ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ॥ কঠিন শাস্তির তাগিদ

দুই মাসে ৭৪১ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৫ মার্চ ২০১৭

দুই মাসে ৭৪১ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ নারী নির্যাতনের চিত্র দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। নির্যাতনের মাত্রায় যোগ হয়েছে নতুন কৌশল। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে চলতি বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ৭৪১ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৭৬ এবং জানুয়ারিতে মাসে ৩৬৫ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য পাওয়া গেছে। দিন দিন নারী নির্যাতনের ভয়াল চিত্রে উদ্বিগ্ন নারীনেত্রী ও বিশেষজ্ঞরা। কঠোর আইনী শাস্তিই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে পারে বলে মন্তব্য তাদের। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৯। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ১৩ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে চার জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৬ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে আটজন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ জন। এ্যাসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে চারজন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে একজনের ও অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে নয় জন। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ জনের। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট সাতটি। নারী ও কন্যাশিশু পাচারের শিকার হয়েছে তিনজন । এর মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে একজনকে। বিভিন্ন কারণে ৫৯ নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৩০ জন, তার মধ্যে হত্যা করা হয়েছে সাত জনকে। দুজন গৃহপরিচারিকা হত্যার শিকার হয়েছে। উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ৩০ জনকে। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে দুজন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ২৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং ৮ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ২০টি, তার মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে পাঁচজন এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে ১৫টি। ৭২ শিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ৩৬ জনকে। পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছে একজন। বেআইনী ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে চারটি। এছাড়া অন্যরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার । ফেব্রুয়ারি মাসের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নারী নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার মঙ্গলসিদ্ধ গ্রামে মেয়েকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বখাটে কর্তৃক ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ও তার মা গুরুতর আহত হয়। এ ঘটনায় এখনও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়নি। এছাড়া, ৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলায় প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় বখাটে কর্তৃক কমনরুমে ঢুকে কলেজ ছাত্রীকে মারধর এবং নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায় প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় স্কুলছাত্রীকে ব্লেড দিয়ে জখমের ঘটনা ঘটে। নারী নির্যাতনের বর্তমান সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে আক্ষেপ করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ) নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, বিচারহীনতা নারী নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র আরও ভয়াবহ করে তুলছে। অপরাধীর মধ্যে ভয় কাজ করছে না। রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহার আর শক্তিশালী জনশক্তির আশ্রয়ে অপরাধীরা ঘাপটি মেরে থাকছে। যতদিন না নারীবান্ধব পরিবেশ ঘরে-বাইরে নিশ্চিত হচ্ছে এবং অপরাধীকে শাস্তির আওতায় না আনা হচ্ছে ততদিন নারী নির্যাতনের চিত্র অপরিবর্তিত থাকবে। যতই বলা হোক নারী ও পুরুষের সমান অধিকার। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চলতে গিয়ে এখনও নারী হোঁচট খেয়ে পড়ছে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব, পয়লা বৈশাখের নারী নির্যাতনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার এখনও তারা পায়নি। কিন্তু সবাই ভিডিও ফুটেজে দেখেছে অপরাধীদের চেহারা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বর্তমান সরকার বিভিন্ন আইন তৈরি করেছে। আমরা সেসব আইন তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছি। যৌন নির্যাতনের তিনটি মামলা করেছি হাইকোর্টে। আমরা নারী নেত্রীরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিচার আদায়ে কাজ করে চলেছি। কিন্তু প্রতিটি ঘটনাতেই অপরাধীরা আইনী শাস্তি পাচ্ছে না। এ দায় আমাদের, আমাদের রাষ্ট্রের। অন্যদিকে, চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৬ টি। তার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ১৪ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে চার জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২ জনকে। এ মাসে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে চার জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে পাঁচ জন। এ্যাসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে তিন জন ও অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে পাঁচ জন । তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে একজনের। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট আটটি। নারী ও কন্যাশিশু পাচারের শিকার হয়েছে নয় জন। তার মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে দুই জনকে। বিভিন্ন কারণে ৬৩ নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৩১ জন, তার মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার একজন। উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ২৩ জনকে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ৩৩ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং নয় জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ২২টি, তার মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার ১২ জন এবং বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে দশটি। ৩১ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ২১ জনকে। পুলিশী নির্যাতনের শিকার চার জন। বেআইনী ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে দুটি। এছাড়াও নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে অনেকে। ৩০ জানুয়ারি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রলুব্ধ করে বখাটে কর্তৃক দশম শ্রেণীর ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাটি। এছাড়া, ২৪ জানুয়ারি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায় ঢাকার উদ্দেশে চুয়াডাঙ্গা থেকে ছেড়ে আসা রয়াল পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে বাসের ড্রাই্ভার ও হেলপার কর্তৃক তরুণীকে যৌন হয়রানির ঘটনাটি। ২০ জানুয়ারি সে নির্যাতনের শিকার হয়। এ ঘটনায় ভোরে গাড়ি গাবতলী টার্মিনালে থামলে তরুণী দারুসসালাম থানায় হাজির হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। কিন্তু অপরাধীরা এখনও সাজা পায়নি। নারী নির্যাতনের লাগামহীন ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, নারী নির্যাতনের এই ভয়াল চিত্র বাড়ছে, আরও বাড়বে যতদিন না অপরাধী কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি না পাচ্ছে। আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। বছরের পর বছর এই ধরনের কর্মকা- হাতের নাগালেই ঘটে যাচ্ছে কিন্তু আমরা দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। সরকার ও প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে শিশু নির্যাতন রুখতে। মাত্র দু’একটি মামলায় আমরা প্রশাসনের অগ্রগতি দেখছি। কিন্তু অনেক অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না। এছাড়া এলাকাভিত্তিক সচেতনতাও দরকার এ ধরনের কর্মকা- এড়াতে। বিগত দু’দশকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে। সঙ্গে সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগ। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্পষ্টত নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বেড়েছে। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
×