ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এত এত বই, বিপুল সংগ্রহ- পড়া হবে তো?

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১ মার্চ ২০১৭

এত এত বই, বিপুল সংগ্রহ- পড়া হবে তো?

মোরসালিন মিজান ॥ বিপুল বই। গত বছরের মেলার পর কিছু প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি সব এবারের মেলায়। মেলা উপলক্ষেই বেশি বই হয় এখন। এবারও হয়েছে। গল্প উপন্যাস কবিতা অনুবাদ সাহিত্য ভ্রমণ ইত্যাদি তো আছেই। আরও অনেক বিষয়ের ওপর লেখা হয়েছে বই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল খোলা প্রান্তরে বই সাজানো ছিল দীর্ঘ এক মাস। দেশের প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের নতুন এবং বিভিন্ন সময় প্রকাশিত বই এখানে প্রদর্শন করেছে। আয়োজক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল। প্যাভিলিয়ন। মেলায় আগত মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। বিভিন্ন বয়সী মানুষের একটাই ছিল গন্তব্য। প্রতিটি স্টল ঘুরে বেরিয়েছেন তারা। গল্প আড্ডা জমিয়েছে। সেলফি যুগ এখন। সেই বিশেষ কায়দায় তুলেছেন ছবিও। এবং লক্ষণীয় যে, তারা প্রচুর বইও সংগ্রহ করেছেন। জনপ্রিয় ধারার বইয়ের বিক্রি যথারীতি চোখে পড়েছে। একইসঙ্গে ভিড় লেগে ছিল অপেক্ষাকৃত সিরিয়াস বইয়ের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে। প্যাভিলিয়ন ও স্টলের সামনে দাঁড়ানোর জায়গা করে নেয়াও কঠিন কাজ ছিল। সবাই হুড়োহুড়ি করে বই কিনেছেন। নতুন বই আসতে না আসতেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল। শেষ দিন প্রথমার প্যাভিলিয়নে গিয়ে দেখা গেল, মানুষ আর মানুষ। কাছে গিয়ে বই হাতে নিয়ে দেখার কোন সুযোগ নেই। অনেক দূর থেকে বইয়ের নাম বলে অর্ডার করা হচ্ছিল। একবার। দুইবার। তিনবার। তার পর কাজ হচ্ছিল। ব্যাগ ভর্তি হয়ে আসছিল বই। মেলার সময় শেষ হয়ে যাওয়ার পর, যখন লাইট বন্ধ করে দেয়া হচ্ছিল তখনও বই সংগ্রহের লাইন ছোট হচ্ছিল না। এ অবস্থায় এক নারী পাঠক ভিড় ঠেলে সামনে গেলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘কমলালেবুটা দেন। রাখতে বলে গিয়েছিলাম এক কপি।’ কমলা লেবু মানে, জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে শাহাদুজ্জামানের লেখা গ্রন্থ ‘একজন কমলালেবু।’ ততক্ষণে সব কপি শেষ। বিক্রয়কর্মী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, শেষ হয়ে গেছে। তাতেই চটে যান অপেক্ষমাণ পাঠক। বলেন, আমি তো টাকা দিয়ে যেতে চেয়ে ছিলাম। তখন রাখলেন না। এখন বলছেন, বই শেষ। মানে কী? এক পর্যায়ে রাগ করে তিনি চলে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন বিক্রয়কর্মীরা ব্যাপক খোঁজাখুঁজি করে বের করলেন একটি লেখক কপি। সেটিই ডেকে পাঠকের হাতে তুলে দেয়া হলো। আগের দিন মাওলা ব্রাদার্সের প্যাভিলিয়নে কিছু সময় দাঁড়িয়ে দেখা গেল, কোন বই পড়ে থাকছে না। সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই খ-ে প্রকাশিত রচনাসমগ্র কিনতে এসেছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের পরিচিত মুখ কানিজ আকলিমা সুলতানা। টাকা হাতে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর বিক্রয়কর্মী জানালেন, শেষ হয়ে গেছে সব কপি। তখন প্যাভিলিয়নেই ছিলেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহমেদ মাহমুদুল হক। বললেন, সব ধরনের বই যাচ্ছে। নতুন পুরনো কোনটাই বাদ যাচ্ছে না। আমরা তো অনেক নির্বাচিত প্রকাশ বই করি। এর পরও থাকছে না এক কপি। এমনকি যাদের প্রকাশনার মান তেমন ভাল নয়, তাদের বইও বিক্রি হচ্ছে। এর পর মজা করে তিনি বলেন, ঈদের আগের চাঁদ রাতে টুপি আতর ইত্যাদি কেনে না লোকে, মেলার শেষ দিনে সেই অবস্থা! আসলে তাই। শেষ দিনের মেলা দেখে ব্যাপার এমনই মনে হয়েছে। কিন্তু এত যে বই প্রকাশিত হলো, কেনা হলো, পড়া হবে তো? নাকি ড্রইংরুমের শোভাবর্ধন করবে শুধু? হ্যাঁ, অমর একুশে গ্রন্থমেলার শেষদিনে উঠেছে এমন প্রশ্নও। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে একাধিক উত্তর। আশাবাদীর সংখ্যাই বেশি। তারা বলেছেন, বইয়ের প্রতি প্রেম না থাকলে কেউ প্রতিদিন মেলায় আসতেন না। গল্প আড্ডা বেড়ানো হয়েছে। কিন্তু সবই ছিল বই কেন্দ্রিক। এক মাস ধরে বই খোঁজা টাকা দিয়ে বই কেনা, ফেলে রাখার জন্য নয়। আর যাদের সমালোচকের দৃষ্টি তারা বলেছেন, বই পড়ার সময় এখন কারও নেই। সবাই ফেসবুকে ব্যস্ত। ইন্টারনেটে কাটাচ্ছেন। বই যা কেনা হয়েছে তা মূলত ড্রইংরুমের সজ্জায় কাজ দেবে। এক কবি তো তীর্যক মন্তব্য করতে গিয়ে এমনও বললেনÑ এখন সুপারশপ কালচার। শপিংমলে গিয়ে ট্রলি ভর্তি করে বাজার না করলে প্র্যাস্টিজ থাকে না। বইয়ের মেলায়ও তাদের কেউ কেউ আসেননিÑ এমন কথা বলা যাবে না! এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আরও থাকতে পারে। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বই জ্ঞানের উৎস। ঘরে বই থাকলে কেউ না কেউ কখনও না কখনও পড়বেন। ফিরে আসবে পাঠাভ্যাস। ভাষা শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত অমর একুশে গ্রন্থমেলা ফিরিয়ে আনবে পাঠাভ্যাস। সমাজের অন্ধকার কুপম-ুকতা দূর করে আলোকিত ভোর আসবে। এমন আশা অবশ্যই বেঁচে থাকবে। থাকুক।
×