ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শহরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী উপেক্ষিত

কেউ অতি দরিদ্র থাকবে না ॥ ২০২১ সালের মধ্যে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৬ মার্চ ২০১৭

কেউ অতি দরিদ্র থাকবে না ॥ ২০২১ সালের মধ্যে

এম শাহজাহান ॥ রূপকল্প-২১ সামনে রেখে আগামী চার বছরের মধ্যে দেশের প্রায় সব গরিব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচীর আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছেÑ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। অতিদরিদ্র দূর করা এবং দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা খাত। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীকে আরও গতিশীল ও কার্যকরী করতে সামাজিক নিরাপত্তায় ১৪৫টি খাতকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতা কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী ভাতা কার্যক্রম, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি কর্মসূচী, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা কার্যক্রম, ভিজিডি কার্যক্রমে বরাদ্দ বাড়ানোর আভাস পাওয়া পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, সরকারের এসব উদ্যোগের ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চার বছরের মধ্যেই দেশ থেকে অতিদরিদ্রতা দূর হবে। এদিকে, সামাজিক খাতের সাফল্য ধরে রাখতে তিন বিষয় সামনে রেখে গণমুখী কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে সরকার। এগুলো হচ্ছেÑ দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এবং নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও এসব খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখার কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। দেশে গত ২৬ বছরে যত লোক দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে তার প্রায় ৪৫ শতাংশ ঘটেছে গত আট বছরে। এই সময়ে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ দশমিক ৩ বছর হয়েছে। এছাড়া লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমান শীর্ষে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর লক্ষ্যভিত্তিক সম্প্রসারণ দারিদ্র্য হ্রাসে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে বাজেট বরাদ্দ এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। এ প্রসঙ্গে সদ্য বিদায়ী অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, পূর্বের ধারাবাহিকতায় এবারের বাজেটেও দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এ জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত নেয়া গৃহীত কর্মসূচীগুলো এখন পুরোদমে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কৌশলের ফলে দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি মোকাবেলায় আয় হস্তান্তর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয়, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষিতে প্রণোদনা এবং ক্ষুদ্রঋণসহ আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তি প্রভৃতি কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। জানা গেছে, অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। এ কারণে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী অন্যতম দেশ হিসেবে বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় গত আট বছরে আর্থসামাজিক খাতে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, খাদ্যশস্য উৎপাদন, মূল্যস্ফীতি, আমদানি, রফতানিসহ সকল অর্থনৈতিক সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল দেশের সকল জনগণের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টিত হওয়ায় দরিদ্র জনগণের সংখ্যা দ্রুত কমছে। দারিদ্র্য বিমোচনে মানব উন্নয়ন সূচকের অগ্রগতি ॥ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ায় গত আট বছরে দেশ থেকে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্য মানুষের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সরকারের দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচী এবং পরিকল্পনার কারণে দারিদ্র্যের হার কমার পাশাপাশি বৈষম্যও কমেছে। ফলে মানব উন্নয়ন সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ। শিক্ষার সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সুযোগের সমতা সৃষ্টি হওয়ায় এখন কর্মরত শ্রম শক্তির ৩০ শতাংশের অধিক মহিলা। এছাড়া দেশের প্রায় সকল জনগণকে টিকাদান কর্মসূচি, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং স্যানিটেশন সুযোগের আওতায় আনা হয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ প্রসঙ্গে এক সেমিনারে বলেন, আগামী ২০২১ সালের পর দেশে কোনভাবেই অতি দারিদ্র্য বলে কিছু থাকবে না। আবার কিছু কিছু লোক আছেন যারা বলেন, দারিদ্র্য শূন্যের কোটায় নেমে আসবে সেটাও ঠিক নয়। তিনি বলেন, দারিদ্র্যসীমা ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এলে সেটিকে দারিদ্র্যমুক্ত বলে দাবি করা যায়। ওই হিসেবে বিশ্বের কোন দেশই একেবারে দারিদ্র্যমুক্ত নয়। তিনি বলেন, আমাদের হিসাবে ২০১৮ সাল অর্থাৎ আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশে দরিদ্রের হার নেমে আসবে ১৪ শতাংশে। তখন এটিকে দারিদ্র্যমুক্ত বলা যাবে। তবে আগামী চার বছরের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনাকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ১৪৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী ২৩টি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু এদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়া, টানাটানি, সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, অদক্ষতা, ঘুষ-দুর্নীতিসহ অব্যবস্থাপনার জন্য প্রকৃত গ্রাহকেরা এর সুফল পাচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষার জন্য নির্ধারিত ব্যয়ের ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ প্রাপকের কাছে পৌঁছায় না বলে বির্তক রয়েছে। শুধু তাই নয়, মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় সরকারের অনিয়মের কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত দরিদ্ররা এই কর্মসূচীর মধ্যে ঢুকতে পারছে না। আবার সচ্ছল মানুষও অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। তাই একজন সচ্ছল মানুষকে বের করে দিলে সেখানে একজন দরিদ্র মানুষ প্রবেশ করতে পারবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, দেশে দারিদ্র্যরেখা আয়ের নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে চার কোটি। আবার দারিদ্র্যের পর্যায়ে না থাকলেও যে কো?ন সময়ে দরিদ্র হতে পারে এমন জনসংখ্যা ধরলে দারিদ্র্যের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। যদিও সংবিধানে নাগরিকদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিনোদন এবং নিরাপত্তার অধিকার পূরণকে রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। তাই আমাদের কৌশলপত্রের লক্ষ্যই হচ্ছে দরিদ্র ও নাজুক দরিদ্রদের জন্য একটি উপযুক্ত সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীগুলো সাধারণত গ্রামাঞ্চলেই পরিচালিত হয়। অথচ শহরে উচ্চ বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ?, পানি ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন অসহায় করে তুলছে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী শহরে তেমন মনোযোগ পাচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষায় সুফল পেতে হলে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়?াতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রূপকল্প-২১ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। গত ২০০৫ সালে দেশে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ, সেখানে ২০১৩ সালে এ সংখ্যা কমে এসেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশে। একই সময়ে অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। বর্তমান এ হার ২২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আগামী ২০২১ সালের পর এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ১৩ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার সরকারী উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমান সরকারের মেয়াদে শুধু দারিদ্র্যই হ্রাস পায়নি এই সময়ে আঞ্চলিক, গ্রাম এবং শহরভিত্তিক অসমতা এবং বৈষম্যও হ্রাস পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। মূলত, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিকল্পনা করে দরিদ্রবান্ধব বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের কারণে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমেছে। একই সঙ্গে দূর হয়েছে বৈষম্যও। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গত ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দরিদ্রতা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে, যা ২০১৫ সালে করার কথা ছিল। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দরিদ্রতার হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে প্রবৃদ্ধির গড় হার ৮ শতাংশের ওপরে থাকতে হবে। ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে দরিদ্রতা কমে ০.৯৪ শতাংশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দরিদ্রতা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হলে অগ্রাধিকার নির্ণয়, অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর লক্ষ্যভিত্তিক সম্প্রসারণ দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ড চালু করা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী, কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচী, কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে দরিদ্র লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার কারণে দারিদ্র্য দ্রুত কমেছে। এছাড়া বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত আট বছরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাওয়ায় জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি বিরাজ করছে বলে দাবি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের গণমুখী কর্মকৌশলের প্রভাব শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের মধ্যে এখনও সমন্বয়ের সঙ্কট রয়েছে। সমন্বয় যদি বেশি হতো তাহলে দারিদ্র্য যতটা কমিয়ে আনা গেছে তার চেয়ে বেশি কমাতে যেত। উপরের তলার মানুষ যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে তো গড়ে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে চলে যাব। কিন্তু একেবারে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে কি না, সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। এ জন্য শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশে ব্যাপকভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
×