ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মহিলা পরিষদ নেত্রী আয়েশা খানমের অভিমত

বাল্যবিবাহ নিরোধ বিশেষ বিধানের সুবিধা নেবে ধর্ষকরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২ মার্চ ২০১৭

বাল্যবিবাহ নিরোধ বিশেষ বিধানের সুবিধা নেবে ধর্ষকরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যারা নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী নয়, যারা ধর্ষক তারা বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’র সুযোগ নেবে যার ফলে নারীরা আরও নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হবে। একই সঙ্গে এই আইনটি সকল আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বিশেষ বিধান বহাল রেখে যে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ পাস হয়েছে তার ঘোর প্রতিবাদে এ মন্তব্য করেন তিনি। ১ মার্চ সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে (৭০টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম), গার্লস নট ব্রাইডস বাংলাদেশ, চাইল্ড রাইটস এ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন এবং জাগো ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে বিশেষ বিধান রেখে পাস করার প্রতিবাদে’ বিকেল তিনটায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের নিচতলায় সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ১৯২৯ সালে যে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে সেই আইনটিকে যুগোপযোগী করার জন্য ২০১৪ সালে পদক্ষেপ নেয়া হয়। এই আইনটি কিভাবে যুগোপযোগী করা যায় তার জন্য সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আমরা বসেছি সুপারিশ দিয়েছি। কিন্তু গত পরশু অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ যখন এই আইনটি পাস হলো তা দেখে আমরা বিস্মিত। যে বিশেষ বিধান রেখে এই আইনটি পাস হয়েছে তা আইনটির মূল গতিকে নষ্ট করে ফেলবে। এ সময় চাইল্ড রাইটস এ্যাডভোকেসি ফোরামের পক্ষ থেকে লায়লা খন্দকার বলেন ১৮-এর নিচে যে কেউ শিশু। এই আইনে বেশকিছু বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট নয় যেগুলো আমাদের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই বিষয়গুলো হলো অপ্রাপ্ত বয়স এখানে বয়স কত হবে তা উল্লেখ নেই, এই আইনে অভিভাবকের কথা বলা হয়েছে কিন্তু অভিভাবক পিতামাতা ছাড়া আর কে হবে সেই বিষয়ে উল্লেখ নেই, এই আইনে শিশুর মতামতের কথা বলা হয়নি, এই আইনে বিশেষ বিধান কি সেই বিষয়েও কোন কিছু উল্লেখ নেই। কাজেই এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণরূপে আমাদের কাছে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। বর্তমান নারীবান্ধব সরকারের এই ধরনের একটি পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এটি টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হবে বলে মনে করেন নারী নেত্রীরা। তারা জানান, বিশেষ বিধান যুক্ত করে এই আইনটি পাস করার ফলে, কন্যাশিশুর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর করার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে, শিশু বিবাহকে বৈধতা দেয়া হবে। এই বিধানের অধীনে যাদের বিবাহ হবে, রাষ্ট্রীয় অন্যান্য আইন, সংবিধান, এসডিজি, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদ বিশেষ করে শিশু অধিকার সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। এছাড়া, অপরিণত বয়সে নারীদের বিবাহকে বৈধতা দেয়ার ফলে নারীর স্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার বাড়বে। সেই সঙ্গে এই বিধানের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত নারী নির্যাতন করেও অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারে। পাশাপাশি নারী শিক্ষার চলমান অগ্রগতি ব্যাহত হবে, ঝরে পড়ার হার বাড়বে। অপরিণত কন্যাশিশুকে বিবাহের সুযোগ দিয়ে তাকে পারিবারিক নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেয়া হবে শুধু এই আইনের বিশেষ বিধানের যুক্তি দেখিয়ে। মোট কথা, এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত নারী-পুরুষ সমতার আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, এই সরকারের মাধ্যমে আমরা বেশকিছু ভাল ভাল আইন পেয়েছি কিন্তু সব আইনের প্রয়োগ দেখিনি। আইন তৈরি হয় অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য। কিন্তু সেই আইন যখন নতুন কোন অপরাধের জন্ম দেবে তা আমরা মেনে নেব না। এই আইনের বিশেষ বিধান বাতিলের মাধ্যমে পুনরায় আইন গঠন করার দাবি জানাচ্ছি। মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয় কাজেই আইন যেন মানুষের জন্য হুমকি না হয় সেই বিষয়টি বিবেচনার জন্য আবারও সরকারের কাছে দাবি জানান আয়েশা খানম। সব শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এখনও প্রত্যাশার জায়গা আছে। আমরা রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেব। এছাড়া আইনটি সংসদে পাস হয়েছে কিন্তু স্পীকার এখনও এতে স্বাক্ষর করেননি। তিনি যেন এই আইনে স্বাক্ষর না করেন এ বিষয়ে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক রোকেয়া কবির, গার্লস নট ব্রইডসের পক্ষ থেকে হাবিবুর রহমান, স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভলপমেন্টের রঞ্জন কর্মকার, কন্যাশিশু এ্যাডভোকেসি ফোরামের নাছিমা আক্তার জলি, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ডেপুটি ডিরেক্টর রওশন জাহান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের বনশ্রী মিত্র, এ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের সেলিনা আহমদ, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের রেহানা বেগম, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের তাহমিনা হক প্রমুখ। বক্তারা সকলে এই আইনের পরিবর্তনের দাবিতে একমত পোষণ করেন। এবং তারা বলেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদ ও নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই আইন আমাদের সমাজকে আরও পিছিয়ে নিয়ে যাবে। নারী যতটুকু অগ্রসর হয়েছে এই আইন তাকে আরও পিছিয়ে নিয়ে যাবে। নারী আন্দোলনের এত দিনে যে অর্জন সেই অর্জনগুলোকে যেন ধরে রেখে নারী আন্দোলন নারীর ক্ষমতায়নের পথকে সুগম করতে পারে তার জন্য সরকারের কাছে আবারও এই আইনের পরিবর্তনের দাবি রাখেন বক্তারা। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে বিশেষ বিধান বাতিল করে কন্যাশিশুর ন্যূনতম বিয়ের বয়স শর্তহীনভাবে ১৮ করার দাবিতে বিভিন্ন প্রতিবাদ, কর্মসূচী পালন করা হয়। সেই সঙ্গে জাতীয় সংসদে বিশেষ বিধান বহাল রেখেই বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭ পাস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ, বিস্ময়, ও ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
×