ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১৩ স্পটে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাজার হাজার মানুষের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ

এবার বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে ২৮ কিমি জুড়ে মানববন্ধন

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৪ মার্চ ২০১৭

এবার বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে ২৮ কিমি জুড়ে মানববন্ধন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবার বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে নদী পাড়ে ২৮ কিলোমিটার এলাকজুড়ে মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছেন হাজারো মানুষ। পাগলা এলাকা থেকে বছিলা পর্যন্ত নদীর ১৩টি স্পটে দাঁড়িয়ে তারা কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে নদী বাঁচানোর আওয়াজ তোলেন। এতে অংশ নেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, নদী পাড়ের মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। তারা একই কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন, রাজধানীবাসীর বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই বুড়িঙ্গাকে বাঁচাতে হবে। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জড়িয়ে রয়েছে। তাই এই নদী রক্ষায় সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তা না করা হলে ঢাকা তথা দেশের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাবে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত নদীর বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত মানববন্ধন অনুষ্ঠান থেকে তারা নদী বাঁচাতে একই দাবি উত্থাপন করেন। মানববন্ধনের এলাকাবাসীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিতে দেখা যায়। তারা বলেন, বুড়িগঙ্গা দূষণ আজ নদী পাড়ে ও রাজধানীর বসবাসকারীদের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি। কর্তৃপক্ষে অবহেলা ও নজরদারির অভাবে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা আজ মরতে বসেছে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া না গেলে রাজধানীর ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে দাঁড়াবে। এ সময় তারা দাবি তোলেন নদী বাঁচাতে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তার আলোকেই নদী বাঁচাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। বুড়িগঙ্গার দূষণ-দখল রোধ, নাব্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা কর ঃ দাবিতে পাগলা থেকে বছিলা পর্যন্ত ১৩টি নির্ধারিত স্থানে বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশ নেয় হাজারো জনতা। সদরঘাট, শ্যামবাজার (লালকুঠি) ঘাট, শহীদ বুদ্ধিজীবী ব্রিজ (বছিলা ব্রিজ), কামরাঙ্গীচর ব্রিজ, জিঞ্জিরা ফেরিঘাট, শোয়ারীঘাট, বাবুবাজার ব্রিজ, ইসলামবাগ, লালবাগ, বুড়িগঙ্গা ১নং ব্রিজ (পোস্তগোলা), ফরিদাবাদ, শ্যামপুর, পাগলাঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় হাজারো জনতা ব্যানার ফেস্টুন হাতে দাঁড়িতে তারা বুড়িগঙ্গা রক্ষার কথা বলেন। সদরঘাট টার্মিনালের পাড়ে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও সমাবেশে বাপা’র সহসভাপতি অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হকের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেনÑ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। বক্তব্য রাখেন বাপা’র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক মহিদুল হক খান, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব মিহির বিশ্বাস, সিপিবি’র কেন্দ্রীয় নেতা আহসান হাবিব লাবলু, গণতন্ত্রী পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহমুদুর রহমান বাবু, বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার সাদত, ঢাকা যুব ফাউন্ডেশনের সভাপতি শহীদ মাহমুদ শহিদুল্লাহ, পুরান ঢাকা পরিবেশ উন্নয়ন ফোরামের আশরাফ আমির উল্ল্যাহ, আদি ঢাকাবাসী ফোরামের জাবেদ জাহান, ইমরান হোসেন, নাজিরা বাজার পঞ্চায়েত কমিটির আলী হোসেন, বাপা’র জাতীয় পরিষদ সদস্য নাজিম উদ্দিন, ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের মারুফ হোসেন, সুজনের ক্যামেলিয়া চৌধুরী। সমাবেশে বিআইডব্লিউটি এর সিপিবি’র সভাপতি আবুল হোসেন, পুরান ঢাকার প্রায় ২৫টির বেশি সংগঠন বিশেষ করে ঢাকা যুব ফাউন্ডেশন, ওল্ড ঢাকা ক্লাব, বোধ ফাউন্ডেশন, বাঙ্গাল আবু সাঈদ স্মৃতি সংসদ, বেগম বাজার-মেীলভী বাজার বণিক সমিতি, কে এল জুবলী স্কুল ও কলেজ, নাজিরা বাজার কাজী আলাউদ্দিন রোড পঞ্চায়েত কমিটি, সিক্কাটুলী মুসলিম যুব সংঘ, সিক্কাটুলী পুকুর রক্ষা কমিটি, পুরান ঢাকা পরিবেশ উন্নয়ন ফোরাম, আদি ঢাকাবাসী ফোরাম, হোসনী দালান পঞ্চায়েত কমিটি, খাজা দেওয়ান সমাজকল্যাণ সমিতি, ঢাকা সমিতি, বংশাল এলাকাবাসী, আগা নবাব দেউরী সমাজকল্যাণ সমিতি, রোটারী ক্লাব হোসনী দালান, সুজন হোসনীদালান শাখাসহ ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ, গ্রীন ভয়েস, ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর প্রতিনিধিসহ নদী পাড়ের সাধারণ জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের কয়েক হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত থেকে সংহতি জানান। মানববন্ধন অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট লেখক কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, নদী পাড়ের হাজারো জনগণ বুড়িগঙ্গার পাশে দাঁড়িয়েছে শুধু বুড়িগঙ্গাকেই রক্ষার জন্য নয়। এটা তাদের জীবন-মরণ সমস্যা। রাজধানীবাসীর বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হবে। বুড়িগঙ্গার আজকের এই দুর্দশা একদিনে হয়নি। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় থেকে একদিকে বেপরোয়া দখল, অন্যদিকে দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা আজ মৃতপ্রায়। বিভিন্ন সময়ে সরকার থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও কার্যকর তেমন কিছুই হয়নি। কিছু স্বার্থান্বেষীদের লোভের কারণে এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে বুড়িগঙ্গাকে দখল করা হচ্ছে। এমনকি সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এর সঙ্গে জড়িত। শুধু কথার কথা বা প্রতিশ্রুতি নয়, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীকে রক্ষার জন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গাকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনীয় বা কম প্রয়োজনীয় খাত থেকে অর্থ এনে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদী রক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক বলেন, দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে আন্দোলন ও দাবি জানিয়ে আসার পরও বুড়িগঙ্গা রক্ষা পাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় নদী রক্ষার কঠোর প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গেলেও পরিকল্পিত পদক্ষেপের অভাবে প্রিয় বুড়িগঙ্গা ধ্বংসের দারপ্রান্তে। সর্বশেষ ২০০৯ সনে নদী রক্ষায় হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে রায় বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও রায়ের সঠিক বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। হাইকোর্টের এই নির্দেশনা সরকার সঠিকভাবে পালন করে বুড়িগঙ্গা ও ঢাকার চারপাশের নদীসহ সারাদেশের নদী রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা আহসান হাবিব বলেন, বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে না পারলে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না। ঢাকার কলকারখানা-শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা বন্ধ করতে হবে। এই নদীর পানি পরিষ্কার থাকলে শহরের পরিবেশও অনেক সুন্দর হবে। বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আনোয়ার সাদত বলেন, সরকারের ইচ্ছা থাকলে এক বছরের মধ্যে বুড়িগঙ্গাকে তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে। মানববন্ধনে অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক পার্টির নেতা মাহমুদুর রহমান বাবু বলেন, যখন ছোট ছিলাম, বাবার হাত ধরে নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম, তখন নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ, সুন্দর, টলমলে। এখন বিষাক্ত বর্জ্য ও ভূমিদস্যুদের কারণে সেই পানির রং পরিবর্তন হয়ে কোকাকোলার পানিতে পরিণত হয়েছে। পানি এতই নষ্ট যে নদীর পাশ দিয়ে হাঁটলে কাপড় দিয়ে মুখ চেপে ধরতে হয়। বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস মানববন্ধন অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন। তিনি বলেন, নদী রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা, হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। নদী টাস্কফোর্সের সভায় বিভিন্ন সময়ে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু উচ্চপর্যায়ের এ সকল সিদ্ধান্ত মাঠ পর্যায়ে গিয়ে তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। মানববন্ধন থেকে বুড়িগঙ্গা রক্ষায় বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করা হয়। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে নদী দূষণ রোধে হাইকোর্টের রিট নং ৩৫০৩/২০০৯ মোতাবেক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণমুক্ত করতে হবে। নদীপাড় বা নিকটবর্তী শিল্পকারখানাসমূহে বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। বুড়িগঙ্গায় চলাচলকারী নৌযানের বর্জ্য, ময়লা, তেল, লুব্রিক্যান্ট নদী তীরের পানিতে বা পাড়ে যেখানে-সেখানে ফেলা বন্ধ করতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে বুড়িগঙ্গার সঠিক সীমানা পিলার নির্ধারণ, বেদখলকৃত নদীর জমি উদ্ধার, দখল সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ ও জমি সংরক্ষণ করতে হবে। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে দেয়াল নির্মাণ করে নদীকে সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। নদীর পাড়ে ঘাস লাগানো, গাছ রোপণ, সীমিত মানুষের বসার স্থান নির্মাণ, ময়লা ফেলার প্রয়োজনীয় ‘বিন’ স্থাপন করতে হবে। নদীর জন্য নির্দিষ্ট পরিচ্ছন্ন কর্মী নির্ধারিত রাখতে হবে। বুড়িগঙ্গার পাড়ে কোন বাণিজ্যিক স্থাপনা, মার্কেট, দফতর, দোকান, হোটেল নির্মাণ করা যাবে না। মাছ চাষ বা ধরার নামে নদীর ভেতরে বা পানির মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ী কোন প্রকার বেড়া, গাছের ডাল, জাল স্থাপন নিষিদ্ধ করতে হবে। ঢাকা ওয়াসা সংগৃহীত বাসাবাড়ির ময়লা নিষ্কাশন প্রক্রিয়ায় অবিলম্বে বর্জ্য শোধন প্ল্যান্ট সংযুক্তি ও তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দখল-দূষণ মনিটরিং এর জন্য সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে নির্দ্দিষ্ট মেয়াদভিত্তিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করতে হবে। দখল হয়ে যাওয়া ঢাকা মহানগরীর সকল খাল পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য নিষ্কাশন কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ডাস্টবিনের বর্জ্য ড্রেনে প্রবেশ বন্ধ ও ড্রেনের পানি শোধন করতে হবে। নদীবিষয়ক টাস্কফোর্সকে কার্যকর রাখতে হবে। নদী দূষণরোধ কল্পে আলাদা দূষণ প্রতিরোধ কর্তৃপক্ষ স্থাপন করতে হবে। নদীর উভয় তীরে আবশ্যকীয় সোলার লাইট স্থাপন করতে হবে।
×