ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইন্টারনেটের যুগে অনলাইন বনাম মুদ্রিত সংবাদপত্র!

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৩ মার্চ ২০১৭

ইন্টারনেটের যুগে অনলাইন বনাম মুদ্রিত সংবাদপত্র!

এবিএম মূসা ও সেতারা মূসা ফাউন্ডেশন থেকে আজীবন সম্মাননা পাওয়ায় বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খানকে অভিনন্দন। সেই আজীবন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি প্রিন্ট মিডিয়ার অতীত ও বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যত শঙ্কার এক সুনিপুণ চিত্র তুলে ধরে যে মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন যা পরের দিন দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে এজন্য তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি বাংলাদেশের অধিকাংশ খ্যাতনামা কলামিস্টের লেখা নিয়মিত পাঠ করলেও প্রথিতযশা বর্ষীয়ান সাংবাদিক তোয়াব খানের লেখা পাঠ করার সুযোগ খুব একটা পাইনি। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন এক সামরিক কর্মকর্তা প্রকাশিত কোন সংবাদ বা পত্রিকা প্রকাশের কোন বিষয় নিয়ে জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানকে ডেকে পাঠালে পরের দিনই তিনি পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘কোন সামরিক কর্মকর্তা এভাবে পত্রিকার সম্পাদককে ডেকে পাঠাতে পারেন কিনা’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সেই সাহসী লেখার পর আর কোন লেখা পাঠ করার সুযোগ পেয়েছি বলে স্মরণে আসে না। দীর্ঘদিন পর তার লেখা ‘মৃত সত্যবাবুকে নতুন করে মারা’ শিরোনামে লেখাটি পড়ে খুব ভাল লেগেছে। লেখাটি এতটাই তথ্যসমৃদ্ধ যে, এটা পাঠ করে শুধু বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতই নয়, সমগ্র বিশ্বের সংবাদপত্র সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমানে ডিজিটাল যুগের পাগলা ঘোড়ার দৌরাত্ম্যে পত্রিকার জগতে সম্ভাবনা এবং শঙ্কার যে দোলাচল শুরু হয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং খুবই সময়োপযোগী। সংবাদপত্রের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের জন্য লেখাটি নিঃসন্দেহে তথ্য-উপাত্তে ভরপুর একটি সুস্পষ্ট বার্তা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা চালু ছিল এবং এই পত্রিকাগুলো সেই সময় সাংবাদিকতার কঠিন নিয়মনীতি অনুসরণ করে প্রকাশ হতো এবং এখনও হয় বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ফলে কোন সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত না হয়ে কখনই তা প্রকাশ করা হতো না। এসব পত্রিকায় এমন কোন সংবাদ বা লেখা ছাপা হতো না, যা কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বা মানবতার বিরুদ্ধে যায়। এই ধারার কিছুটা ছন্দপতন ঘটে স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে যখন তাদেরই সমর্থন নিয়ে একটি বিশেষ গ্রুপের হীনস্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যেহেতু বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে দূরে সরিয়ে এক ধরনের মতলববাজ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য নিয়ে পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ ঘটে, তাই এতে প্রকাশিত সংবাদ এবং লেখাগুলো ছিল স্বাধীনতা ও প্রগতিশীলতার বিপক্ষে। সবসময় উত্তেজনা ছড়িয়ে এবং এক ধরনের মনগড়া সংবাদ ও লেখা প্রকাশ করে পত্রিকাটি একটি বিশেষ মহলের কাছে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়ে যায়। কথিত আছে স্বৈরাচার পতনের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে অপ্রত্যাশিত পরাজয় হয়েছিল তার পেছনে সেই পত্রিকার একচেটিয়া অপপ্রচার অনেকাংশে দায়ী। কারণ, তখন সেই পত্রিকার অপপ্রচার মোকাবেলা করার মতো আর কোন পত্রিকা ছিল না বললেই চলে। এর পরই স্বাধীনতা ও প্রগতিশীলতার পক্ষের মানুষ তাদের হয়ে কথা বলার জন্য পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। এরই ফলে একের পর এক নতুন নতুন পত্রিকা প্রকাশ হতে হতে এখন একটি বিশাল প্রিন্ট মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। এখন দেশে যে কি পরিমাণ দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ হয় তার একটি সুন্দর পরিসংখ্যান আছে তোয়াব খানের এই লেখায়। বিশাল এক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই খাতে। পাঠকেরও অনেক স্বাধীনতা বেড়েছে পত্রিকা পাঠের ক্ষেত্রে। অসাধারণ এক প্রতিযোগিতাপূর্ণ সংবাদ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই প্রিন্ট মিডিয়া। প্রতিযোগিতার তীব্রতা এতই ব্যাপক যে, বলা যায় এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে এই খাতে। কে কার আগে কোন সংবাদ প্রকাশ করবে তার যেমন একটি প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়, ঠিক তেমনি কে কত রংচং লাগিয়ে সংবাদটি পরিবেশন করতে পারে সেই প্রতিযোগিতাও নেহাত কম নয়। এই প্রবণতা অবশ্য এখন বিশ্ব সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশে এর মাত্রাটা একটু বেশি। সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে এ রকম অসম প্রতিযোগিতার কারণে যে মাঝে-মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং অনেক অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম হয় না, এমন নয়। এখন আর আগের মতো কোন সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে চটজলদি প্রকাশ করে দেয়া হয়। আগে একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, একবার কোন পত্রিকা ভুল সংবাদ প্রকাশের কারণে ক্ষমা চাইলে সেই পত্রিকা আর প্রকাশনার জগতে টিকে থাকতে পারত না। এখন অবশ্য সেই নীতির খুবই অভাব। এখন সর্বত্রই এক ধরনের নীতিহীনতার প্রবণতা দারুণভাবে জেঁকে বসেছে। ফলে এর প্রভাব সংবাদ মাধ্যমেও কিছুটা পড়বে এটাই স্বাভাবিক। বিগত পঁচিশ বছরে আমাদের দেশে মুদ্রিত পত্রিকার জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। জাতি ও সমাজের দর্পণ হিসেবে পরিচিত এই খাতের পথ চলায় পঁচিশ বছর তেমন কোন সময় নয়। আবার বর্তমান যুগের যে হাওয়া তাতে একেবারে কম সময়ও নয়। তাছাড়া এই শতাব্দীর পঁচিশ বছর আর আগের শতাব্দীর পঁচিশ বছর মোটেই এক কথা নয়। বর্তমানে পৃথিবী বড় বেশি অগ্রসরমান এবং পরিবর্তনশীল। এর গতির সঙ্গে পেরে উঠা অনেকের পক্ষেই দুরূহ ব্যাপার। এই বাস্তবতা আবার আমাদের দেশের পত্রিকাগুলোর বেলায় আরও অধিক মাত্রায় প্রযোজ্য। সংবাদকর্মীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনি তাদের বেতন-ভাতাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিকভাবে পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও পত্রিকার প্রতি পাঠকের সংখ্যা তেমন বেড়েছে বলে মনে হয় না। কেননা পাঠকরা অসংখ্য পত্রিকার মাঝে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ফলে একদিকে পত্রিকা চালানোর খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে তেমনি আয় বৃদ্ধি পায়নি বললেই চলে। এখন পত্রিকাগুলোর উল্লেখযোগ্য উপার্জনের উৎস হলো বিজ্ঞাপন, তাও সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটলেও বিপণনের নানাবিধ পন্থা আবিষ্কৃত হওয়ায় পত্রিকা অনুযায়ী বিজ্ঞাপনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি। এতে করে পত্রিকা চালানোর ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে নানারকম প্রতিকূল পরিবেশ, যা কাটিয়ে টিকে থাকা যে কোন পত্রিকার জন্যই কষ্টসাধ্য। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অনলাইনের দৌরাত্ম্য। ইন্টারনেটের বদৌলতে এখন সবকিছু অনলাইনে পাওয়া যায়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে কিছু ঘটা মাত্র তা অনলাইনে চলে আসে এবং মানুষ তা মুহূর্তের মধ্যে জেনে যায়। ফলে অনেক পাঠকই এখন মুদ্রিত পত্রিকা পাঠের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বলে ধারণা করা হয়। তথাকথিত সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এতে আরও বেশি ইন্ধন যোগাচ্ছে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে যা খুশি তা লিখে মানুষের দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি জাতি ও সমাজকে দারুণভাবে বিভ্রান্ত করতে পারে খুব সহজে। এই উদ্ভট পরিস্থিতির সঙ্গে কোন পত্রিকা পেরে উঠবে না এটাই স্বাভাবিক। কারণ, পত্রিকায় কোন কিছু প্রকাশের সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব সম্পাদক এবং প্রকাশককে নিতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন কিছু প্রকাশের জন্য কারও কোন দায়-দায়িত্ব নেই। আর এই অসম প্রতিযোগিতার খপ্পরে পড়ে অনেক পত্রিকাও অনলাইনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে তাদের মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ করে পুরোপুরি অনলাইন সংস্করণে চলে যাচ্ছে। কিন্তু অনলাইন সংস্করণ যে মুদ্রিত পত্রিকার বিকল্প হতে পারে না, এই কথাটা অনেক পাঠকও যেমন বুঝতে চাইছে না, তেমনি বহু পত্রিকা মালিকও মানতে চাইছে না। এক সময়ের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দি নিউজউইক’ মাত্র কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই তাদের মুদ্রিত সংস্করণ বন্ধ করে পুরোপুরি অনলাইন সংস্করণে চলে যায়। দীর্ঘদিন পাঠ করার ফলে পত্রিকাটির প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও আমি সাবসক্রিপশন বন্ধ করে দেই। অনেকে হয়ত এখনও জানেই না যে, সেই আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দি নিউজউইক’ আজও চালু আছে কিনা। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পত্রিকা পাঠ করে জ্ঞানার্জন করতে হলে মুদ্রিত পত্রিকাই পাঠ করতে হবে। তেমনি পাঠক সমাজে টিকে থাকতে হলে মুদ্রিত পত্রিকা প্রকাশ করেই সেটা করতে হবে। যতই ডিজিটাল যুগের দিকে আমরা ধাবিত হই না কেন, যতই আমাদের চারপাশ অনলাইন পত্রিকায় সয়লাব হয়ে যাক না কেন, মুদ্রিত পত্রিকার চাহিদা অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এ কারণেই ইন্টারনেটের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত আমেরিকা, কানাডাতে আজও মুদ্রিত পত্রিকাগুলো তার ঐতিহ্য বজায় রেখে চলছে পাঠকের হাতে হাতে। বিভিন্ন পত্রিকা অনলাইন সংস্করণ চালু করলেও তা মুদ্রিত সংস্করণের স্থান দখল করতে পারেনি। তাই আমাদের দেশেও আগামীতে যতই অনলাইন সংস্করণের জোয়ার আসুক না কেন মুদ্রিত পত্রিকার স্থান কেউ নিতে পারবে না। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা
×