ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওমর আলী ॥ মননে মাতৃভাষা ও একুশ

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৩ মার্চ ২০১৭

ওমর আলী ॥ মননে মাতৃভাষা ও একুশ

মা মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি যে কোন মানুষের অন্তর্গত প্রগাঢ় অনুভূতিময় ভালোবাসার এক চিরন্তনবোধ ও বোধির আঁধার বিশেষ। এ তিন থেকে বিচ্ছেদ মনুষ্য জীবনে কেবল অহিতই নয় অনেকাংশে মৃত্যুর শামিলও। শৈশবে মাতৃকণ্ঠ নিঃসৃত মায়ের যে সুধাবাণী অন্তুরে হিতু হয়ে ক্রমান্বয়ে বর্ধিষ্ণু শিশুর মুখে ভাষার বোল ফোটো এবং তার নিরন্তন প্রবাহ চলে জীবনের শেষদিন অবধি। এ কারণে মাতৃভাষা মায়ের মতোই ও মাতৃদুগ্ধের ন্যায় প্রাণদায়িনী। ১৯৪৭ সালে প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশ শাসনের যবনিকাপাত হলে বাঙালী আরেক দফা পাকিস্তানি কায়েমি চ-নীতির ঘেরাটোপে আটকা পড়ে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মের প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তখন থেকেই বাঙালির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে- তারই ধারাবাহিকতায় দেশ ভাগের মাত্র পাঁচ বছর ব্যবধানে ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের হীনমন্যতা ও কূটকৌশলে মাতৃভাষা বাংলার ওপর সর্বপ্রথম আঘাত হানে। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়- যদিও গোটা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা আটান্নজনের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। তথাপি পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা অন্যায় ও অযোক্তিকভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা করলে বীর বাঙালী প্রতিবাদে আন্দোলন সংগ্রামে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিণতিতে রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। সফল আন্দোলনে বাঙালী ফিরে পায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি। সমগ্র বিশ্বে ভাষার ইতিহাসে মাতৃভাষার স্বীকৃতি লাভে রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার নজির কোথাও নেই- একমাত্র বাঙালীর বাংলাদেশ ছাড়া। পাক স্বৈরশাসকদের হীন ষড়যন্ত্রে বাঙালীদের হত্যা নির্যাতন, দমন-পীড়ন নীতিতে এ দেশের সুশীল সমাজ, বৃদ্ধিজীবী কবি সাহিত্যিকগণ গভীরভাবে মর্মাহত হন। তাঁদের শোণিত লেখনি স্পর্শে ভাষা আন্দোলনের পূর্বাপর নানা ভাব ব্যঞ্জনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন : মাহবুব আলম চৌধুরী (১৯২৭-২০০৭), আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (১৯৩৪-২০০১), আব্দুল গনি হাজারী (১৯২৫-১৯৭৬), আব্দুল গাফফার চৌধুরী (জ. ১৯৩৪), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), আল মাহমুদ (জ. ১৯৩৬), আশরাফ সিদ্দিকী (জ. ১৯২৭), জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬), মাহবুব তালুকদার (জ. ১৯৪১), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১১-১৯৭৫), সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩) প্রমুখ। ষাটের দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি ওমর আলী (১৯৩৯-২০১৫) তাঁর অজস্র কবিতায় মাতৃভাষা বাংলা গভীর মমত্ববোধে নানা কৌণিক বিশ্লেষণে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে কবি ওমর আলীর কবিতায় মাতৃভাষা ও একুশের চেতনার প্রতিফলন তুলে ধরার প্রয়াস পাব। মাতৃভাষা মাতৃসম প্রাণের চেয়ে প্রিয়, বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান। গর্ভধারিণী মায়ের মতোই ভাষা মানুষের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার ধন। মাতৃভাষার মাধ্যমেই জীবনের বৃদ্ধি ও স্ফূর্তি। যে কোন মানুষ মাতৃভূমি, মা এবং মাতৃভাষার জন্য অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে হাসতে হাসতে তরুণ ছাত্র যুবকেরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা সে দিন রক্ষা করেছিল। তাদের সে মৃত্যু ছিল গৌরবের, অহঙ্কারের এবং শত বাঙালীর আত্মসম্ভ্রমের এক বিজয় গাঁথার ইতিহাস। মা মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাগো তোমার ভাষা রক্ষার জন্য আমি লক্ষ লক্ষ বার বুকের রক্ত দিয়ে লাল করে তুলব পিচঢালা রাজপথ তোমার ভূমি রক্ষার জন্য প্রাণ দেবো আমাকে পুড়িয়ে মারা হবে- রক্তে রাঙাবো দেহ তুমি আমাকে লক্ষ লক্ষ বার জন্ম দিয়ো মা আমি একশ চুয়াল্লিশ ধারা কাঁটাতারের ব্যাড়িকেট মানব না .....। [“বরকত রফিক সালাম জব্বার বিদ্যাসাগর” ‘রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ছিলাম নয় মাস’] স্বৈরচারী শাসকচক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকার রাজপথে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সমবেত এ দেশের তরুণ ছাত্র যুবারা একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙ্গে মিছিল করে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সেদিন তারা মা এবং মাতৃভাষা রক্ষার আহ্বানে ছুটে এসেছিল সবকিছু তুচ্ছ করে। প্রকৃতপক্ষে মা যখন আহ্বান করে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ভয়ঙ্কর তুফার নদীও সাঁতরিয়ে সন্তান মায়ের কাছে ফিরে আসে। উনিশশো বায়ান্ন সালে বাংলা মায়ের সাহসী সূর্য সন্তানরাও মাতৃভাষা রক্ষায় জীবনোৎসর্গ করেছিল নিদ্বিধায়। ওমর আলীর কাব্য পঙক্তিতে তার মূর্ত প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। তরঙ্গক্ষুব্ধ ভয়ঙ্কর তুফানের নদী সাঁতরিয়ে পার হয়ে তবু এসেছি মাগো তোমার কাছে তুমি যে আসতে লিখেছিলে ¯েœহময় তোর মধুর বর্ণমালায় যুগে যুগে ছেলে মার কাছে এভাবেই আসবে আসবে উনিশশো বায়ান্ন সালে ঝড় ক্ষুব্ধ রক্তে সাঁতার দিয়ে এভাবে এসেছিল মা এবং মাতৃভাষার কাছে রফিক সালাম জব্বার বরকত .......। [“মা মাতৃভাষা এবং মাতৃভূমি” ‘স্বাধীনতার কবিতা’] যে কোন দমন-পীড়ন নীতি হত্যা নির্যাতনে বাঙালী কখনো পরাজয় স্বীকার করে পাক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু দেখে ভীতু হয়নি বরং তাদের প্রতি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে প্রতিবাদ সংগ্রামে রাজপথ বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। মাতৃভাষাকে রক্ষায় জীবন বিলিয়ে দিলেও লক্ষ লক্ষ শহীদ মিনার হয়ে বাঙালীর হৃদয়ে তারা জাগরূক থাকবে অনন্তকাল। তারা মৃত্যুহীন, অমর তারা ফাল্গুনের কৃষ্ণচূড়া ও রক্ত জবার প্রতীকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় গোটা বাঙালির হৃদয়ে চিরভাস্বর। তার কবিতায় সে বিষয়টিই অপূর্ব ছন্দ শিল্পকৌশলে সন্দীপিত হয়ে উঠেছে বারবার। রাইফেলের মুখে নির্ভয়ে বুক পেতে দেয়া মাটিতে পড়ে যাওয়া আবার মিনার হয়ে উঠে দাঁড়ানো চিরকালের মতো রক্তে লাল করে তোলো ধূসর মৃত্তিকা জন্মভূমির কালো পিচ সালাম রফিক বরকত আসাদ মতিউর মুনীর ফজলে রাব্বী পারভীন সুলতানা মুজিব জিয়া। [“হে স্বাধীনতা” ‘স্বাধীনতার কবিতা’] দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালীকে চিরতরে অবদমিত রাখার কূটকৌশলে মেতে ওঠে। প্রথম আঘাতের ক্ষেত্র হিসেবে তারা ভাষা সংস্কৃতিকে বেছে নেয়। কোন জাতির ভাষা সংস্কৃতি ধ্বংস করা মানেই সে জাতি অর্ধমৃত, পঙ্গু এবং অস্তিত্বহীন। এ হীন কৌশল বাস্তবায়নে তারা খুন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, চুয়াল্লিশ ধারাসহ নানা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ওমর আলীর কবিতায় সে কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একটি কবিতা লিখতে গেলেই বায়ানোœ সাল গর্জে ওঠে একটি কবিতা লিখতে গেলেই বাংলাভাষার বলিষ্ট দাবি একটি কবিতা লিখতে গেলেই বরকত আর রফিক সালাম একটি কবিতা লিখতে গেলেই লক্ষ লক্ষ শহীদ মিনার একটি কবিতা লিখতে গেলেই ত্রিশ লক্ষ শহীদের লাশ একটি কবিতা লিখতে গেলেই একাত্তরের স্বাধীন বাংলা [“একটি কবিতা লিখতে গেলেই” ‘স্বাধীনতার কবিতা’] বাঙালী সাহসী সন্তান অন্যায় আপোসে চিরকালই সংগ্রামশীল ও প্রতিবাদমুখর। এরা অন্যায়কে স্বীকার করে না দুর্বল ভীরু কাপুরুষের মতো। জীবনের সবটুকু শক্তি সাহস ও শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও মাতৃভাষার মর্যাদা তারা রক্ষা করেছিল বজ্রকঠিন শ্লোগান তুলে পাকিস্তানী শাসক-শোষকদের চুয়াল্লিশ ধারা বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে। না না শ্লোগানের বজ্রকঠিন শপথে গোটা বাংলাদেশ সেদিন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন-সংগ্রামে। কবির অসংখ্য কবিতায় সে কথারই প্রতিধ্বনি ফুটে উঠেছে। অতবড় নিস্তব্ধতার মধ্যে সমুদ্র গর্জন কিংবা বজ্রকণ্ঠ শুধুমাত্র একটি কথা- না ... সেইতো আমার বাংলা ভাষা মিস্টার জিন্নাহ্ আপনি দেখে যেতে পারেননি ১৯৫২ সালে ৮ই ফাল্গুনে কিংবা ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ১৯৭১-এ ৭ই মার্চে কতবড় দাবদাহ শুধু ঢাকায় নয় সমস্ত বাংলার দিকে দিকে। [“আমার বাংলা ভাষা আমার স্বাধীনতা” ‘স্বাধীনতার কবিতা’] ঋতু চক্রের পরিক্রমায় ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে ফাল্গুন মাসে গাছে গাছে শিমুল-পলাশ ফুল ফোটে। সবুজাভ প্রকৃতি লাল আভায় আবির রাঙা রঙ ধারণ করে। কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল যেন ভাষা শহীদের রক্তের মতোই লক্ষ কোটি বাঙালীর অস্তিত্বে মিশে আছে গভীর মমতা ও ভালোবাসায়। হাজার বছরের ব্যবধানে বাঙালী চেতনার মর্মমূলে স্বাধীন বর্ণমালা, বাংলা ভাষা ও তার জন্য আত্মোৎসর্গকারী ভাষা শহীদের স্মৃতি কখনও বাঙালীর হৃদয় থেকে বিস্মৃত হবে না। ওমর আলীর কবিতায় সে কথারই প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন শিমুল শিমুল লাল হবিগঞ্জে যশোরে ঢাকায় বরিশালে খুলনায় চট্টগ্রামে ফেনীতে রংপুরে রক্ত আর আগুনের দীপশিখা গোটা বাংলায়... শিশিরের অশ্রু যায় আবার অশ্রু আসে ঘুরে। সফেট স্বাধীন বর্ণমালা উদয়াস্ত ঢেউ তুলে নদী মাঠ গ্রামের ওপর দিয়ে যায় পাখা খুলে। [“বুলেট বিদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষা” ‘স্বাধীনতার কবিতা’] পৃথিবীতে মাতৃভাষার চেয়ে সুমধুর আত্মিক অনুভূতি অন্য কোন ভাষায় কখনওই সম্ভব হতে পারে না। মাতৃভাষাতেই মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যে প্রকাশ ও বিকাশ অতি সহজেই সম্ভবÑ যা অন্য কোন বিদেশী ভাষায় নয়। কিন্তু বায়ান্নো সালে বাঙালীর এই ভাষাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে গভীর ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল পাক স্বৈরশাসকেরা। তারা পায়ের তলায় পিষ্ট করতে চেয়েছিল বাংলা ভাষাকে। দীর্ঘ তেইশ বছর বাংলা ভাষা তাদের অপকৌশলে ঘুমরে মরেছে স্বাচ্ছন্দ্যে প্রকাশময়তার সুযোগের অন্তরায়ে। ‘হৃৎপি- ছেঁদা হয়ে রক্ত ঝরে এবং সে জন্য স্বাধীনতা পেছনে দুহাত বাঁধা চোখ বাঁধা দেখতে দেয় না শ্যামলিমা ক্রমাগত ছোট হয়ে আসতে থাকে দু’পায়ের স্বাচ্ছন্দ্যে সীমা বুকের ভেতরে আরো গুমরে মরে মাতৃভাষার মিঠে কথা [“সে জন্য স্বাধীনতা” ‘স্বাধীনতার কবিতা’] ভাষা আন্দোলনের অব্যহিত পরে ষাটের দশকের কবিদের কাব্য ভাবনায় ভাষা আন্দোলন অন্যতম উপজীব্য হয়ে উঠেছিল তৎকালীন কবিদের কবিতায়। ভাষার অমর্যাদা নিয়ে সংক্ষুব্ধ বাঙালির প্রবল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ পাক স্বৈরশাসকদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। মাতৃভাষা নিয়ে কবি ওমর আলীর সহৃদয় হৃদয়সংবেদী কবি চিত্তের ব্যাকুলতা অজস্র কাব্য পঙক্তিতে দেশ প্রেমের প্রগাঢ়তায় এক অনন্য মাত্রায় বাঙময় হয়ে ধরা দিয়েছে। মাতৃভাষা-মা-মাতৃভূমি স্বীয় হৃদয়ের সংবৃত্তিতে একাকার হয়ে মিশে আছে শ্যামল বাংলার প্রান্তরজুড়ে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
×