ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

টার্মিনালে টার্মিনালে যাত্রী দুর্ভোগ চরমে-

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২ মার্চ ২০১৭

টার্মিনালে টার্মিনালে যাত্রী দুর্ভোগ চরমে-

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বুধবার বেলা সাড়ে এগারোটা। গাবতলী বাস টার্মিনালের একটি সিমেন্টের পিলারে হেলান দিয়ে উদাস নয়নে বসে আছেন সাঈদ মিয়া (৪২)। পরনের পোশাক যথেষ্ট ময়লা। শুকনো মুখ। মাথার চুলে তেলের দেখা নেই কয়েক দিন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাছে গিয়ে কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা করতেই চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ল। বলল, সাতক্ষীরা যাওয়ার জন্য দু’দিন ধরে ঘুরছি। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘটের জন্য যেতে পারছি না। পকেটের পয়সা ফুরিয়ে এসেছে। শুধু টিকেট আর সামান্য কিছু টাকা আছে। এ নিয়েই বাড়ি চলে যেতে হচ্ছে। কারণ আমি খুব অসুস্থ। হাত দিয়ে দেখালেন তার ডান গাল। দেখা গেল গাল ফুলে একাকার। যন্ত্রণায় তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। অসহ্য যন্ত্রণায় অস্থির মানুষটি আস্তে আস্তে জানালেন, তিনি মূলত দিনমুজুর। বাড়ি সদরে। বাড়িতে স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট। প্রায় দশ বছর ধরেই তিনি দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। সাতক্ষীরাতেও তিনি দিনমজুর করেন। সেখানে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জিনিস বস্তায় ভরে ট্রাকে তোলেন। এরপর সেই ভরা ট্রাকের সঙ্গে ঢাকার কাওরান বাজারে আসেন। মাল নামিয়ে দেন। মাল নামানোর পর তিনি অন্য ট্রাকেরও মাল নামিয়ে সামান্য কিছু বাড়তি রোজগার করেন। এরপর যে ট্রাকে করে তিনি আসেন, সেই ট্রাকে করেই আবার ফেরত যান। এতে তার বাড়তি রোজগার হলেও, ভাড়া হিসেবে তার টাকা খরচ হয় না। এ করেই তার সংসার চলছে। যথারীতি তিনি সোমবার সাতক্ষীরা থেকে মাল বোঝাই ট্রাকে কাওরানবাজার এসেছেন। মাল নামিয়ে দেন। এরপর আশপাশের আড়তে মাল নামিয়ে সামান্য কিছু বাড়তি রোজগার করেন। সোমবার রাতে তার ডান গালে দাঁতের মাড়ি ফুলে যন্ত্রণা শুরু হয়। তখন অতটা যন্ত্রণা ছিল না। মাড়ি ফুলে যন্ত্রণা হওয়ায় তিনি বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু যে ট্রাকে করে তিনি এসেছেন সে ট্রাক আর যেতে পারেনি। মঙ্গলবার থেকে পরিবহন ধর্মঘট শুরুর কথা শুনে সোমবার রাতেই ট্রাক চালক ট্রাক স্ট্যান্ডে রেখে চালক অন্যত্র চলে যান। এমন পরিস্থিতিতে তিনি সোমবার মাঝরাতে গাবতলী বাস টার্মিনালে আসেন। গাবতলী গিয়ে টিকেট কেটে অপেক্ষা করতে থাকেন। সকাল হয়ে যায়, কিন্তু বাস ছাড়ে না। এরপর থেকে তিনি টার্মিনালেই অবস্থান করছেন। গাল আরও ফুলেছে। যন্ত্রণাও বেড়েছে। তার কাছে যা টাকা ছিল তা দিয়ে টিকেট কেটেছেন, খাওয়াদাওয়া সেরেছেন। আর সামান্য কিছু টাকা পকেটে আছে। সে টাকায় দাঁতের চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়। তাই তিনি অপেক্ষা করছেন বাড়ি যাওয়ার জন্য। বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করাবেন। পরিবারকে বিষয়টি মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন। পরিবারের সবাই চিন্তায় রয়েছে। শুধু সাঈদ মিয়া নয়, এমন বিপদে পড়েছেন অনেকেই, রমজান আলী (৩২) এদের একজন। জরুরী কাজে বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার জন্য কুমিল্লা থেকে গাবতলী এসে সকাল আটটা থেকে বসে আছেন। বাস ছাড়ছে না। অথচ তার বাড়ি না গেলেই নয়। এমন দুর্ভোগের চিত্র গাবতলীতে অহরহ। পুরো ঢাকাসহ সারাদেশেই এমন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে। ঢাকার অন্যান্য জায়গার চেয়ে গাবতলীতে দুর্ভোগের চিত্র ছিল আরও বেশি। কারণ সেখানকার পরিবহন শ্রমিকরা এ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত যেতে বাধা দিয়েছে। রাতে একটি এ্যাম্বুলেন্সের চালককে মারধর করেছে শ্রমিকরা। এদিকে সকাল থেকেই রাজধানীতে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। তাদের যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ছিল রিক্সা আর সিএনজি অটোরিক্সা। এমন সুযোগে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রিক্সা আর সিএনজি অটো চালকরা। বিড়ম্বনার এখানেই শেষ নয়। গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদসহ প্রতিটি বাস টার্মিনালে খাবারের দোকানগুলো পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ফলে যারা টার্মিনালে গিয়ে বিপদে পড়েছেন, তাদের অনেককেই একপ্রকার না খেয়ে থাকতে হয়েছে। খাবারের মধ্যে ফেরিওয়ালাদের চানাচুর, মুড়ি, বাদাম, শশা ও গাজর বিক্রি করতে দেখা গেছে। অনেককেই ক্ষুধার যন্ত্রণায় তাই খেতে দেখা গেছে। গাবতলী এলাকার বেশ কয়েকটি খাবারের দোকানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের ভয়ে দোকান বন্ধ করে রেখেছেন। কারণ এসব দোকান খোলা রাখলে শ্রমিক নেতারা অনেক সময়ই গালমন্দ ও খারাপ ব্যবহার এমনকি মারধরও করে। ক্ষুধার্ত যাত্রীদের হেঁটে বহু দূরের হোটেল রেস্তরাঁয় গিয়ে খেতে দেখা গেছে। গাবতলী বাস টার্মিনালে আটকাপড়া অধিকাংশ যাত্রীদের আমিনবাজারের বিভিন্ন গলিতে থাকা ছোট ছোট হোটেলে গিয়ে খেয়ে কোনমতে জীবন বাঁচিয়েছেন। যেসব হোটেল খোলা রাখা হয়েছে, সেসব হোটেলও চলছে অনেকটা রোজার মাসের মতো। অনেক হোটেলের সামনে পর্দা দিয়ে ঘিরে রাখতে দেখা গেছে। কারণ হিসেবে হোটেল মালিকরা জানিয়েছেন, একদিনে ধুলো ময়লা থেকে রক্ষা আরেক দিকে পরিবহন মালিক শ্রমিক পক্ষের লোকজনের রোষানল থেকে বাঁচার বুদ্ধি। হোটেলের সামনে সর্বক্ষণিক একজন লোক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে বলা হয়েছে, মিছিল এগিয়ে গেলেই ইশারা দিবি। সঙ্গে সঙ্গে দোকান বন্ধ করে দেয়া হবে। এভাবেই মঙ্গলবার ও বুধবার গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাস বাস টার্মিনালের আশপাশের খাবার হোটেলগুলো খোলা রাখা হয়েছিল। এমনকি শ্রমিকদের ভয়ে হকারদের উপস্থিতিও ছিল তুলনামূলক অনেক কম। শুধু খাবারের দোকান নয়, গাবতলীসহ বাস টামির্নালের আশপাশের বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। এতে করে মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। পরিবহন ধর্মঘটে শুধু সাধারণ মানুষ বা যাত্রীদের দুর্ভোগ নয়, পরিবহনের সঙ্গে জড়িত চালক ও হেলপারসহ অন্যদের ভোগান্তিও ছিল চরমে। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জগামী যাত্রীসেবা পরিবহনের এক চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছিলেন, পরিবহন ধর্মঘট শুরুর পর থেকে রোজগার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিন তিনি ১২শ’ টাকা পেয়ে থাকেন। অথচ পরিবহন ধর্মঘটের পর দিনে পাচ্ছেন ২শ’ টাকা। মালিকের তরফ থেকে খোরাকী হিসেবে দিনে দুশ’ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। তাই দিয়ে কোনমতে খাওয়া-দাওয়া করছি। আর বাস পাহারা দিচ্ছি। গাবতলীতে কোন হোটেল রেস্তরাঁ খোলা নেই। খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করতে পারছি না। দরজা খুলে বাসের ভেতরে ঘুমানো যায় না। নানা ধরনের লোকজন এসে নানাভাবে বিরক্ত করে। অনেক সময় গাড়ির মাল চুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মশার যন্ত্রণায় ঘুমানো যায় না। কিন্তু গাড়ি ফেলে যাওয়ারও কোন উপায় নেই। মঙ্গলবার থেকে গাবতলীতে আটকা পড়ে আছি। বাড়িতে যেতে পারছি না। বাড়ির খোঁজখবর রাখতে হচ্ছে ফোনে। বাড়ির লোকজন দুশ্চিন্তায় রয়েছে। এমন কথা জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকদের অনেকেই।
×