ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায় ও বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ - স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২ মার্চ ২০১৭

কানাডার ফেডারেল কোর্টের রায় ও বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ - স্বদেশ রায়

কানাডার ফেডারেল কোর্ট, মোহাম্মদ জুয়েল হোসেন গাজী বনাম দি মিনিস্ট্রি অব সিটিজেনশিপ এ্যান্ড ইমিগ্রেশন মামলার যে রায়টি দিয়েছে, এই রায় নিয়ে বাংলাদেশে যেমন আলোচনা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের যে দায় ছিল তা সঠিক পালিত হয়নি। বিচারপতি হেনরি এস ব্রাউনের ৩২ পৃষ্ঠার এ রায়টি বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকরা আমরা দেশের ও বিদেশের পত্রপত্রিকায় এ কথা লিখে আসছি, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে একটি নিবন্ধিত ও জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত। শুধু এখানেই শেষ নয়, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো ওই দলটিকে মডারেট মুসলিমের দল বলে আদর করে। বিশেষ করে আমেরিকা এই আদর বেশি করে। পশ্চিমারা বর্তমান মুহূর্তে কাউকে মডারেট মুসলিম বলে আদর করলেই আতঙ্কিত হতে হয়। কারণ তারা এখন নানা ছলনায় মুসলিমদের নিয়ে নানা ধরনের খেলা খেলছে। যেমন সম্প্রতি আমেরিকা প্রবাসী একজন সিরিয়ান স্কলারের একটি বই পড়তে গিয়ে অবাক হলাম। বইটা শেষ করে মনে হলো কতভাবেই না মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কারণ পৃথিবীর ইতিহাস যারা জানেন, তাদের কাছে নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না, পশ্চিমারা যখন সভ্যতাকেই চিনত না সে সময়ে সিরিয়া পৃথিবীতে সভ্যতার আলো ছড়িয়েছে। হ্যাঁ, এ কথা সত্য, তার পরে সিরিয়ার ওপর দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে, কিন্তু তার পরেও এই সত্য মানতে হবে, যে কোন সভ্য জাতির অন্তপ্রবাহে সভ্যতা সব সময়ই প্রবহমান থাকে। কিছু লোকাচার, কিছু ব্যক্তির ব্যক্তিগত চরিত্র উল্লেখ করেÑ তাকেই মুসলমানের সভ্যতাহীনতা হিসেবে দেখাতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু যে আমেরিকা এই প্রচার করছে, তারা ভালভাবেই জানে, তাদের হোয়াইট বাইবেলিক বেল্টে এর থেকেও অনেক বেশি ট্রাডিশন আছে, যার অনেক কিছুকে কুসংস্কার বা ধর্মীয় অন্ধত্ব হিসেবে দেখানো যেতে পারে। কিন্তু এটাই আমেরিকার সবটুকু নয়। বাস্তবে তারা কিন্তু এই সব বিচারে যাচ্ছে না। তাদের মূল উদ্দেশ্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি অপপ্রচার দাঁড় করানো। কেন করছে তাও যে বোঝা যাচ্ছে না তা নয়, তা বিস্তারিত লিখতে হলে বই লিখতে হয়। ঠিক সম্পাদকীয় কলামে সম্ভব নয়। তা ছাড়া এ লেখায় লিখতে গেলে লেখা ভিন্ন দিকে চলে যাবে। যাহোক, এতদিন যাদের পশ্চিমারা মডারেট মুসলিম বলছিল তাদের একটি দেশ- কানাডার ফেডারেল কোর্ট কিন্তু সত্য কথা বলেছে। কোর্টের জাস্টিসিয়ার চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। তাই পৃথিবীতে কী ঘটছে তা জাস্টিস হেনরি এস ব্রাউন নজরে নেননি। তিনি যা সত্য তাই রায় দিয়েছেন। জাস্টিস হেনরি এস ব্রাউনের ৩২ পৃষ্ঠার রায়ে জুয়েল গাজীর আপীলকে ডিসমিস করেছেন। যার ভেতর দিয়ে কানাডার ইমিগ্রেশনের দেয়া রায় বহাল রয়েছে। কেন তিনি ওই রায় বহাল রাখলেন তা তথ্য-প্রমাণসহ আইনগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কানাডার ইমিগ্রেশন এ্যান্ড রিফিউজি প্রোটেকশন এ্যাক্ট অনুযায়ী, সে দেশের ইমিগ্রেশন অফিসার ওই এ্যাক্টের ৩৪(১) (এফ) এবং (সি)-এর আওতায় মোহাম্মদ জুয়েল গাজীকে সে দেশে বাস করার অনুমতি বাতিল করেছেন। কানাডার ফেডারেল কোর্টের বিচারপতি হেনরি এস ব্রাউন ইমিগ্রেশন অফিসারের ওই বাতিল আদেশকেই বহাল রেখেছেন এবং বলে দিয়েছেন, নতুন করে আর কোন প্রত্যয়ন বা আদেশ এই আবেদনের ওপর দেয়া হবে না। যার ভেতর দিয়ে মোহাম্মদ জুয়েল গাজী ইমিগ্রেশনের আদেশের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে যে আবেদন করেছিলেন ওই আবেদনও প্রত্যাখ্যাত হলো, সঙ্গে সঙ্গে সঠিক প্রমাণিত হলো কানাডার ইমিগ্রেশন অফিসারের রায়। কানাডার ইমিগ্রেশন এ্যান্ড রিফিউজি প্রোটেকশন আইনের ৩৪ এর যে যে ধারায় জুয়েল গাজীর সে দেশে থাকার অধিকার বাতিল করা হয়েছে, এর কোনটি কিন্তু শুধু ব্যক্তি জুয়েল গাজীর জন্য নয়, সংগঠন বিএনপির কারণে। কানাডার ইমিগ্রেশন এ্যান্ড রিফিউজি প্রটেকশন আইনের ৩৪(১)-এর (এফ) এবং (সি) জুয়েল গাজীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে। ৩৪ এর (এফ) এ বলা হচ্ছে। (f) being a member of an organi“ation that there are reasonable grounds to believe engages, has engaged or will engage in acts referred to in paragraph(a), (B), (B.1) or (C). (এমন একটি সংগঠনের সদস্য, যে সংগঠনটি ওই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে, জড়িত আছে এবং ভবিষ্যতে জড়িত থাকবে এমনটি বিশ্বাস করার প্রকৃত কারণ আছে। যে কারণগুলো প্যারাগ্রাফ (এ) (বি) (বি.১) অথবা (সি) এ উল্লেখ করা হয়েছে) । কানাডার ফেডারেল কোর্ট রায়ের শুরুতে ন্যাচার অব দি ম্যাটার বা বিষয়টির ধরন উল্লেখ করতে গিয়ে বিচারক বলছেন, Òdated May 16, 2016, in which the applicantÕs application for permanent residence (PR) as a protected person was rejected on the grounds of inadmissibility pursuant to paragraphs 34(1)(F) (membership) and (c) [engaging in terrorism] of the IRPA [the Decision].' বিচারপতির রায়ের এ অংশ থেকে স্পষ্ট, কেন জুয়েল গাজী কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারছেন না। কারণ কানাডার ওই আইনের ৩৪ ধারার (এফ) অনুযায়ী তার সদস্য পদ (বিশেষ সংগঠনে) এবং (সি) অনুযায়ী তিনি সন্ত্রাসে জড়িত। তাই ৩৪ এর (এফ) ও (সি) অনুযায়ী জুয়েল গাজী সে দেশে বসবাসের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। ৩৪ এর (এফ) ধারা আগেই এ লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে কার্যকর হবে শুধু (এফ) ধারা অনুযায়ী তিনি কোন ধরনের সংগঠনের সদস্য; এবং (সি) ধারা অনুযায়ী সংগঠনের ধরনটি চিহ্নিত হবে। সি ধারায় বলা হয়েছে, “(প) বহমধমরহম রহ ঃবৎৎড়ৎরংস,” তাই সি ধারাসহ এফ ধারার অর্থ দাঁড়ায়, তিনি এমন একটি সংগঠনের সদস্য, যে সংগঠনটি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত, জড়িত আছে এবং ভবিষ্যতে জড়িত থাকবে এমনটি বিশ্বাস করার প্রকৃত কারণ আছে। এখন জুয়েল গাজী কোন সংগঠনের সদস্য এবং তারা কীভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় তা ওই রায়ের ৫, ৬ ও ৭ অনুচ্ছেদের মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। ৫ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে, জুয়েল গাজী ১৯৯৭ সালে ঢাকা কলেজে বিএনপির ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে বিএনপির রাজনীতি শুরু করে। ৬, অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করছে, বিএনপিতে মেম্বারশিপ যে কেউই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে। ৭ অনুচ্ছেদে আবেদনকারী অর্থাৎ জুয়েল গাজীর বক্তব্যের সার-সংক্ষেপে বলা হয়েছে তারা কীভাবে সন্ত্রাস চালায়। সেখানে বলা হচ্ছে, তারা জনগণকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে, পিস্তল দিয়ে মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে, মানুষের ওপর বোমা মারে এবং দোকানে আগুন দেয়। এছাড়া এই রায়ে আরও বলা হয়েছে, বিএনপির ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা পথশিশুদের বাসের ওপর পেট্রোল বোমা ছুড়তে ব্যবহার করে। বিএনপি ২০১১ থেকে ২০১৫ অবধি এ দেশে সর্বোচ্চ সন্ত্রাস চালিয়েছে। জামায়াত ও হেফাজতকে সঙ্গে নিয়ে মূলত বিএনপি আইএসএ’র মতোই সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গী বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করেছে। তারা কত মানুষ হত্যা করেছে, কী পরিমাণ সম্পদ ধ্বংস করেছে তার সামান্য কিছু বিবরণী কানাডার ফেড়ারেল কোর্টের ওই রায়ে আছে। কিন্তু সে তথ্য বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। কারণ দেশের মানুষ ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট দেখেছে। দেখেছে বাসের ভেতর কয়লা হয়ে যাওয়া মানুষের লাশ। দেখেছে টঙ্গীর মনিরের পুড়ে যাওয়া দেহ আর মনিরের পিতার আর্তচিৎকার। বিএনপির এই সব সন্ত্রাসের নায়কদের বিরুদ্ধে মামলাও আছে। কিন্তু তার পরেও সত্য হলো বিএনপি বাংলাদেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের কোন কোর্ট থেকে এখনও বলা হয়নি, এই দলটি সন্ত্রাসী দল। বাংলাদেশের কোন কোর্ট থেকে যে এ কথা বলা হয়নি এবং বিএনপি যে এখনও এ দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তার জন্য মূলত দায়ী সরকার। কারণ শত শত মানুষ হত্যা ও হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করার পরেও এই সরকার ওই সব সন্ত্রাসবাদীর বিচারের জন্য কোন বিশেষ আদালতের ব্যবস্থা করেনি। এমনকি সন্ত্রাস দমন আইনকে এই সন্ত্রাসীদের দ্রুত বিচারের উপযোগী করেনি। অন্যদিকে সরকারের প্রশাসনও ঠিকমতো কাজ করে না। দেখা যায় বিএনপির যে নেতা অবরোধের ঘোষণা দিয়ে মূলত মানুষ পুড়িয়ে হত্যা ও দেশের সম্পদ নষ্টের ডাক দিচ্ছেন- তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে ৫৪ ধারায়। তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে দুর্বল চার্জশীট। সেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ ক্রিমিনাল এ্যাক্ট। এই সব হত্যাকা-ের ও সম্পদ ধ্বংসের সুপ্রীম রেসপনসিবিলিটি যারা- তাদের এ নিয়ে মামলা হয়েছে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি। কিন্তু কোন বিশেষ আদালত না থাকায়, কোন বিশেষ আইন না থাকায় খুব ধীরগতিতে চলছে তার তদন্ত। যে কারণে কোন মামলার আজও অবধি সর্বোচ্চ রায় হয়নি এবং বিএনপি যে একটি সন্ত্রাসী দল তার কোন আইনগত ভিত্তি তৈরি হয়নি বাংলাদেশে। এই সুযোগ নিয়েই আইএস বা আল কায়েদার মতোই সন্ত্রাস চালাচ্ছে পশ্চিমাদের আদরের এই মডারেট মুসলিম দলটি। পশ্চিমারাও চাচ্ছে কীভাবে এই দলটিকে তারা বাংলাদেশে আরও বেশি কাজে লাগিয়ে দেশটিকে সন্ত্রাসবাদকবলিত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। পশ্চিমাদের এবং তাদের আরেক ভৃত্য পাকিস্তানের ইঙ্গিত পেয়েই কিন্তু কোন জঙ্গী অপারেশনের পরেই ওই অপারেশন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপির মহাসচিব এমনকি তাদের চেয়ারপার্সনও। পশ্চিমারা ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এই দেশটিকে মুসলিম সন্ত্রাসবাদী দেশ বানাতে, চায় এ নিয়ে এখনও যদি কারও সন্দেহ থাকে তাহলে তিনি ভুল করছেন। এ কাজে তাদের নানা ধরনের এজেন্ট কাজ করছে। সে কাজে শুধু বিএনপির ভেতরের নয়, বিএনপির বাইরেরও বহু লোক জড়িত। এমনকি জড়িত আওয়ামী লীগের প্রশ্রয় পায় এমন কিছু মানুষও। কানাডার ফেডারেল কোর্টের এই রায়টির বাংলাদেশে কোন আইনগত ভিত্তি নেই। তবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত চলছে তা ঠেকাতে আইনগতভাবে কোন্ পথে এগুনো যায় তার একটি আলোর রেখা হিসেবে এ রায়টি যদি এ দেশের পরিচালকরা নিতে পারেন, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলের হবে। আর এই আলোর রেখা অনুসরণ করে, বাংলাদেশ যত দ্রুত বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে ও তার আইনগত ভিত্তি দিতে পারবে ততই দেশের জন্য ভাল। কারণ সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী হিসেবে থাকলে তাদের মোকাবেলা করা যায় কিন্তু নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে সন্ত্রাস করলে তাদের মোকাবেলা করা কঠিন। অন্যদিকে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের মোড়লরা তাদের নিয়ে মডারেট মডারেট খেলা খেলে দেশকে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে তুলে দেয়ার পথ পায়। [email protected]
×