ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ধারাবাহিক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৩ মার্চ ২০১৭

ধারাবাহিক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) সম্রাটের প্রক্ষালন পর্ব ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৬৫৭ সাল। সারা রাত থেকে থেকে বৃষ্টি হয়েছে। মৌসুমের শেষ বৃষ্টি বোধ হয়। এরপর হিমালয় হতে শীতের আগমনী বাতাস বয়ে আসবে। থেমে থেমে মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠেছে পুরো লালকেল্লা। বিদ্যুৎ ঝিলিকে অপার্থিব দেখাচ্ছিল লাল পাথরের দীর্ঘ দেয়ালগুলি। কেল্লার সামনে খোলা মাঠে ভিজে জবুথবু হয়ে গেছে রাজকীয় হাতিগুলো। বাতাসের তোড়ে সামিয়ানা উড়ে গেছে। ভোরবেলায় যখন বৃষ্টিস্নাত ঠাণ্ডা নরম বাতাস দিল্লিবাসীকে আরো অলস করে তুলছিলো ঠিক সেই সময় বাদশাহ শাহজাহান দীর্ঘ এক মাস পর আরাম করে প্রাত্যক্রিয়া সুসম্পন্ন করতে সক্ষম হলেন। বেশ কিছুদিন ধরে হাকিমদের দেয়া ওষুধ বাদ দিয়ে জাহান আরা লুকিয়ে সম্রাটকে অদ্ভুতদর্শন এক হিন্দু বৈদ্যের দেয়া আয়ুর্বেদিক রস খাওয়াচ্ছেন। প্রথমে খাওয়ানো হলো বড় বোতলের কালচে তেতো রস। তারপর হতেই পেটের ভেতর আরাম বোধ হচ্ছিল বাদশাহের। এখন ছোট বোতলের সবুজ রসের দাওয়াই চলছে। পেট আর বুকের শ্বাসকষ্টটাও অনেক কম আর পা ফোলা কমেছে। কিন্তু শরীরে জোর পাচ্ছেন না শাহজাহান। কিন্তু আজ সকালে মেজাজটাও বেশ ফুরফুরে লাগছে। - ‘তবে কি আমি সুস্থ হয়ে গেছি? সেই বিশ বছর আগের মতো খুদা আবার বাঁচিয়ে তুললেন ..।’ কাকে ধন্যবাদ দেবেন তা ভাবতে থাকলেন বাদশাহ? সেই হিন্দু বৈদ্য নাকি কন্যা জাহান আরা’কে?’ মনে মনে ঠিক করলেন, ধন্যবাদ যদি দিতে হয় তবে তা বিদুষী কন্যা জাহান আরার প্রাপ্য। আরেক কন্যা রোশেন আরা গিয়েছেন কাশ্মীরে বিহার করতে। জাহান আরা’ই শাহজাদা দারাকে রাজী করিয়েছেন সম্রাটের কক্ষে বোরকা পরিয়ে রুদ্রাক্ষের মালা আর তিলক পড়া বৈদ্যকে শাহী কক্ষে প্রবেশ করাতে। এর আগে হিন্দুস্তানের কোন মুঘল বাদশাহের খাস কামরায় কোন কাফের প্রবেশ করে নাই। এবারই প্রথম। তা সম্ভব হয়েছে ভাই-বোনের সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে। তা না হলে এত দিনে বাদশাহের চল্লিশা পালন করা হয়ে যেতো! ইতিমধ্যে সম্রাটের শৌচ-কর্ম সম্পাদনের খুশ খবর মুহূর্তের মধ্যে লাল কেল্লা পেরিয়ে চাঁদনী চক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। পুরো মহল জুড়ে যেন দিওয়ালীর হৈ চৈ। নওকরখানায় শিঙ্গা ফুঁকে আনন্দের তোপধ্বনী বাজানো হলো। অসময়ে বাদক দল সেতার বীণা ঢোল করতাল নিয়ে রংমহলে হল্লা শুরু করে দিলো। অন্দর মহলের বাঈজীরা সকালের আড়মোড়া ভেঙ্গে যখন জানতে পারলেন শাহেনশাহ আরাম করে সশব্দে পেট খালি করেছেন খুশিতে তাঁরা মুনাজাত ধরলেন। এখন আর কোন দুশ্চিন্তা নেই। সম্রাটের পেটের পীড়া কেটে গেছে। সেই সঙ্গে হিন্দুস্তানের আকাশে কালো মেঘ কি কেটে যাবে? রোগ মুক্তির সুখবর পেয়ে সবার আগে জাহান আরা ছুটে এলেন সম্রাটের খাস কামরায়। অনিন্দ্যসুন্দরী মুঘল নারী। সবাই বলেন, নূরজাহান কিংবা মমতাজ বেগমের চেয়েও সুন্দরী তিনি। দাদীজান আর আম্মাজানের খুব সুরতের সবটুকুই পেয়েছেন জাহান আরা। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য সম্ভ্রান্ত মুঘল পুরুষরা তাঁকে এড়িয়ে চলেন। এমনকি আওরঙ্গজেব পর্যন্ত তাঁর এই বোনের তারিফ করতে ভুলেন না। কবিতা লেখা আর বই পড়া জাহান আরার নেশা। তাঁর নিজস্ব সংগ্রহের লাইব্রেরীটির সুখ্যাতি ভূমধ্যসাগর পারের পণ্ডিতদের মুখে মুখে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তিনি লিখছেন খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির জীবনী। শপথ করেছেন আব্বাজান রোগমুক্ত হলে এই বই উৎসর্গ করবেন তাঁকে। প্রক্ষালন-পর্ব শেষে হাম্মামখানা হতে কাপড় বদলে নরম গদির তাকিয়ায় আরাম করে বসলেন শাহজাহান। কন্যাকে আসতে দেখে আপ্লুত হয়ে বলে উঠলেন, ‘সুবহানাল্লাহ! আমার চোখের মণি, তোমাকে যেন কতদিন পর দেখলাম।’ বাপ-বেটি পরস্পরকে শক্ত করে আলিঙ্গন করলেন। জাহান আরা আলতো করে পিতার কপাল হতে ঝুলে পড়া সাদা চুল সরিয়ে দিয়ে আলতো করে চুমু খেলেন। তারপর আবার দীর্ঘক্ষণ বুকে জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধ অসুস্থ সম্রাটকে। রোগমুক্তির প্রাথমিক আবেশে কন্যার বাহুডোরে হাজারো স্মৃতিতে হারিয়ে গেলেন সম্রাট। প্রেমময়ী স্ত্রী মমতাজের মৃত্যুর পর শাহজাহান আর চুলে কলপ করেন নি। তাঁর আরো ইচ্ছে ছিলো শুভ্র তাজমহলের পাশে যমুনার অপর পারে আরেকটি কালো পাথরের কৃষ্ণ মহল বানাবেন। একই ধাঁচে হুবহু দেখতে একই রকম হবে সেটা। সেখানে তাঁর কবর হবে। কিন্তু অসুস্থ শরীর আর পুত্রদের কোন্দল তাঁকে আর সেই স্বপ্ন পূরণ করতে দিলো না। যখন তিনি শাহজাদা খুররম ছিলেন সেই দুরন্ত দিনগুলোতে তাঁকে শক্ত হাতে রাস টেনে ধরেছিলেন প্রথমা বিবি মমতাজ বেগম। শপথ করিয়েছিলেন যত ফুলের মধুই তিনি খান তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু রাজসন্তান ধারণের ভার শুধু তাঁর একার। শাহজাহান কথা রেখেছিলেন। - আব্বাজান, আপনি কি আপনার প্রিয় দিওয়ান-ই-খাস মহলে ময়ূরসিংহাসনে বসতে চান? পেলেন শাহজাহান। আস্তে করে কন্যার আলিঙ্গন হতে নিজেকে মুক্ত করে নিলেন। ভেতর ভেতর একটু সজাগ হলেন বাদশাহ। শুনেছেন বার্নিয়ার নামে এক ফরাসী অভিযাত্রী আর মানুচ্চি নামের এক ইতালি ব্যবসায়ী নাবিক হিন্দুস্তানের আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখার নাম করে নানা রকম গল্প ফাঁদছে। বিশেষ করে বার্নিয়ার নামের খোদার গজব সেই ফিরিঙ্গি ইবলিশ খোদ সম্রাটের জীবন যাপন আহার-রুচি নিয়ে এমন কি তাঁদের বাপ- বেটির নিষ্পাপ মহব্বত নিয়েও নাকি কেচ্ছা কাহিনী রটাচ্ছে। সম্রাট ভেবে পান না কেল্লার ভেতরের অন্দর মহলের এতো কথা কিভাবে বাজারে ছড়ায়? নিশ্চয় এটা আওরঙ্গজেবের কারসাজি। তাজ মহলের পর দিওয়ান-ই-খাস বাদশাহের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। ১৬৩৯ সালে নিজ তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলেন দিল্লিতে নতুন নগর শাহজানাবাদ। তাঁর নতুন রাজধানী। কেল্লার ভেতর তাঁর প্রিয় বাগান মেহতাব বাগ, হায়াত বকশ বাগ, কেল্লার বাইরে বেগম বাগ কিংবা লাহোরের সালিমার বাগ তিনি তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন। এর বাইরে দিল্লির চাঁদনী চক, জাহান আরা মহল, দিওয়ান-ই-আম বা রং মহল বানাতে কন্যা জাহান আরার অবদান কে না জানে? দিওয়ান-ই-খাসের গায়ে তো তিনি লিখেই রেখেছেন ‘মাটির দুনিয়ায় যদি কোন বেহেশত থাকে তবে এটাই তো সেটা ...।’ জাহান আরা ধ্যানগ্রস্ত সম্রাটকে জাগিয়ে দিতে আবার কোমল স্বরে বললেন, - আব্বাহুজুর, প্রস্তুত হন। দারা’কে খবর পাঠিয়েছি। আজই কেল্লা হতে আপনি প্রজাদের হাত নেড়ে আপনার সুস্থতা এলান করবেন।’ - আমার দারা শিকো কোথায়? বিড়বিড় করে জানতে চাইলেন দিল্লি-ই-ইলাহী। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে বৃষ্টি দেখছিলেন শাহজাদা দারা। সম্রাটের সবচেয়ে আস্থাভাজন পুত্র তিনি। বেয়াল্লিশ বছরের সুদর্শন পুরুষ। দিল্লির এই আবহাওয়া মোটেও ভালো ঠেকছে না তাঁর কাছে। অসময়ে এভাবে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টির ঢল অমঙ্গলের চিহ্ন বোধহয়। সম্রাটের শরীর সুস্থ হলেই আগ্রায় নিয়ে যেতে হবে হাওয়া বদলে। দুই হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গলেন দারা। তারপর স্পষ্ট স্বরে গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করতে থাকলেন গায়ত্রী মন্ত্র । “ওম বুরবাহা সোহা তাৎসুভিতুরভরেনিয়াম ভারগো দেবাসিয়া ধীমাহি ধিয়োইয়োনাম প্রচোদেয়াৎ।” (চলবে)
×