ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করছে সরকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৬ মার্চ ২০১৭

ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করছে সরকার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। উল্টো প্রতি মাসেই আগের নেয়া ঋণ শোধ করে চলেছে সরকার। এতে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি এ সাত মাসে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক (-) ২০ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণও শোধ করেছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সঞ্চয়পত্র খাত থেকে অস্বাভাবিক ঋণ পাওয়ায় সরকারের ব্যাংকঋণের প্রয়োজন হচ্ছে না। তাছাড়া এ সময়ে রাজস্ব আদায়ের গতি ভাল রয়েছে। অন্যদিকে, সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ে ধীরগতি বিরাজ করায় খরচও কম হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সে হিসাবে প্রতি মাসে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ করলে বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় ঋণপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। কারণ তখন ঋণের সুদহার বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। যদিও গত কয়েক বছর ধরেই এ খাতে উল্টোচিত্র দেখা যাচ্ছে। সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ করছে কম। চলতি অর্থবছরেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এদিকে, বিনিয়োগে কাক্সিক্ষত গতি না আসায় বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য জমা পড়েছে। এতে ঋণের সুদহারও নিম্নমুখী রয়েছে। বর্তমানে তা এক অঙ্কের ঘরে নেমেছে, যা বেসরকারী খাতের জন্য স্বস্তিদায়ক। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি এ সাত মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৩২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে খরচ হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের এ সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ২৮ শতাংশ। খরচ হয় ২৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় পরিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে। আর ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি গিয়ে ঠেকে ২৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা, যা পুরো অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বেশি। গেল অর্থবছরে এ খাতে নিট বিনিয়োগ এসেছিল ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। মূলত শেয়ারবাজারের দীর্ঘ মন্দা ও ব্যাংক আমানতের সুদহার ক্রমাগত কমতে থাকায় সাধারণ মানুষের সঞ্চয়পত্রে টাকা খাটানোর প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। ফলে তারা আমানতের সুদ কমিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে, পুঁজিবাজারের অবস্থাও তেমন ভাল যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে সঞ্চয়পত্রকে এখন অনেক বেশি লাভজনক মনে করছে। এতে বিক্রি বাড়ছে সঞ্চয়পত্রের। ফলে বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা কমছে। বাজেট ঘাটতি পূরণে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নেয়া হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত সরকারের মোট ব্যাংকঋণের স্থিতি ছিল এক লাখ আট হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যাংকঋণের মোট স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা। ফলে এ সময়ে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক (-) ১৮ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গেল অর্থবছরের জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের ব্যাংকঋণের মোট স্থিতি ছিল ২১ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা ৯ ফেব্রুয়ারি শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার কোন ঋণই করেনি। উল্টো আগের নেয়া ঋণের প্রায় ১১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা শোধ করেছে। অন্যদিকে, গেল অর্থবছরের জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৮৬ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা, যা ৯ ফেব্রুয়ারি শেষে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৯ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেও কোন ঋণ করেনি সরকার। উল্টো আগের নেয়া ঋণের ৬ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা শোধ করেছে সরকার। বাজেট ঘাটতি পূরণে বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল সরকার। তবে বছরের বেশিরভাগ সময়েই সরকারের ঋণের চাহিদা কম ছিল। ফলে পুরো অর্থবছরের সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়ায় মাত্র চার হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। বৈদেশিক সহায়তা ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পাওয়াই ছিল এর অন্যতম কারণ।
×