গী সংগঠন। বোমা হামলা চালিয়ে বিচারক হত্যার দায়ে জেএমবির শীর্ষনেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। উগ্রপন্থা প্রচারের জন্য ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহ্রীরকে। পুলিশ ও র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যে নেতৃত্বশূন্য জঙ্গী সংগঠনগুলোর কর্মকা- কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে আবার ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতা শুরু হয়। এ জঙ্গী সংগঠনের আমির মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানী ওই মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন। তার দুই অনুসারীর মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন এবং আরও চারজনের বিভিন্ন মেয়াদের সাজার রায় এসেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের মে মাসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরাই আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরতা চালিয়ে আসছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক এখন এ সংগঠনের নেতা। তাকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়াউল হক। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা নেটওয়ার্কের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ আনসার আল ইসলাম নিজেদের ওই সংগঠনের বাংলাদেশ শাখা হিসেবে দাবি করে। একুশে বইমেলা থেকে ফেরার সময় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক লেখক অভিজিত রায়সহ বেশ কয়েকটি জঙ্গী হামলা ও হত্যার ঘটনায় এ সংগঠন জড়িত বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) কর্মকাণ্ড শুরু করে ২০০৭ সালে। গোপনে তারা জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে গেলেও ব্লগার, লেখক ও মাজারের খাদেমকে হত্যার পর এ সংগঠনের নাম প্রকাশ্যে চলে আসে। আগে এর নেতৃত্বদানকারী জসীমউদ্দীন রাহমানী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে সংগঠনের নেতৃত্বে আসেন পলাতক সৈয়দ জিয়াউল হক বা চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া। জঙ্গী সংগঠন জেএমবিকে নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে এবিটির তথ্য বেরিয়ে আসে। সেটি ২০০৮ সালের দিকের ঘটনা। ওই সময় থেকেই এর প্রধান হিসেবে ছিলেন জসীমউদ্দীন। তাকে ধরতে গোপনে ব্যাপক নজরদারি শুরু হয়। ২০১৩ সালে জসীমউদ্দীনকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য তিনি গ্রেফতার হলেও সংগঠনের কার্যক্রম থেমে নেই। গোপনে এর দায়িত্ব চলে আসে পলাতক নেতা জিয়ার হাতে। তিনিই এখন এবিটির নেতৃত্বে আছেন বলে তথ্য রয়েছে।
×