ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একুশে গ্রন্থমেলা সমাপ্ত

এবার মেলায় আসা নতুন ৩৬৪৬টি বইয়ের মধ্যে মানসম্পন্ন ৮৫৮টি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১ মার্চ ২০১৭

এবার মেলায় আসা নতুন ৩৬৪৬টি বইয়ের মধ্যে মানসম্পন্ন ৮৫৮টি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা শেষ হয়েছে। এবার মেলায় নতুন বই এসেছে ৩৬৪৬টি। এগুলোর মধ্যে ৮৫৮টি বই মানসম্পন্ন বলে মনে করছে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান মিলে রেকর্ডসংখ্যক ৪১১টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬৭ ইউনিট স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানান পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ। সন্ধ্যায় মূল মঞ্চে তিনি এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির দেয়া তথ্য মতে, এবার ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৬৪৬টি নতুন প্রকাশিত হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, এর চেয়ে বেশিসংখ্যক বই বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এবার আমরা বাংলা একাডেমির একটি কমিটিকে দিয়ে প্রাপ্ত সকল বইয়ের মান প্রাথমিকভাবে নিরূপণের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে নতুন ৩৬৪৬টি বইয়ের মধ্যে ৮৫৮টি মানসম্পন্ন। এটি নিঃসন্দেহে আশার কথা। এক বছরের গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে ৮৫৮টি মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশ সহজ কথা নয়। এবার মোড়ক উন্মোচনের জন্য সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে ‘মোড়ক উন্মোচন’ মঞ্চ স্থাপন করা হয়। প্রত্যেক বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য এবার ১০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি ধার্য করা হয়। এবার মোট ৮৬৭টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। মোট বিক্রি ॥ গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমির বই ৩০ শতাংশ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি মোট ১ কোটি ৫৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩শ’ ৬ টাকার বই বিক্রি করেছে। ২০১৬ সালের তুলনায় এই বিক্রি ২২ লাখ টাকা বেশি। সুতরাং গতকালের বিক্রিসহ বাংলা একাডেমির মোট বিক্রি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে। আমরা জানি, গতবার সমগ্র মেলায় ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। এবার ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং গতকালের সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করলে বলা যায় যে, এবার গ্রন্থমেলায় মোট ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। রেকর্ডসংখ্যক স্টল ॥ এবার বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান মিলে রেকর্ডসংখ্যক অর্থাৎ ৪১১টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬৭ ইউনিট স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়। বাংলা একাডেমির দুটি প্যাভিলিয়ন ছিল। একটি সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে এবং অন্যটি একাডেমি প্রাঙ্গণে। এবার এক ইউনিটের ২০৩টি, দুই ইউনিটের ১৩৯টি, তিন ইউনিটের ৩৪টি এবং চার ইউনিটের ২১টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। শিশুদের জন্য ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৬১টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। নীতিমালা ভঙ্গের জন্য ১৯টি স্টল চিহ্নিত ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার নীতিমালা ও নিয়মাবলি লঙ্ঘন করায়, টাস্কফোর্সের সুপারিশের ভিত্তিতে, ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে ১০টির বিরুদ্ধে নীতিমালার ৬.১ ধারা অর্থাৎ বিদেশী বই বিক্রির এবং ৯টির বিরুদ্ধে নীতিমালার ১৩.১৩ ও ১৩.১৪ ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। চারটি স্মৃতি পুরস্কার ॥ গুণীজনদের স্মৃতিতে একাডেমি এবার গ্রন্থমেলায় চারটি পুরস্কার প্রদান করেছে। এগুলো হলো : চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার। আমরা জানি আজ একটু পরই এসব পুরস্কার প্রদান করা হবে। শিশুকর্নার, শিশুপ্রহর ও প্রতিযোগিতা ॥ শিশুকর্নারে ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৬১টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এছাড়া এবার শিশুকর্নারকে বিশেষভাবে সজানো হয়েছিল। মেলায় শিশুদের চিত্ত-বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। শিশু-কিশোরদের জন্য বাংলা একাডেমি সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা, সঙ্গীত এবং চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। এবার ৮ দিন শিশুপ্রহর ছিল। এসব দিনে এবং অন্যান্য দিনেও শিশুরা তাদের অভিভাকদের সঙ্গে মেলায় এসেছে, আনন্দ করেছে এবং ইচ্ছামতো বই কিনেছে। লিটলম্যাগ চত্বর ॥ ১০০টি লিটল ম্যাগাজিনকে বর্ধমান হাউসের দক্ষিণ পাশে লিটলম্যাগ চত্বরে স্থান বরাদ্দ দেয়া হয়। এবার লিটলম্যাগ চত্বরে স্টল পরিচালনার জন্য নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়। যে লিটলম্যাগের নাম স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রত্যেকে কেবল সেই লিটলম্যাগ প্রদর্শন ও বিক্রি করবেন এই শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। উৎসর্গকরণ ॥ গ্রন্থমেলার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশকে ১২টি চত্বরে বিভক্ত করা হয়। ১২ জন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও লেখকের নামে উৎসর্গ করা হয়। যাঁদের সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের ১২টি চত্বর উৎসর্গ করা হয় তাঁরা হলেন : সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, সরদার জয়েনউদদীন, নূরজাহান বেগম, আহসান হাবীব, আব্দুল গফুর হালী, মদনমোহন তর্কালংকার, আমীর হোসেন চৌধুরী ও দীনেশচন্দ্র সেন। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ উৎসর্গ করা হয় শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে। মেলায় নতুন সংযোজন ॥ এবার আঙ্গিক সৌন্দর্য ও সামগ্রিক পরিকল্পনায় কিছু নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়। গতবারের তুলনায় এবার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে পূর্ব দিকের চেয়ে পশ্চিম দিকে বেশি স্টলের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে মেলা বড় রাস্তার আরও কাছাকাছি আসে। ৮০ হাজার বর্গফুট জায়গায় ইট বিছানো হয়। অনেক জায়গা মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়। বৃষ্টির কারণে যাতে ক্ষতি না-হয় সেজন্য স্টলে ত্রিপলের বদলে টিনের ছাউনি দেয়া হয়। নতুন বই প্রদর্শনের জন্য এবার নতুন বইয়ের স্টল বানানো হয়। এই স্টলে প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত যত নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে হুইল চেয়ারের সংখ্যা গতবারের চেয়ে আরও বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এবারই প্রথম প্রকাশকদের দুটি প্রতিষ্ঠানÑ বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিকে দুটি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। সদস্য সচিব নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, গ্রন্থমেলায় আমাদের এখনও একটি বড় সমস্যা রয়ে গেছে। এ বিষয়ে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে প্রতিবছরই দাবি উত্থাপন করা হয়। আমরা জানি যে পাঠক ও ক্রেতারাও এই সমস্যাটির সমাধান চান। সেটি হলো একটি সুপরিসর পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা। মেলা যখন আয়োজিত হয় তখন এই বিষয়টির সমাধান সম্ভব হয়ে উঠে না। আমরা আশা করব আগামী বছর শুরু থেকেই আমরা মাননীয়মন্ত্রী মহোদয়ের বিশেষ চেষ্টায় একটি সুন্দর বড় পার্কিং ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত গ্রন্থমেলায় সরকার বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে। কিন্তু এই পৃষ্ঠপোষকতার সুবিধাটি কি সাধারণ পাঠক-ক্রেতা পাচ্ছেন? গ্রন্থমেলায় যেসব বই বিক্রি হয় সেগুলোর অধিকাংশই অনেক দামী বলে পাঠকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। যেসব বই হাজার হাজার কপি বিক্রি হয় বলে দাবি করা হয় কিংবা গ্রন্থমেলায় বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হয় সেসব বইয়ের দাম এত বেশি হওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ থাকে না। সুতরাং আমরা আশা করব বইয়ের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগামী বছর আমরা আরও বেশি সুচিন্তিত মানদ- প্রয়োগ করতে পারব। তৃতীয়ত লেখকদের পক্ষ থেকে বিশেষ করে তরুণ লেখকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে, তারা উপযুক্ত সম্মানী বা রয়্যালিটি পাচ্ছেন না। কয়েকজন জনপ্রিয় লেখক ছাড়া বাকি অনেকেই রয়্যালিটি পান না বলেই অভিযোগ করেন। বই সৃষ্টির প্রধান কারিগর হলেন লেখক। লেখক বঞ্চিত হলে প্রকাশনা-শিল্পে প্রকৃত পেশাদারিত্ব আসবে বলে অনেকেই মনে করেন না। আমরা আশা করব আগামীবার থেকে গ্রন্থমেলায় সরকারের যে পৃষ্ঠাপোষকতা তার সুবিধা প্রকাশক লেখক ও বৃহত্তর পাঠক সমাজ সবাই পাবে।
×