ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক অসহায় কিশোরী মায়ের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ মার্চ ২০১৭

এক অসহায় কিশোরী মায়ের কাহিনী

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ১৭ বছরের এক কিশোরী সদ্য মা হয়েছে। পাঁচ দিনের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছে সে। মা ও শিশু একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মায়ের চোখে মুখে আনন্দের হাসি। ১৭ বছর বয়সে কিভাবে এই কিশোরী মা হয়েছে? জানা গেল, এই কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল। অনেক কষ্টে প্রাণে বেঁচেছে মেয়েটি। টানা ১৫ দিন দুর্বৃত্তরা তাকে আটকে রেখেছিল। পরিবারে ফিরে আসার পর জানা গেল মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। তার পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাকে রেখে যায় রাজধানীর এক নারী ও শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে। গাইবান্ধার তামান্না নামের এই কিশোরী বর্তমানে সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যাশিশুকে নিয়ে আছে ‘হোপ ফর দ্য ডেস্টিটিউট উইমেন এ্যান্ড চিলড্রেন’ নামক এক বেসরকারী সংগঠনের কার্যালয়ে। ডেলিভারির এক মাস আগে সে এখানে আশ্রয় নেয় এবং যথারীতি এখানেই তার সন্তানের জন্ম হয়েছে। এখন শুধুই অপেক্ষা এই সন্তানকে পালক নিতে আগ্রহী এমন উপযুক্ত এক পরিবারের হাতে তুলে দেয়ার। তারপর এই কিশোরী আবার ফিরে যাবে তার পরিবারের কাছে। তামান্নার মতো আরও অনেক অপ্রাপ্তবয়স্কসহ প্রাপ্তবয়স্ক নির্যাতিত নারীর আশ্রয় এখানে। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেল, মোট সাতজন মা তাদের সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানদের সঙ্গে রয়েছেন এখানে এবং তিনজন অন্তঃসত্ত্বা রয়েছেন। শীঘ্রই তাদের ডেলিভারি হবে বলে জানালেন তারা। দেশের অসহায় মা ও শিশুদের এক নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ‘হোপ ফর দ্য ডেস্টিটিউট উইমেন এ্যান্ড চিলড্রেন’ একটি বেসরকারী সংগঠন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে সাময়িকভাবে এ সংগঠনটি নারী ও শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে ২০১১ সাল থেকে। ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে বিয়ের আগে অন্তঃসত্ত্বা কিশোরী ও নারীদের নিরাপদ মাতৃত্ব রক্ষায় কাজ করে আসছে সংস্থাটি। এছাড়া অনেক সময় বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির পরিবারের অত্যাচারে টিকতে না পেরেও নিরাপদ প্রসবের জন্য এই কেন্দ্রকে বেছে নেন অনেকে। এখান থেকে যে মায়েরা সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরতে চান, তারা সন্তান নিয়েই বাড়ি ফেরেন। আর যাদের উপায় নেই তারা সন্তানকে রেখে যান। সংগঠনের পক্ষ থেকে উপযুক্ত পরিবারের কাছে আদালতের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ওই সন্তানকে পালক দেয়া হয়। তার আগ পর্যন্ত পালক নিতে আগ্রহী ওই পরিবারকে সংগঠনের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে আদালতে হাজিরা দেয়া, শিশুর সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়। তবে এখানে কোন ধরনের টাকাপয়সার লেনদেন হয় না বলে নিশ্চিত করেন সংগঠনে কর্মরত ব্যক্তিরা। ২০১৬ সালে এ সংগঠনের মাধ্যমে মোট ৪১ জন নারীর নিরাপদ ডেলিভারি হয়েছে। এরপর ২৭ জন মা তাদের সন্তানকে নিয়ে পরিবারে ফিরেছেন। আর ১৪ জন মা তাদের সন্তানকে রেখে গেছেন এখানে। রেখে যাওয়া ১৪টি শিশুর মধ্যে নয়টি শিশুকে পালক পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ছয়টি শিশু এখানকার শিশু দিবাযতœ কেন্দ্রে বেড়ে উঠছে। তিনজন মা তাদের সন্তানদের কোলে নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন। এদের মধ্যে দুইজন জানালেন, তারা তাদের সন্তানকে নিয়ে পরিবারে ফিরবেন। অন্যজন এখানেই তার সন্তানকে রেখে যাবেন। কারণ, ধর্ষিত হওয়ার ফল এই সন্তান। সমাজ তার এই সন্তানকে কখনও মেনে নেবে না। আর তাই মা হয়ে সন্তানকে রেখে চলে যেতে হবে বলে জানালেন তিনি। এখানে থাকা নারী ও কিশোরীর একেক জনের জীবনের গল্প একেক রকম। একেকজন কমপক্ষে ছয় মাস এখানে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার সুযোগ পান। এই সংগঠনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চিকিৎসক দিলরুবা জনকণ্ঠকে বলেন, আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেই চলছে এই সংগঠনটি। সমাজসেবা অধিদফতর, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারিতে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দাতাগোষ্ঠীর সহায়তাও বন্ধ দীর্ঘদিন ধরে। মানুষের কাছে চেয়ে মাস পার করতে হচ্ছে। প্রতি মাসে তিন লাখ টাকার বেশি খরচ হয় এসব মা ও শিশুর দেখভালসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে। অর্থ সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে।’ সংগঠনটির উদ্যোগে নিয়মিতভাবে এখানে আশ্রিত নারীদের কর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন-সেলাই মেশিন চালানো, দর্জির কাজ, হাতের সেলাইসহ রান্নাবিষয়ক কাজে প্রশিক্ষণে নিয়ে গত বছর মোট ২৩ জন নারী দক্ষতা অর্জন করেছেন। শুধু আশ্রিত নারীদের জন্যই নয় বরং বাইরে থেকে আসা মোট ১৫ জন নারী ওই বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এছাড়া সংগঠনটি আশ্রিত নারীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাও রেখেছেন। গত বছর মোট ২৩ জন নারী এখান থেকে তাদের বিভিন্ন ক্লাস সম্পন্ন করে আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করেছেন। এছাড়াও ‘হোপ ফর দ্য ডেস্টিটিউট উইমেন এ্যান্ড চিলড্রেন’ সংগঠনের একটি তলায় শিশু দিবাযতœ কেন্দ্র রয়েছে। পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত শিশুদের এ কেন্দ্রেই রাখা হয়। এছাড়া যেসব নারীরা মানুষের বাড়িতে বুয়ার কাজ করেন বা পোশাকশিল্পে কাজ করেন, ওই মায়েরাও মাসিক ৫০০ টাকা দিয়ে সন্তানকে এই কেন্দ্রে রাখার সুযোগ পান।
×