ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাঁচ স্তরে ঘুষ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৬ মার্চ ২০১৭

পাঁচ স্তরে ঘুষ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে অঞ্চলে অঞ্চলে ভাগ করে সুফলের পরিবর্তে সঙ্কটই বাধিয়ে ফেলেছে শিক্ষা প্রশাসন। এমপিওর সঙ্গে যেন ঘুষ, দুর্নীতিও বিকেন্দ্রীকরণ করে ফেলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি। এমপিওর কাজ হাতে পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাউশির সকল আঞ্চলিক কার্যালয়। একজন শিক্ষককে এমপিও পেতে পাঁচ স্তরে ঘুষ দিতে হচ্ছে। আগে এমপির জন্য কেবল মাউশিতে ঘুষ দেয়া লাগলেও পরিস্থিতি এখন আরও ভয়াবহ। নিয়োগের পর শিক্ষক-কর্মচারীকে ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে ফাইল পার করতে হচ্ছে স্কুল-কলেজ থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস থেকে মাউশিতে ফাইল আনতেও চলছে একই খেলা। এমপিও আঞ্চলিক কেন্দ্রের হাতে দেয়া এবং সেখানে তথ্য যাছাইয়ের কোন সুযোগ না থাকায় সঙ্কট এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে বলে বলছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। (৪ পৃষ্ঠা ১ কঃ দেখুন) পাঁচ স্তরে (প্রথম পৃষ্ঠার পর) প্রতিদিনই অভিযোগ আসছে মাউশিতে। অভিযোগ আসছে মন্ত্রণালয়ে। এমপিওর ক্ষমতা মাউশির আঞ্চলিক কেন্দ্রের হাতে দেয়ার পর প্রায় এক বছর হতে চলেছে। এই সময়ে প্রতি মাসের এমপিও প্রদানেই গুরুতর সব দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে। গত বছর মাউশির হাতে থাকা এই এমপিও নয়টি আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল ঘুষ, দুর্নীতি রোধ করা। কিন্তু এক বছরে লক্ষ্য তো পূরণ হয়নি বরং শিক্ষকদের হয়রানি কয়েকগুণ বেড়েছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একজন শিক্ষককে এমপিও পেতে ঘুষ লাগছে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর যদি কাগজপত্রে সামান্যতম কোন ঘাটতি থাকে তাহলে ঘুষের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের উপপরিচালক, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের ঘুষের প্রমাণ দিয়ে প্রতিদিনই শিক্ষকরা অভিযোগ জমা দিচ্ছেন। আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের নয়জন উপপরিচালকের (অঞ্চলের প্রধান কর্মকর্তা) মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধেই কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের অভিযোগ নিয়ে চলছে তদন্ত। দুর্নীতির মাধ্যমে এমপিও প্রদানসহ ‘সাংঘাতিক’ সব অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় আরও চারজন উপপরিচালকসহ ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে মাউশিকে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই এমপিও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন আঞ্চলিক শিক্ষা কার্যালয়ের চারজন উপপরিচালক (ডিডি), চারজন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ছয়জন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। তবে মন্ত্রণালয়ের আদেশ পেয়েও মাউশির একটি চক্র অপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গায়েব করে ফেলা হয়েছে ফাইল। যা যানেন না খোদ মহাপরিচালকও। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একজন শিক্ষককে এমপিও পেতে কমপক্ষে ৫ স্তরে ঘুষ দিতে হচ্ছে। প্রথমে স্কুল থেকে ফাইলপত্র তৈরিতে নিম্নমান সহকারীকে (কেরানি) প্রথম ঘুষ দিতে হয়। এরপর উপজেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসারকে ঘুষ দিতে হয়। টাকা দিলেই অনলাইন ফাইলে সঠিক মন্তব্য করা হয়, নয়ত নানা কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করা হয়। নতুন এমপিওর ক্ষেত্রে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে পদ সৃষ্টি করতে ঘুষ দিতে হয় কয়েক হাজার টাকা, এরপর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে অনলাইনে ভালো মন্তব্য পেতে ঘুষ দিতে হয় ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে প্যাকেজ হিসেবে দিলে প্রতিটি এমপিওর জন্য শিক্ষকদের দিতে হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আর আলাদাভাবে জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপপরিচালকে দিলে এই টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে প্রতি শিক্ষকের এমপিওতে সর্বমোট ঘুষ দিতে হয় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। তবে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসাররা প্যাকেজের বাইরে আলাদাভাবে কোন এমপিও করাতে গেলে ঘুষের ভাগও আবার উপপরিচালকে দিতে হয়। শিক্ষকদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, আগে তাদের প্রতি এমপিওতে ঘুষ দিতে হতো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এখন সেই ঘুষের পরিমাণ দুই থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও নাম, বয়সসহ নানা বিষয় সংশোধন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে থেকে ফাইল পাঠাতে ঘুষ দিতে হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা, জেলা শিক্ষা অফিসারকে দিতে হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। এসব ক্ষেত্রে মোট ঘুষ দিতে হয় ১৩ থেকে ২০ হাজার টাকা। দেশে এখন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। আর এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক কর্মচারী চাকরি করছেন। প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে যান। আর এর বিপরীতেই নতুন শিক্ষকদের এমপিও দেয়া হয়। দুই মাস পর পর দেয়া এমপিওতে সারা দেশে প্রায় আড়াই হাজার নতুন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হন। প্রতি দুই মাস পর এক থেকে দেড় হাজার শিক্ষক উচ্চতর গ্রেডসহ নানা সুবিধা পান। আর এখন এমপিও বিকেন্দ্রীকরণের ফলে সব কাজই হয় আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে। অভিযোগ উঠেছে, এমপিও দেয়ার আগ মুহূর্তে প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। ফলে দুই মাসে শুধু শিক্ষক এমপিও এবং উচ্চতর গ্রেডের ক্ষেত্রে প্রায় ১৩ কোটি টাকার ঘুষবাণিজ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ এসেছে। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ঝাপা আলিম মাদ্রাসার এক অধ্যক্ষ রবিবার মাউশির সামনে দাঁড়িয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন, অবস্থার শিকার হয়ে ঘুষ দিতে হয়। কাজটা যাতে তাড়াতাড়ি হয় এ জন্য শিক্ষকরা ঘুষ দিয়ে থাকেন। কারণ, একজন শিক্ষকের এমপিওর ফাইল যদি ছয় মাস আটকে থাকে তাহলে সে প্রায় ৯০ টাকা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে আমরা এই ঘুষ দিতে চাই না। এর প্রতিকার চাই। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার জিলবাংলা চিনি কারখানা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দুইজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন। ওই স্কুলে বিজ্ঞান ও কম্পিউটার বিষয়ের অনুমোদন না থাকার পরও সহকারী শিক্ষক মশিউর রহমান ও মো. শফিকুল ইসলাম এমপিও পেয়েছেন। জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার শেফালি মফিজ মহিলা দাখিল মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এমপিও পেয়েছেন মাহমুদা জান্নাত। অথচ তার নিবন্ধন গণিত বিষয়ের। তবে এমপিওর শর্তে উল্লেখ রয়েছে সে বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে এমপিও পাবেন সে বিষয়ে অবশ্যই তাকে নিবন্ধনভুক্ত হতে হবে। জামালপুর সদর উপজেলার জামালপুর হাইস্কুলে সহকারী গ্রন্থাগারিক হিসেবে এমপিও পেয়েছেন মাহামুদা আক্তার। তার সনদ ভুয়া হওয়া সত্ত্বেও তাকে এমপিও দেয়া হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার কামালপুর হাজী জহির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে এমপিও পেয়েছেন মোঃ এনায়েত উল্লাহ। জামালপুর সদর উপজেলার বাঁশচরা এস বি জি এম বি এল উচ্চ বিদ্যালয়েও সমাজ বিষয়ে এমপিও পেয়েছেন নাজমুল হক। অথচ এই দু’জন শিক্ষকই অতিরিক্ত শ্রেণী শাখার আওতায় দুই বছর এমপিও না পাওয়ার শর্তে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা আগেই এমপিও পেয়ে গেছেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলের আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক মোঃ আঃ মোতালেব তারই অঞ্চলের উপপরিচালক এ এস এম আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রমাণ উপস্থাপন করে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফকে দিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মাউশি। অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ বলেন, আমরা তদন্ত করছি। তবে যেসব বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে এর সবটুকুই সত্য না হলেও কিছু বিষয় সন্দেহজনক। তবে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন সময়ের প্রয়োজন। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, যারা টাকা দেয় না, উপ-পরিচালক আবদুল খালেক প্রথমে তাদের এমপিওতে নেগেটিভ কমেন্ট করে রাখেন। তারপর বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি শিক্ষকদের ফোন দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এমপিও পজিটিভ করে দিচ্ছেন। আমার স্কুলেরই সহকারী প্রধান শিক্ষকদের এমপিও তিনি বিনা কারণে রিজেক্ট করেছেন। ভুয়া সার্টিফিকেটও তিনি টাকার বিনিময়ে সঠিক করে দিচ্ছেন। আমাদের কাছে আবদুল খালেকের কাছে টাকা লেনদেনের অডিও রেকর্ডও রয়েছে। যা ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। কয়েক মাসের এমপিওগুলো যাচাই করলে আরও বেশি প্রমাণ পাওয়া যাবে। উপ-পরিচালক আবদুল খালেক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মহল অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি কারও কাছ থেকে কোন প্রকার টাকাপয়সা নেইনি। নিয়মানুযায়ী যাদের এমপিও পাওয়ার কথা তাদেরই এমপিও দেয়া হয়েছে। তবে যেহেতু তদন্ত চলছে তাই রিপোর্ট না করার জন্য আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার তো তদন্ত করছেই। তাহলে কেন রিপোর্ট করবেন? মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কাজীপুর মাথাভাঙ্গা নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে নিয়ম ভেঙ্গে ইতোমধ্যেই ১৩ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হয়েছেন। অথচ একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ পাঁচজন শিক্ষক ও দুইজন কর্মচারীর এমপিওভুক্তির বিধান রয়েছে। এই ১৩ জনের এমপিওভুক্তিতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে বলে উপ-পরিচালক টি এম জাকির হোসেন বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে। স্কুলটিতে অতিরিক্ত শ্রেণী শাখা খোলার ভুয়া কাগজ দেখিয়ে এই অতিরিক্ত শিক্ষককে এমপিও দেয়া হয়েছে। দেখানো হয়েছে ২০০২ সালে অতিরিক্ত শ্রেণী শাখা খোলার অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এরপর ২০০৫ সালে দেয় যশোর বোর্ড। অথচ আগে দেয়ার কথা বোর্ডের এরপর মন্ত্রণালয়ের। প্রতিটি ক্লাসেই তিনটি সেকশন দেখানো হয়েছে। অথচ এই স্কুলে মাউশি খোঁজ নিয়ে জেনেছে তাদের একটি সেকশনের শিক্ষার্থীই নেই। তাই টি এম জাকির হোসেনের বিরুদ্ধেও তদন্ত করছে মাউশি। ঘুষ বাণিজ্যে অতিষ্ঠ হয়ে খুলনার আঞ্চলিক কার্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যশোর জেলার ২০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান। যশোর জেলার শিক্ষা অফিসগুলোতে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ দেয়া স্বাক্ষরকারী ২০ প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑ রায়পুর স্কুল এ্যান্ড কলেজ, নাভারন কলেজ, হামিদপুর আল-হেরা ডিগ্রী কলেজ, রঘুনাথ নগর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা ডিগ্রী কলেজ, এবিসিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাকিমপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, মাটশিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নেংগুড়াহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খেদাপাড়া পল্লী মঙ্গল বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তপসীডাঙ্গা আলিম মাদ্রাসা, ঝাপা আলিম মাদ্রাসা, ওয়াদীপুর আলিম মাদ্রাসা, কালারহাট আলিম মাদ্রাসা, কৌটা ফাজিল ডিগ্রী কলেজ, কায়েমকোলা নেছারিয়া দাখিল মাদ্রাসা, ছাতিয়ানতলা দাখিল মাদ্রাসা, বালিয়াডাঙ্গা দাখিল মাদ্রাসা, নওয়ালী কাঁঠালতলা মাদ্রাসা ও বাগডোর দাখিল মাদ্রাসা। ওই শিক্ষকরা বলেছেন, ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়েই এমপিও পাওয়া যায়। উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক কার্যালয় এই তিন জায়গায় ঘুষ না দিলে এমপিও পাওয়া যায় না। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করেও এমপিও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এই এমপিও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১৪ জন কর্মকর্তা। ২০১১ সালের ১৩ নবেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত শ্রেণী শাখার বিপরীতে নিয়োগ দেয়া শিক্ষকদের বেতনভাতা প্রতিষ্ঠানের বহন করতে হবে বলে জানানো হয়। তাদের কোনভাবেই এমপিওভুক্ত করা যাবে না বলে পরিপত্রে বলা হয়। কিন্তু সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে বেশকিছু অতিরিক্ত শ্রেণী শাখার শিক্ষককে এমপিওভুক্তির প্রমাণ পায় মন্ত্রণালয়। যার ফলে এই এমপিওকরণের সঙ্গে জড়িত সকল কর্মকর্তাদের ব্যাপারে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরকে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুসরাত জাবীন বানু স্বাক্ষরিত এক পত্রে বলা হয়, অতিরিক্ত শ্রেণী শাখার বিপরীতে ২০১১ সালের ১৩ নবেম্বরের পরে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের এমপিও বাতিল ও এমপিওকরণের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এদিকে গত দুই মাস ধরে এমপিও জালিয়াতির সঙ্গে ১৪ জন কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হলেও মাউশি অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। অতিরিক্ত শ্রেণী শাখার বিপরীতে এমপিও দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলেও এ সংক্রান্ত ফাইল অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হচ্ছে না। এমনকি মন্ত্রণালয় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও তা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন এবং ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বীমা বিষয়ের শিক্ষককে জালিয়াতি করে এমপিওভুক্তির প্রমাণ মিলেছে। এদিকে জানা গেছে, নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে সকল এমপিও বিকেন্দ্রীকরণের সময় মন্ত্রণালয় তাদের একটি চিঠিতে এমপিও বিকেন্দ্রীকরণের জন্য নির্দেশ দিলেও প্রথমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এবং ২০১৮ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে এমপিও বিকেন্দ্রীকরণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না মেনে একযোগে সব আঞ্চলিক কার্যালয়েই এমপিও বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। কিন্তু আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে দক্ষ লোকবল না থাকায় শিক্ষকরা নানা কাজে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে সম্প্রতি একজন পরিচালকের পদ সৃষ্টি করে পদায়ন করা হলেও এমপিও সকল দায়িত্বই রেখে দেয়া হয়েছে উপ-পরিচালকদের হাতে। ফলে এসব উপ-পরিচালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালকরাই শিক্ষকদের এমপিও চূড়ান্ত করেন। অভিযোগ কেবল ঢাকার বাইরের জেলায় নয়। খোদ ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক গৌর চন্দ্র ম-ল এবং সিলেটের উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর কবির আহমেদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগে তদন্ত করছে মাউশি অধিদফতর। ঢাকার উপ-পরিচালক গৌর চন্দ্র ম-লের বিরুদ্ধে দুই শতাধিক অযোগ্য ব্যক্তির এমপিও দিয়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয়ের অভিযোগ এসেছে। এ অভিযোগ করেছেন তার অফিসেরই এক কর্মচারী। তথ্যপ্রমাণসহ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জমা দেয়ার পর মন্ত্রীর নির্দেশে শুরু হয় তদন্ত। যদিও উপ-পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেছেন, যাদের অযোগ্য বলা হচ্ছেÑ তারা হয়তো এক সময় অযোগ্য ছিল। যোগ্যতার অভাব ছিল। তাই মাউশি তখন এমপিও দেয়নি। এরপর তারা যোগ্যতা অর্জন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলছিলেন, আমরাও শিক্ষক এমপিওতে দুর্নীতির বিষয়ে প্রচুর অভিযোগ পাচ্ছি। আসলে বিকেন্দ্রীকরণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও ছড়িয়ে পড়েছে। এর অর্থ এই নয় যে কেন্দ্রে দুর্নীতি ছিল না। তবে আমরা ঘুষ গ্রহণের জেনুইন ক্লু চাই। যাতে আমরা ধরতে পারি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই যারা ঘুষ দেন তারা প্রকাশ্যে আসতে চান না। যা একটি বড় সমস্যা। এরপরও আমরা অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করি। মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, অনেক অভিযোগ আসছে। তবে শিক্ষকদের বলব, তারা ঘুষ দেয় কেন? যদি কোন কাগজে সমস্যা থাকে তাহলে তারা সেটা ঠিক করে দিক। তবে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি অন্যায়ভাবে, অনৈতিকভাবে কারও কাছ থেকে ঘুষ নেয় তাহলে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। ইতোমধ্যে এসব বিষয়ে তদন্তও চলছে। আর কোন শিক্ষক যদি একবার এমপিও মিস করে তাহলে তিনি দুই মাসের প্রাপ্য বেতন থেকে বঞ্চিত হন, এটাও কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে। আসলে সমস্যা অন্য জায়গায়। দেখা যায়, সার্টিফিকেটে সমস্যা আছে, অন্য সমস্যা আছে সেগুলোই টাকা দিয়ে রফাদফা হয়। তবে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ২০১১ সালের পরিপত্রের পর অতিরিক্ত শ্রেণী শাখার বিপরীতে যাদের এমপিও দেয়া হয়েছে তা ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে। তবে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ফাইলটি এখনও আমার হাতে এসে পৌঁছেনি। আমি দ্রুতই এ সংক্রান্ত ফাইলটির খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
×