ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিল্লীর প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে ঢাকা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৪ মার্চ ২০১৭

দিল্লীর প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে ঢাকা

তৌহিদুর রহমান ॥ দিল্লীর পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে ঢাকা। উভয় দেশের মধ্যে এ বিষয়ে একটি চুক্তির আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। তবে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সইয়ে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সামনে রেখে এ বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যেই আলোচনা চলছে। সূত্র জানায়, ভারতের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে কোন তাড়াহুড়া করতে চায় না বাংলাদেশ। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে এ বিষয়ে এগোতে চায়। কেননা, ভারতের মতো একই ধরনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রস্তাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও রয়েছে। এ বিষয়টিও বাংলাদেশের বিবেচনায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে সেই বন্ধন জোরালো করতে বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়েও বাংলাদেশ আগ্রহী। দেশের নিকটতম প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী বাংলাদেশ। ব্যবসা, বাণিজ্য, আন্তঃযোগাযোগ, বিদ্যুত সহযোগিতা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় উভয় দেশই একযোগে কাজ করছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়েও এখন প্রাধান্য দিচ্ছে উভয় দেশ। এদিকে গত বুধবার সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত দীর্ঘমেয়াদে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চুক্তি করতে আগ্রহী। তবে শুরু করার জন্য এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই একটি ভাল পথ হতে পারে বলে মনে করছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতের প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদেশের কাছে সমরাস্ত্র বিক্রি এবং সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। একই সঙ্গে হুমকি মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে অভিযান চালানোর বিষয়টি রয়েছে। বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করার জন্য ৫০ কোটি ডলার লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণ দেয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর গত ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি দুই দিনের ঢাকা সফরকালে দুই দেশের মধ্যে যেসব বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায় তার মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টিও ছিল। এর আগে গত ৩০ নবেম্বর ঢাকায় এসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের বার্তা দিয়ে যান ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর গোপালকৃষ্ণ প্রভু পারিকর। সে সময় দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রস্তাব দেয় ভারত। ৪৫ বছরের ইতিহাসে সেটাই ছিল প্রথম কোন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। তবে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের মূল লক্ষ্য ছিল, প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিবিড় সহযোগিতার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের পটভূমি তৈরি করাও ছিল ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফরের মূল লক্ষ্য। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফর নিয়ে দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সেসব আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এছাড়া ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে নতুন প্রস্তাব দেন। সে প্রস্তাব অনুযায়ী দুই দেশের সামরিক বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। ভারতের প্রতিরক্ষারমন্ত্রীর ঢাকা সফরের পরেই টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষাবিষয়ক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতির উপায় খুঁজতেই মনোহর পারিকর ঢাকায় সফর করেন। এছাড়া বাংলাদেশের প্রতি চীনের কৌশলগত পদক্ষেপ বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতেই তার এই সফর। মনোহর পারিকরের ঢাকার আলোচনায় ছিল, সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকা- জোরদার করতে নতুন প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কাঠামোর অংশ হিসেবে সামরিক সরবরাহ বাড়ানো, প্রযুক্তি হস্তান্তর, প্রশিক্ষণ ও যৌথ মহড়ার আয়োজন। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীনের কাছ থেকে পাওয়া দুটি ডুবোজাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়েছে। এই দুটির নাম রাখা হয়েছে ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’। এর পরই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাংলাদেশে এ সফর। গত অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ৩০ বছরে চীনের প্রথম কোন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসেন। সে সময় বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ২৭ চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশে চীনের সামরিক প্রভাব ঠেকাতেই মনোহর পারিকরের এই সফর বলে আভাস দেয়া হয় ওই প্রতিবেদনে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনী তাদের পরস্পরের সাংগঠনিক অবকাঠামো ও কৌশল সম্পর্কে পরিচিত হওয়ার লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে ২০১০ সাল থেকে যৌথ মহড়ার আয়োজন করা হচ্ছে। গত বছর ৫-৮ নবেম্বর টাঙ্গাইলে এই যৌথ মহড়া হয়। বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসেবে ‘সম্প্রীতি ২০১৬’ নামে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ মহড়া হয়। সেই মহড়ায় জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধের বিষয়টিও যুক্ত ছিল। প্রতিবছর একবার বাংলাদেশে ও একবার ভারতে এই সামরিক যৌথ মহড়া হয়ে থাকে। প্রথম যৌথ মহড়াটি হয়েছিল ভারতের অসমের জোড়হাটে। দুই দেশের প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা বাড়াতে অনেক আগে থেকেই এই ধরনের যে উদ্যোগ রয়েছে, সেটাকেই চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চায় উভয় দেশ। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী ৮-১০ এপ্রিল দিল্লী সফরের কথা রয়েছে। সফর নিয়ে ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে প্রস্তুতিও চলছে। দিল্লী সফরকালে দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে একটি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি চলছে।
×