ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাড়ে ১৩ লাখ অবৈধ চালকের হাতে যাত্রীর নিরাপত্তা!

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩ মার্চ ২০১৭

সাড়ে ১৩ লাখ অবৈধ চালকের হাতে যাত্রীর নিরাপত্তা!

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যানবাহন সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৯ লাখ। বিপরীতে তালিকাভুক্ত চালকের সংখ্যা ১৬ লাখ। সরকারী হিসার অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ অবৈধ চালকের হাতে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা! যাত্রী কল্যাণে নিয়োজিত বেসরকারী সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে অবৈধ চালকের সংখ্যা ৪৪ লাখের বেশি। বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা রয়েছে। এই পরিবহনটির যেমন অনুমোদন নেই, তেমনি চালকরাও লাইসেন্সপ্রাপ্ত নন। এর বেশিরভাগ চালকই আগে রিক্সা চালাতেন। এছাড়াও অনুমোদনহীন আরও অন্তত ২২ লাখ যান রয়েছে। অথচ এসব যানবাহন বসে নেই। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে বেশিরভাগই। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত চালকদের তিন ধরনের লাইসেন্স দেয়া হয়। এজন্য সারাদেশে বিআরটিএ অনুমোদিত চালক প্রশিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১৪২! দেশে রেজিস্টার্ড ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৯৮। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অনুমোদিত ড্রাইভিং প্রশিক্ষকদের একটা বড় অংশ কোন কাজ করেন না। ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও প্রতিষ্ঠানের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। অর্থাৎ ইচ্ছেমতো চলছে ট্রেনিং সেন্টারগুলো। এমন বাস্তবতাই পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন সেক্টরের প্রয়োজনীয় নজরদারির যথেষ্ট অভাব। পাশাপাশি দক্ষ চালক তৈরির মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতারও ঘাটতি রয়েছে। এই সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো, খোঁড়া অজুহাতে পরিবহন শ্রমিকরা মালিকদের স্বার্থরক্ষায় বার বার আন্দোলনে নামছেন। কিন্তু নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে কোন কিছুই বলেন না। দক্ষ চালক তৈরির সুনির্দিষ্ট দাবিতে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোও নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। সাড়ে ২৯ লাখ গাড়ি ১৬ লাখ চালক ॥ সরকারের পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ বলছে, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে তালিকাভুক্ত যানবাহনের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪৮ হাজার ৯০৬। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছে প্রায় ১৬ লাখ! যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে ৬০ লাখের বেশি চালক রয়েছে। অবৈধ চালকের সংখ্যা ৪৪ লাখ। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক আছে মাত্র ১২ ভাগ। ২২ লাখ অনুমোদনহীন যানবাহন দাবড়ে বেড়াচ্ছে সড়ক-মহাসড়কে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সুপারিশে কোন রকম পরীক্ষা ছাড়াই এক লাখ ৯০ হাজার চালক পেয়েছেন ভারি যানবাহন চালানোর সনদ! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে সারাদেশে গাড়ি নামছে চার শতাধিক। এর মধ্যে ঢাকাতেই নামছে ৩১৭। গাড়ির বিপরীতে গড়ে দিনে ১০ চালকও তৈরি হচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় নতুন চালক তৈরিতে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালক তৈরির ক্ষেত্রে মূল উদ্যোক্তা বেসরকারী খাত। তবে মান নিশ্চিত করতে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে কঠোর ভূমিকা পালনের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা। তাছাড়া বিপুলসংখ্যক অবৈধ চালক এখন রাস্তায়। এমন বাস্তবতায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন। তাদের পরামর্শ দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিআরটিএকে রেগুলেটরি অথরিটি ঘোষণা করা হোক। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ চালক তৈরিসহ পরিবহনের ফিটনেস পরীক্ষার দায়িত্বে থাকবে। এতে সেবার মান বাড়বে। কমবে সড়ক দুর্ঘটনা। উন্নত দেশগুলোতে এভাবেই পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। প্রয়োজন সদিচ্ছা ॥ সময় গেলেও দেশের পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হয়নি। বলতে গেলে একটি অরাজক অবস্থা এই সেক্টর ঘিরে। গত তিন বছরে পরিবহন সেক্টরে ১১৬ ধর্মঘটের ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার মিলিয়ে চলতি বছর হয়েছে সাতটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ চালক তৈরি সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। সাজাও হবে না। এতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির মতো কর্মসূচীরও প্রয়োজন হবে না পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই চালকের দ-ের প্রেক্ষিতে গত প্রায় এক সপ্তাহজুড়ে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে আফ্রিকা মহাদেশে। দুর্ঘটনার দিক বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের মধ্যে ১৩তম। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের এক গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা হয় ইউরোপের দেশগুলোতে। সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা হয় সিঙ্গাপুরে। দেশটির লক্ষ্য পর্যায়ক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। গবেষণায় আরও বলা হয়, বিশ্বের ৮৮টি দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে। বেড়েছে ৮৭টি দেশে। তবে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি উৎপাদনের দেশ জাপানে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কম। ৪২ ভাগ চালকের কোন শাস্তি হয় না ॥ একটি বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যত মামলা হয় এর মধ্যে ৪২ ভাগ চালকের কোন শাস্তি হয় না। যদিও বুধবার সংসদে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত (৩ বছর) ৯৫ হাজার ৫৭৯টি মামলার মাধ্যমে মোট ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৬ হাজার ৯১২ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ সময়ে এক হাজার ৬১৮ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রদান এবং ৪ হাজার ৪৮ গাড়ি ডাম্পিং স্টেশনে প্রেরণ করা হয়েছে। ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, দেশে ৯০ ভাগ চালকের হাতে বৈধ-অবৈধ লাইসেন্স আছে। ২০ ভাগ চালক কোন প্রকার পরীক্ষা না দিয়েই সনদপত্র সংগ্রহ করেছেন। ৯২ ভাগ চালক ঘুষ দিয়ে নিয়েছেন লাইসেন্স। ৫৪ ভাগ চালকের লাইসেন্স প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা ছিল। সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, মাত্র ৯ ভাগ চালক মাসিক বেতনে গাড়ি চালায়। বাকি চালকরা চুক্তিতে গাড়ি পরিচালনা করে। বাড়তি আয়ের মানসিকতা থেকে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা বেড়েছে। এতে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রাও বাড়ছে। সড়ক নিরাপত্তায় জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে চালকদের সমালোচনা করে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেই তারা ফ্রি স্টাইলে গাড়ি চালাতে শুরু করেন। নিজেদের ‘পথের রাজা’ ভাবেন। রাস্তার দুর্ঘটনার কথা একবারের জন্যও তারা ভাবেন না। সড়ক দুর্ঘটনা নির্মূল করতে হলে সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। উন্নত সেবার প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি ॥ বর্তমানে ব্যাঙ্ককের যানবাহনের সংখ্যা ৭৫ লাখ। থাইল্যান্ডে সাড়ে তিন কোটি। বিশাল এ পরিবহন রাজ্যের দেখভাল কিন্তু দেশটির সরকারী পরিবহন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার হাতে নেই। উন্নত দেশগুলোতে সঠিক সেবা ও মান নিশ্চিত করার জন্য সরকারী সংস্থা ‘রেগুলেটরি বডি’ হিসেবে কাজ করছে, যা আমাদের দেশে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে সেবার মান বাড়ছে। দক্ষ চালক তৈরি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা কমছে। সেই সঙ্গে আনফিট কোন পরিবহন রাস্তায় চলতে পারছে না। চোখে দেখে ফিটনেস সনদ দেয়ার প্রবণতাও নেই সেখানে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। তেমনি নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের জবাবদিহিতাও রয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, অনেক আগেই দক্ষ চালক তৈরি ও যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন ছিল। ২০০৭ সালে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদ পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কাজ করেছে। এতে প্রস্তাবটি আর আলোর মুখ দেখেনি। ফলে প্রতিবছর গাড়ি বেড়েছে। এখনও বাড়ছে কিন্তু চালক বাড়েনি। দক্ষ চালক তৈরি হচ্ছে না। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। মরছে মানুষ। অনেকে দুর্ঘটনায় সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও সরকারী পরিবহন অথরিটি চালক তৈরি ও যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করে না। এটি বেসরকারীভাবে পরিচালিত হয়। আমাদের দেশেও বিআরটিএর নির্দিষ্ট জনবল দিয়ে বিশাল কাজ নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয়। বাস্তবে তাই হচ্ছে। বিআরটিএর পরিবহন রেজিস্ট্রেশনের বিপরীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা অনেক কম কিন্তু লাখ লাখ গাড়ি তো বসে নেই। সবই রাস্তায় চলছে। তাহলে সড়কের নিরাপত্তা কিভাবে হবে। তাছাড়া কমার্শিয়াল গাড়ি প্রতি দু’জন চালক থাকার নিয়ম রয়েছে। এ হিসাবে গাড়ির বিপরীতে চালকের সংখ্যা আরও কম হওয়ার ফলে সব মিলিয়ে দেশে চালকের ঘাটতি অনেক দিনের। এটা নতুন কিছু নয়। দক্ষ চালক তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, সারাদেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১৬ লাখের কাছাকাছি। তবে অবৈধ চালক আছে কিনা আমাদের জানা নেই। অবৈধভাবে বা লাইসেন্স ছাড়া কেউ গাড়ি চালালে যারা মাঠে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের ধরার কথা। সরকারী এই কর্মকর্তা বলছেন, দেশে অবৈধ চালক থাকার কথা নয়। যদি থেকে থাকে তাহলে হাইওয়ে পুলিশ, মহানগর পুলিশ, ট্রাফিক বিভাগ, ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা পুলিশের দেখা বা ধরার কথা। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি দুর্ঘটনা রোধ বা চালক সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার। দক্ষ চালক তৈরির কাজ চলছে বলেও জানান তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বাংলাদেশের ওপরে আছেÑ চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। কিন্তু এই দেশগুলোর প্রতিটিতে যানবাহনের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের অভাবে দুর্ঘটনার মাত্রা কমছে না। তাই এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
×