ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়॥ সমাবর্তনে প্রাণের উচ্ছ্বাস

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৫ মার্চ ২০১৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়॥ সমাবর্তনে প্রাণের উচ্ছ্বাস

কালো গাউন পরে আর মাথায় ক্যাপ দিয়ে টিএসসিতে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একদল শিক্ষার্থী। ফটোগ্রাফার ওয়ান-টু-থ্রি বলার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ক্যাপ খুলে সবাই একযোগে আকাশের দিকে ছুড়ে মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস আর ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ। এভাবেই বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে ছবি তুলছেন শিক্ষার্থীরা। শনিবার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তন উপলক্ষে খুশির আমেজ ছেয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে পুরো ক্যাম্পাসে। বহু আকাক্সিক্ষত এই সমাবর্তন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে মুখরিত করে তুলে সমাবর্তন প্রার্থীরা। সকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। রৌদ্রময় হাসিতে হাসি-গান-আড্ডায় আর পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করে আনন্দে মেতে ওঠেন। সহপাঠীদের সঙ্গে গল্প, আড্ডা আর গানে ফিরে গেলেন ক্যাম্পাস জীবনে সেই সোনালী দিনগুলোতে। শিক্ষার্থীদের মনে এমনই বাঁধভাঙ্গা উল্লাস দেখা গেছে। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ফেলেছেন এই শিক্ষার্থীরা। মাত্র কিছুদিন আগেই যেন এসেছেন ক্যাম্পাসে। এখনও তাদের মনে পড়ে তারুণ্যে ভরা উল্লাসে ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়ানোর মুহূর্তগুলো। মনে পড়ে টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, হাকিম চত্বর, কার্জন হল, পলাশীর মোড়ের কাটানো হাসি, গান আর আড্ডার সোনালী সময়গুলো। মনে পড়ে হলজীবনের সেই গণরুমের কথা যেখানে একরুমে ত্রিশজন বন্ধু একসঙ্গে গাইত গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান...। সমাবর্তনে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ হয় অনেকের। এরপরেও কর্মজীবনে পৌঁছালে হয়ত আর দেখা হবে না বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশে থাকা মানুষগুলোকে। তাই সমাবর্তন বন্ধুদের কাছে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থেকে যায় না পাওয়ার বেদনা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের বৃহৎ এই সমাবর্তনে ১৭ হাজার ৮শ’ ৭৫ জন গ্র্যাজুয়েট অংশগ্রহণ করেন। এর আগে এত বেশি সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট অংশগ্রহণ করেননি বলে জানিয়েছেন বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। সমাবর্তনে অংশ নেয়া গ্র্যাজুয়েটরা গত তিনদিন ধরে বিশ^বিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা, কার্জন হল, সিনেট ভবন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, মল চত্বরসহ ক্যাম্পাসের উল্লেখযোগ্য স্থানে ছবি তোলা আর হৈ-হুল্লোড় করে বেড়িয়েছেন। সহপাঠী আর বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা ক্যাম্পাস। শুক্রবার বিকালে বন্ধুদের নিয়ে ছবি তুলতে থাকা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদ উদ্দীন বলেন, বিশ^বিদ্যালয়ের জীবনে সমাবর্তন অন্যরকম একটা পাওয়া। ভার্সিটি লাইফের এটা বড় স্মৃতি হয়ে থাকবে। নিঃসন্দেহে এটা ভাল লাগার বিষয়। সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও বাইরের দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিরা বক্তব্য দেন। এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। এই মুহূর্ত টালাইফে আর কখনও ফিরে আসবে না। এটা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি হিসেবে মনে করছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মুজাহিদ বলেন, সমাবর্তন তো আসলে প্রতি বছর হয় না। তারপর আবার ৫০তম সমাবর্তন। এ জন্য আমরা একটু বেশিই উত্তেজিত। গত তিনদিনে গ্রুপ এবং ব্যক্তিগতভাবে তিন হাজারের বেশি ছবি উঠিয়েছেন বলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আফরা বলেন, চার বছরের এটাই শ্রেষ্ঠ পাওয়া। ভার্সিটি লাইফের এটা বড় স্মৃতি হয়ে থাকবে। এখন আমরা নিজেদের বলতে পারব অফিসিয়ালি গ্র্যাজুয়েট। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে স্ত্রী ও তিন বছরের পুত্র মুহতাসিমকে নিয়ে সমাবর্তনে অংশ নিতে আসা ডাঃ মুহিবুল্লাহ বলেন, কারও কারও কাছে মনে হয় সমাবর্তন ছবি তোলা ছাড়া আর কিছুই না। তবে এই মুহূর্তটা লাইফে আর কখনও ফিরে আসবে না। ডাঃ মুহিবুল্লাহর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগের রমিজুল ইসলাম বলেন, সমাবর্তন হলো আনুষ্ঠানিকভাবে সার্টিফিকেট হস্তান্তর। নিঃসন্দেহে এটা সকলের ভাল লাগা উচিত। এদিকে সমাবর্তন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে তৈরি করা হয় বিশাল প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের ভেতরে স্থান পায় ২০ হাজারের অধিক চেয়ার। মাঠের গ্যালারিতেও রয়েছে ১ হাজারের অধিক সিট। প্যান্ডেলের ভেতর পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ৮০জন কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে ৯৪টি স্বর্ণপদক, ৬১জনকে পিএইচডি এবং ৪৩জনকে এমফিল ডিগ্রী প্রদান করা হয়। সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করেন রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন কানাডার ওয়েস্টার্ন ওন্টারিও ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. অমিত চাকমা। অনুষ্ঠানে তাকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রী প্রদান করা হয়। অমিত চাকমা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন বিশিষ্ট রাসায়নিক প্রকৌশলী। তার জন্ম ১৯৫৯ সালে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে। এছাড়া ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও দেশ-বিদেশ থেকে আগত অতিথিবৃন্দ। সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একই সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছে রোভার স্কাউট গ্রুপ, রেঞ্জার গ্রুপ এবং বিএনসিসি। ১৯২৩ সালে শুরুু হওয়া ধারাবাহিকতায় এবারে আয়োজিত হয় ৫০তম সমাবর্তন। গত বারের চেয়ে এ বছর ডিগ্রীধারীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। গত ৪৯তম সমাবর্তনে ছয় হাজার ১০৪ জনকে ডিগ্রী প্রদান করা হলেও এ বছর ডিগ্রী পায় ১৭ হাজার ৮৭৫ জন গ্র্যাজুয়েট। গতবারের চেয়ে এ বছর ডিগ্রীধারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। বেড়েছে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। গত সমাবর্তনে ২৯ স্বর্ণপদক প্রদান করা হলেও এ বছর ৯৪টি স্বর্ণপদক পায় ৮০ শিক্ষার্থী। বেড়েছে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রীধারীর সংখ্যা। গত ৪৯তম সমাবর্তনে ২০ জনকে এমফিল এবং ৪২ জন কেপিএইচডি ডিগ্রী প্রদান করা হলেও এ বছর এমফিল ডিগ্রীধারী ৪৩ এবং পিএইচডিধারী শিক্ষার্থী ৬১ জন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সমাবর্তন দিনটি শিক্ষার্থীদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনটির জন্য শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা একাডেমিক সার্টিফিকেট ও পদক গ্রহণ করে থাকেন। স্বাধীনতা-পূর্ব ও উত্তরকালে দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। বর্তমানে আবার সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এ সংস্কৃতি ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।
×