ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রজেন্দ্র কুমার দাস

পার্লামেন্টের কবি প্রণমি তোমায়

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৪ মার্চ ২০১৭

পার্লামেন্টের কবি প্রণমি তোমায়

নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা’, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো; কবিতাটি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ঘিরে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি শুধু ভাষণই নয়, এ যেন একটি সফল এবং নিতান্তই একটি আধুনিক কবিতা। এ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর পরোক্ষ আর প্রত্যক্ষ দু’ভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ আর মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণার ইঙ্গিত বহন করে। রাজনীতিঋদ্ধ কবি গুণের কবিতাটি এ রকম- কপালে কব্জিতে লাল সালু বেঁধে এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক ঝাঁক উলঙ্গ কৃষক পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জনতার মঞ্চে দাঁড়ানো মহান কবির রক্তাক্ত কবিতার শরীর থেকেই জন্ম নিল তাঁর সাধের বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে এলো সংবিধান। পার্লামেন্ট। সংসদ। সংসদ নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন দেশের সংসদ মুখরিত হলো সংসদ সদস্যদের পদচারণায়। বিশ্বের বুকে নতুন এক পার্লামেন্ট। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের পার্লামেন্ট। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দল ন্যাপের কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে এলেন ২৬ বছর বয়সের এক তাজা তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান। অন্যরকম এক কবি। পার্লামেন্টারিয়ান কবি। এ কবির কণ্ঠে উচ্চারিত কবিতাগুলো শুধু পার্লামেন্টেই নয়, কবিতার পাঠক জনসমুদ্রেও। পার্লামেন্টের কার্যাবলীর ধারাবিবরণী রেডিওতে প্রচার করা হতো। মনে পড়ে এই পার্লামেন্টারিয়ান কবি মাইক হাতে নিলে অনেক সময় সরকারী দলের কোন কোন সদস্য খানিকটা হৈচৈ করলে বঙ্গবন্ধু সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আদর স্নেহ ভালবাসার সুরে বলতেনÑ ‘সুরঞ্জিতকে বলতে দাও।’ আজকে তাই মনে হয়- যে কবির কবিতা পাঠে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ছিল সেই কবি ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন পার্লামেন্টরিয়ান কবিকে। চিনতে তিনি ভুল করেননি বলেই তাকে তিনি এত ভালবাসতেন। কবি কবিকে চিনতে ভুল করেন না। এটাই কবির কবিত্ব। আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও এই পার্লামেন্টারিয়ান কবিকে চিনতে ভুল করেননি। তাই তো শেখ হাসিনা খুশি মনে বলেছিলেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। তার মতো একজন বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান আমাদের দলে যোগ দেয়ায় আমরা গর্বিত ও আনন্দিত। আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রয়াণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন জাতি হারাল একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হারাল একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, আর আমরা হারালাম সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রসেনানীকে।’ প্রবীণ সাংবাদিক, কলাম লেখক ও বিশ্লেষক কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশনের ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস হাসান শাহরিয়ার শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে ৯.২.২০১৭ তারিখের দৈনিক ‘সমকাল’-এ কার নিবন্ধ ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত : কালনী পাড়ের চন্দন বৃক্ষ’-এ যথার্থই লেখেনÑ ‘মানুষকে আপন করার এক জাদুকরী ক্ষমতা ছিল তার। শুধু ভাটি বাংলায় কেন, সব জায়গায়ই দেখা গেছে তার বক্তৃতা শোনার জন্য সব শ্রেণীর লোক ভিড় জমাত। তিনি যখন সংবিধান কিংবা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোন ল’ পয়েন্ট নিয়ে সংসদে কথা বলতেন তখন সব সদস্য তা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘দেশ ও দেশের মানুষের অধিকারের পক্ষে সব সময় সোচ্চার থেকেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবন নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে জীবনের শুরু থেকে শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজনীতির বরপুত্র। মানুষের মধ্যে তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবেই বেঁচেছিলেন। রাজনীতির মাঠ থেকেই তিনি দেশবাসীর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। তাই রাজনীতির এই বিশাল বটবৃক্ষের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন রাজনৈতিক স্মৃতিমূলক ঘটনা থাকার কথা নয়। শুনেছি আমার ভাই অধ্যাপক দেবেন্দ্র কুমার এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। এমনটি জানার পর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সব সময়ই আমার কাছে বড় ভাইয়ের আসনেই অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং সে হিসেবেই কিছু ব্যক্তিগত স্মরণীয় ঘটনার স্মৃতি আজ ভীষণভাবে জাগরিত হচ্ছে। ছোট ভাই হিসেবে কখনও কখনও গভীর শ্রদ্ধা মিশ্রিত দুষ্টুমির কথা আজ ভীষণ মনে পড়ছে। যেমন, ১৯৭২ সালে আমি ময়মনসিংহ টিটি কলেজে পড়তাম। থাকতাম কলেজ হোস্টেলে। রুমমেট ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষ শাহ আলম, বীরেন্দ্রনাথ চাকী। আরও অনেক একই চিন্তার মানুষ। সেনদা তখন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্য। ময়মনসিংহে একটি জনসভায় তিনি প্রধান বক্তা, রাস্তার পাশেই সভা। সুরঞ্জিত সেন আসবেন জেনে টিটি কলেজের অনেকেই সভায় উপস্থিত হলেন। আমার বাড়ি দিরাই জেনে সবাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। সভা শুরু, তিনি বক্তৃতায় রাজনীতির অনেক তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলতে লাগলেন। এতে করে জনসভায় লোকসমাগম তেমন হচ্ছিল না। আমার এখনও মনে পড়ে তিনি হঠাৎ বক্তৃতার ধরন বদলে ফেলে নিজের সহজাত ভঙ্গিমায় মঞ্চ কাঁপিয়ে সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাদের দুর্বল ভাববেন না, এই মঞ্চ থেকে যদি ডাক দেই ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমে পড়বে।’ এভাবে বক্তৃতার ফলে দেখা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই জনসভা লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। সন্ধ্যায় ময়মনসিংহের বুদ্ধিজীবী-সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সেনদার মতবিনিময় হওয়ার খবর পেয়ে আমরা ক’জন সেখানে উপস্থিত হই। অনেক বিজ্ঞজন প্রশ্ন করছেন। সেন দা সহজ সরলভাবে উত্তর দিচ্ছেন। সবাই খুশি। আমি সাহস করে প্রশ্ন করলাম ‘সভায় আপনি বললেন ডাক দিলে ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা চলে আসবে, সেটা কি সত্যি?’ উত্তরে তনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন ‘এটা বলার পর মিটিংয়ের অবস্থা কেমন হয়েছিল তা মনে করে দেখ। এখানেই তোমার প্রশ্নের উত্তর।’ আমি খুশি হই। ১৯৭৮ সালের কথা। ব্যাংকের চাকরি জীবনে জনতা ব্যাংক দিরাই শাখায় আমি প্রথম ম্যানেজার। সেনদা তখন দিরাই শাল্লার সংসদ সদস্য। দিরাই বাজারের এক গাঁজা ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণের জন্য প্রায়ই আসতেন। কিন্তু গাঁজার মতো নেশা জাতীয় আইটেমে লোন দেয়া তো ব্যাংকের নিয়মে পড়ে না। এ কথা তাকে বোঝানো যাচ্ছিল না। ভদ্রলোক তার স্ত্রীসহ সেনদার কাছে প্রায়ই এ ব্যাপারে যাওয়া শুরু করেন। হয়ত বিরক্ত হয়েই তিনি একদিন লিখে দিলেন, ‘ইৎড়লধহফধ ঢ়ষবধংব যবষঢ় যরং’। চিঠি নিয়ে ভদ্র মহিলা না গিয়ে তার স্বামীকে ব্যাংকে পাঠান। সেনদা তখন দিরাই ডাকবাংলোয়, কাগজটি নিয়ে সোজা তার কাছে গিয়ে বললাম চিঠি নিয়ে তো ‘যবৎ’ যাননি ‘যরস’ গিয়েছেন। তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘কি করা যায় বল, আমি বলেছিলাম আমি তাকে এমনভাবে বুঝিয়ে দেব যে সে কোনদিন আপনার কাছে যাবে না এবং গাঁজার লোনের জন্যও যাবে না। আমি গাঁজা ব্যবসায়ীকে ব্যাংকে এনে বললাম, এমপি সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে তিনি ঢাকা গিয়ে সংসদে গাঁজার লোনের জন্য আইন পাস করবেন এবং পত্রিকায় তা প্রকাশ পেলেই আপনি তা নিয়ে আসবেন। লোন পাবেন। তারপর এ আইন আর পাস হয়নি। এর পর একদিন সেন দার সঙ্গে দেখা হলে তিনি গাঁজা ব্যবসায়ীর কথা বললে বিষয়টি বলি। শুনে তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন- দুষ্টু কোথাকার! আরেকটি ঘটনা, দিরাইয়ে থানা কৃষি ঋণ আদায়ের মিটিং হচ্ছিল স্থানীয় ব্যাংকারদের নিয়ে। উপস্থিত ছিলেন সিলেটের ডিসি মুজিবুর রহমান, স্থানীয় সংসদ সদস্য আমাদের সবার প্রিয় সেনদা। জনতা, অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংক। ম্যানেজারগণ। অগ্রণী ও কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজারদেরকে জিজ্ঞেস করার পর ডিসি মহোদয় বললেন, জনতার খবর কি! আমি বলেছিলাম, আমাদের কোন কৃষকের ঋণ অনাদায়ী নেই। শুনে তো সবাই অবাক! ডিসি সাহেব বলেন, তা কাদের ঋণ অনাদায়ী? আমার উত্তর ওরা অকৃষক! ডিসির প্রশ্ন ওরা কারা? আজ সেটা বলতে শিউরে উঠতে হয়। আমি কি জানি কি ভেবে সেনদাকে দেখিয়ে বলেছিলাম ওনার লোক। শুনে তো সেনদা আগুন। ডিসি সাহেব বললেন, কিভাবে? আমি সাহস করে সেদিন বলেছিলাম উনি যেহেতু এখানকার এমপি, তাই সবাই তো ওনার লোক। ডিসি সাহেব বলেছিলেন তাহলে আদায় হবে কিভাবে? আমার উত্তর উনি বলে দিলেই হবে। ডিসি সাহেব বলেছিলেন স্যার একটু বলে দেবেন। মিটিং শেষে সেনদা আমাকে ডেকে নিয়ে সেই একই কথা- আবারও দুষ্টুমি! পরদিন অনেক টাকা কৃষি ঋণ আদায় হয়েছিল। আজ সেনদা বেঁচে নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না। ভাবতে ভীষণ কষ্ট হয়। চোখে অজান্তেই জল এসে যায়। ভাবি, আজকের দিনে কি এমনটি চিন্তা করা যায়? একজন এমপি মহোদয়ের কোন এক ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার কি এত আবদার নিয়ে কথা বলার সাহস পাবে। পাবে এত সহযোগিতা? জলভরা চোখে শুধুই বলতে ইচ্ছে করে কেউ তো আর বলবেন নাÑ দুষ্টু কোথাকার!
×