ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আল্লাহর কী লীলা বুঝলাম না-সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৫ মার্চ ২০১৭

আল্লাহর কী লীলা বুঝলাম না-সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাস্যরসাত্মক মন্তব্য করে সবাইকে প্রাণবন্ত রাখেন রাাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। প্রায়ই স্বভাবসুলভ হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি আনন্দে ভাসিয়ে রাখেন শিক্ষার্থীসহ অনুষ্ঠানে আগতদের। শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বললেন, ‘আল্লাহর কী লীলা খেলা বুঝলাম না, যেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইতেই পারলাম না, সেইখানে আমি চ্যান্সেলর হইয়া আসছি। বাংলাদেশে যতগুলি পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সবগুলির আমি চ্যান্সেলর। প্রায়ই সমাবর্তনে যেতে হয়। দেড়-দুইঘণ্টা ক্যাপ-গাউন পরে থাকতে হয়। আর এর মধ্যে বাতাসই ঢুকতে পারে না। গরম যখন থাকে তখন অবস্থা কাহিল।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফর্ম না পাওয়ার আক্ষেপের কথা এভাবেই বলছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সমাবর্তনে লিখিত বক্তব্যের বাইরে গিয়ে কথা বলেন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মোঃ আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি তার বক্তৃতার শুরুতে বলেন, যাদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছি তাদের আমি দেখতে পাচ্ছি না। বক্তা যখন বক্তব্য দেয় তখন অডিয়েন্সের চেহারা দেখে বোঝা যায় তারা বক্তব্য গ্রহণ করছে নাকি রিজেক্ট করছে। এখানে কিছুই আমি দেখি না। এত বেশি ফ্লাডলাইট এখানে (স্টেজে) দেয়া হয়েছে...বেশি বেশি লাগে। এটা আলো আর আঁধারের একটা খেলা। লিখিত বক্তব্যের বাইরে কথা বলতে গিয়েই আনন্দে মাতিয়ে রাখেন তিনি। বলেন, আমি লিখিত বক্তব্যের বাইরে কিছু বলতে চাই। এর পরই তিনি বলেন, ‘নিজের কাছেই অবাক লাগে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। আমি ম্যাট্রিক থার্ড ডিভিশন। আইএ পাস করছি এক সাবজেক্ট খারাপ করে। লজিকে রেফার্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আসলাম ভর্তি হওয়ার জন্য। তখন ভর্তি তো দূরের কথা, ভর্তির ফর্মটাও আমি পাই নাই। বন্ধু-বান্ধব অনেকে ভর্তি হইল, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তখন আমি যুক্ত। ভর্তি যখন হইতে পারলাম না, তখন দয়ালগুরুর কৃপায় গুরুদয়াল কলেজে (কিশোরগঞ্জে) ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম।’ রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই সমাবর্তনস্থলে হাসির রোল পড়ে। সমাবর্তন স্থলে ওঠে হর্ষধ্বনি। আবদুল হামিদ বলেন, ‘বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ করতাম। প্রায়ই ঢাকা আসতে হতো। বিভিন্ন হলে থাকতাম। এমন কোন হল নাই তখনকার সময়ে যেখানে ঢুকি নাই। অবশ্য রোকেয়া হলে ঢুকি নাই। তবে রোকেয়া হলের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলাম। বন্ধু-বান্ধব যারা পড়ত তারা কনভোকেশন ক্যাপ-গাউন পরত। আমাদের কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। তবে সমাবর্তনে আমাদের ডাকা হতো না। যারা অনার্স-মাস্টার্সে ছিল, তাদের ডাকা হতো। কনভোকেশনে ক্যাপ-গাউন পরার খায়েশ ছিল।’ এ বক্তব্যে আবারও হাসির রোল পড়ে সমাবর্তনে। এর পরই চ্যান্সেলর বলেন, ‘কিন্তু আল্লাহর কী লীলা খেলা বুঝলাম না, যেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হইতে পারলাম না, সেইখানে আমি চ্যান্সেলর হইয়া আসছি। বাংলাদেশে যতগুলি পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সবগুলির আমি চ্যান্সেলর।’ এ সময় সমাবর্তন জুড়ে শিক্ষার্থীদের হর্ষধ্বনির মধ্যেই উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে শীতের সময় সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজন করার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। পরে নিজের ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান সময়ের রাজনীতির হালচাল নিয়েও কথা বলেন রাষ্ট্রপতি। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি ছাত্র রাজনীতি করছি। মহকুমার ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম। কলেজের ভিপি-জিএস ছিলাম। তখন ছাত্রদের সাথে আমরা এমনভাবে চলছি...ভালভাবে চলছি যাতে তারা আমাকে ভোট দেয়। ...যারা ভর্তি হতে আসত তাদের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে, তাদের ফরমও ফিলাপ করে দিতাম। এখন কী হইছে বুঝি না।’ আমার নিজের কথা কি বলব, ‘ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়াই, বিয়া একখান কইরা ফালাইছি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র সংগঠনের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির বয়স ৪৫-৫০ বছর। এই যদি বয়স হয়। ২৫-২৬ বছর বিয়ার বয়স ধরা হয়। ২৫ বছরে কেউ যদি বিয়া করে, তাহলে ৫০ বছর বয়সে তার এক সন্তানেরই তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা। বাপ-পুত মিলাই ইউনিভার্সিটিতে থাকার কথা। বাপ নেতা আর ছেলে ছাত্র। এটা হইতে পারে না।’ এরপর তিনি ছাত্র রাজনীতি ও ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন। বলেন, ‘এই ছাত্র রাজনীতি যারা করে, তাদের রেগুলার ছাত্র হতে হবে। ৫০ বছর বয়সে যদি নেতৃত্ব দেয়, তাহলে যারা পড়ে তাদের সঙ্গে এডজাস্টমেন্ট হবে না। সুতরাং ডাকসু নির্বাচন ইজ অ্যা মাস্ট। নির্বাচন না হলে তাহলে ভবিষ্যত নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’ রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের বেশি বয়সে বিয়ে করা নিয়েও আনন্দে মাতিয়ে রাখেন মোঃ আবদুল হামিদ। বলেন, ‘এখন বলতে পারেন, কিছুদিন আগে রেলমন্ত্রী বিয়া করছেন। একথা বলে নিজেই হেসে ফেলেন রাষ্ট্রপতি। এটা রেয়ার কেস। অসময়ের কিছু সবসময় ভাল হয় না। মৌসুমের কাঁঠাল যে মজা লাগে পরের কাঁঠাল এত মজা লাগে না।’ নিজের ডিগ্রী পাস করার সময় বেশি লাগার কথাও তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই। তিনি বলেন, ‘ছাত্র খারাপ ছিলাম ঠিকই। বিএ পরীক্ষার সময় দুইবার জেলে ছিলাম। পরীক্ষা দিতে পারি নাই। বাড়ির লোকজন কথা বলে। চিন্তা করলাম আইয়ুব খান-মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে। কিশোরগঞ্জে বিরাট জনসভা। বললাম, ভাইসব যতদিন আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে যাবে না ততদিন পর্যন্ত আমি বিএস পাস করতে চাই না।’ রাষ্ট্রপতির একের পর এক বক্তব্যে সমাবর্তনজুড়ে হাসিল রোল পড়লেও তিনি এ সময় বলেন, আজকে একটু গলা বসে গেছে না হলে আরও কিছু বলতাম। এ সময় সমাবর্তনে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা উচ্চৈস্বরে ‘আরও বলেন, আরও বলেন দাবি তোলেন।’ উত্তরে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘লিখিত বক্তব্য আছে। আসলে মনের কথা লেখা। আমরা প্রেমপত্র লিখতাম। তখন বিভিন্ন বই থেকে দেইখা কোটেশন তুইলা। এখন প্রেমপত্রও লেখা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মেসেজ। প্রেমপত্র লেখাও সাহিত্য।’ এরপর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আবার লিখিত বক্তব্যে চলে যান। ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের বর্তমান আস্থাহীনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তা কাটিয়ে ওঠার ওপর জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, আমাদের সময়ের রাজনীতি আর আজকের ছাত্র রাজনীতির মধ্যে তফাৎ অনেক বেশি। ষাটের দশকে আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল দেশ-জাতির কল্যাণ। দেশের মানুষকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের কোন স্থান ছিল না। ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত, নেতৃত্ব দিত। লেজুড়বৃত্তি বা পরনির্ভরতার কোন জায়গা ছিল না। সাধারণ মানুষ ছাত্রদের সম্মানের চোখে দেখত। ছাত্র রাজনীতির বর্তমান হালচাল দেখে মনে হয় এখানে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের প্রাধান্য বেশি। কিছু ক্ষেত্রে অছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়, নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের, এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা, সমর্থন ও সম্মান হ্রাস পাচ্ছে। এটি একটি দেশ ও জাতির জন্য শুভ নয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতির সূতিকাগার অভিহিত করে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বরেণ্য রাজনীতিবিদের জন্ম দিয়েছে। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এখনও পথপ্রদর্শক হিসেবে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যে কোন অন্যায়, অবিচার ও অপশাসনের প্রতিবাদে এবং আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকি মোকাবেলায় এ দেশের ছাত্রসমাজ বার বার এগিয়ে এসেছে। এজন্য অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। জেল-জুলুম ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তারুণ্যের জোয়ার কখনও থেমে থাকেনি এবং ভবিষ্যতেও থেমে থাকবে না। সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয়ী হলেও পঁচাত্তরের হত্যাযজ্ঞের ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির লড়াই, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়া, শুভ ও অশুভ এবং ধর্মপরায়ণতা ও ধর্মান্ধতার লড়াই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে শেষ হয়ে যায়নি। আজকের লড়াইয়ে শুভশক্তি জয়ী না হলে রাষ্ট্র হিসেবে, জাতি হিসেবে আমরা আবার পিছিয়ে যাব। মুখ থুবড়ে পড়বে আমাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির চাকা।
×