ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধৃতদের স্বীকারোক্তি ॥ অস্ত্র লুটে জড়িত আরএসও

মিয়ানমারে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ করতে আনসার ক্যাম্পে হামলা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩ মার্চ ২০১৭

মিয়ানমারে সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ করতে আনসার ক্যাম্পে হামলা

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপ রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের অস্ত্র ভা-ার বৃদ্ধি করে সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং আল এ্যাকিনসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী দলের কাছে অস্ত্র ও গুলি সরবরাহ করতে মূলত আনসার ক্যাম্পে হামলা করেছিল সশস্ত্র আরএসও ক্যাডাররা। বিদেশী টাকা হজম করতে মৌলবাদী গোষ্ঠী ও জঙ্গীদের দেয়া নির্দেশ পালন করতে তারা বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র সংগ্রহ ও বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল লুট করা অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের অস্ত্র ভা-ার বৃদ্ধি করা। ধৃত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নূর আলম টেকনাফের শালবন আনসার ক্যাম্পের কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা এবং অস্ত্র লুটের কথা র‌্যাবের কাছে স্বীকার করে এসব তথ্য জানিয়েছে। র‌্যাবের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরএসও লিডার রোহিঙ্গা নূর আলম আরও জানান, ঘটনার দিন নূরুল আলম (ধৃত) ও বড় খায়রুল আমিন দা দিয়ে প্রথমে আনসার ক্যাম্পের বেষ্টনি কেটে ক্যাম্পে প্রবেশ করে। সঙ্গে থাকা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা তাদের অনুসরণ এবং পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আনসার ক্যাম্প অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর ডিউটিরত আনসার সদস্য অজিত বড়ুয়াকে জাপটে ধরে। বেঁধে ফেলে তার হাত-পা ও মুখ। এরপর অপেক্ষমাণ সন্ত্রাসীরাও আনসার ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশ করে ঘুমন্ত অন্য আনসার সদস্যদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে ফেলে। অস্ত্র উচিয়ে আনসারদের জিম্মি করে রাখে আরএসও ক্যাডাররা। ক্যাম্প কমান্ডার (পিসি) আলী হোসেনকে অস্ত্রাগারের চাবি দিতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে দৌড়ে পালাতে চাইলে তাকে গুলি করে হত্যা করেছে নূরুল আলম। পরক্ষণে আরএসওর সংঘবদ্ধ চক্র অস্ত্র ও গুলি লুট করে চম্পট দেয়। ঘটনার পর গ্রেফতার এড়াতে এবং মিয়ানমারে সন্ত্রাসী গ্রুপ আল এ্যাকিনের কাছে লুট করা অস্ত্রগুলো পৌঁছানোর কৌশল বের করতে পাহাড়ের গহীন অরণ্যে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রেখে আত্মগোপনে চলে যায়। কিছুদিন পর মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি স্থানে স্থানান্তর করে অস্ত্রগুলো। এর মধ্যে র‌্যাব সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। তাদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। ধৃত রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্য মতে গোপনে পথ চলা আরম্ভ করে র‌্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা। গ্রেফতার করে ঘটনায় জড়িত আরও কয়েক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি ৩ জনকে আটক করার পর র‌্যাবের তদন্তের পথ চলা সহজতর হয়ে উঠে। তাদের দেয়া তথ্য মতে এক এসএমজি, ছয় ম্যাগজিন, এক চাইনিজ রাইফেল ও দুই এম-টু চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. কমান্ডার আশিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র লুটের ঘটনার হোতা কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত নূরুল আলমকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে র‌্যাব সদস্যরা অস্ত্র উদ্ধারে অভিযানে নামে। বুধবার ভোর রাতে ছয় অস্ত্র (এসএমজি এবং রাইফেল) উদ্ধার করে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৭) কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা। অস্ত্র লুটের মূল নায়ক নূরুল আলম মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার মংডু থানার বাসিন্দা। ধৃত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর দেয়া তথ্য মতে, বুধবার ভোর রাতে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহাড়ী এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালায় র‌্যাব। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ছয় অস্ত্র, দুই ম্যাগজিন ও ছয় রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নূর আলমকে জিজ্ঞাসাবাদে পর জানা যায়, সে ওই সংঘবদ্ধ চক্রটির (আরএসও) দলপতি। গত কয়েক বছর ধরে টেকনাফের শাপলাপুর, বাহারছড়া, লেদা, উখিয়া, কুতুপালং ও রামু এলাকায় ডাকাতি এবং অপহরণ, শেষে মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। ২০১৬ সালের ১৩ মে ভোরে টেকনাফের হ্নীলা নয়াপাড়ার মুচনী এলাকার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার ব্যারাকে সশস্ত্র হামলা চালায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এতে নিহত হন আনসার ক্যাম্পের কমান্ডার মোঃ আলী হোসেন। লুট করা হয় ১১টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬৭০টি গুলি। এদিকে বুধবার বিকেলে অস্ত্র উদ্ধারের স্থান পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে অস্ত্র লুটের ঘটনায় পরিচালিত দীর্ঘ সময়ের অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, আনসার ক্যাম্প থেকে অস্ত্র লুট ও বিভিন্ন স্থান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) ক্যাডাররা মিয়ানমারে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ আল এ্যাকিনের ক্যাডারদের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা চালিয়েছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতায় তা ভেস্তে গেছে। সম্প্রতি র‌্যাব কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা অভিযান চালিয়ে শহরের খুরুশকুল রাস্তার মাথা থেকে দুই বস্তা ভর্তি বোমা তৈরির সরঞ্জাম জব্দ ও মৌলবি করিমূলাহ ও রমিজকে গ্রেফতার করার পর আল এ্যাকিনের বাংলাদেশের দায়িত্ব পালনকারী প্রধান মৌলবি শফিকুর রহমান আত্মগোপনে চলে যায়। টেকনাফ মুচনি ক্যাম্পের মৌলবি ইয়াছিন, নূরুল হক, আমান উলাহ, উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পের মাস্টার একরাম, মৌলবি জালাল, সোয়াইব, শহরের রোমালিয়ারছড়ায় বসবাসরত মৌলবি নূর হোসেন, পাহাড়তলীতে ঘাপটি মেরে থাকা জামিয়ায়ে খায়রিয়ার প্রধান জঙ্গী হাফেজ এমদাদ, রোহিঙ্গা নেতা হাফেজ শফি উলাহ, মৌলবি ইলিয়াছ, মৌলবি শামসু ও মৌলবি মুফিজ এখনও কক্সবাজারে বহাল তবিয়তে রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর ॥ টেকনাফে আনসার ক্যাম্পে হামলা, কমান্ডারকে গুলি করে হত্যা ও অস্ত্র লুটের হোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নূরুল আলমের পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। আনসার ক্যাম্পে হামলা ও অস্ত্র লুটের মামলাটি প্রথমে টেকনাফ পুলিশ তদন্তের দায়িত্বে থাকলেও বর্তমানে র‌্যাব এ মামলাটি তদন্ত করছে। র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. কমান্ডার আশিকুর রহমান সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নূরুল আলমের পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
×