ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বস্তুনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতাকে অন্য উচ্চতায় নেন মূসা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১ মার্চ ২০১৭

বস্তুনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতাকে অন্য উচ্চতায় নেন মূসা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতির সঙ্কটকালে পথ দেখিয়েছিলেন এবিএম মূসা। তিনি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে দেশে সাংবাদিকতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আপোসহীন সাংবাদিকতার মূলমন্ত্র ধারণ করলেই তাকে আমরা প্রকৃতভাবে স্মরণ করতে পারব। তিনি সহজভাবে অকপটে সত্যকে উচ্চারণ করেছেন সাহসের সঙ্গে। বর্তমান সময়ের সাংবাদিকদের অবশ্যই এবিএম মূসার কর্মময় জীবন পাঠ করতে হবে, তা না হলে আদর্শ ও সাহসী সাংবাদিক হওয়া সম্ভব নয়। মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এবিএম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ বি এম মূসার ৮৬তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘আজীবন সম্মাননা ও স্মারক বক্তৃতা’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা। অনুষ্ঠানে সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানকে এবিএম মূসা আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানে নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক আব্দুর রহিম, শওকত মাহমুদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এরশাদ মজুমদার, প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, কবি হাসান হাফিজ, সিনিয়র সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সৈয়দ আবুল মকসুদ উত্তরীয় পরিয়ে দেন তোয়াব খানকে। অনুষ্ঠানে তোয়াব খানের হাতে এবিএম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট তুলে দেন সেতারা মূসা। এসময় তার হাতে একুশের মাসে বই উপহার তুলে দেন এবিএম মূসার দুই কন্যা মারিয়াম সুলতানা ও শারমিন সুলতানা। অনুষ্ঠানে ‘সংবাদপত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শিরোনামে স্মারক বক্তৃতা উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর। আজীবন সম্মাননা পাওয়া তোয়াব খান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, অগ্রজ সাংবাদিক এ বি এম মূসা সাংবাদিকতার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে যে উচ্চতর ধারা সৃষ্টি করে গেছেন সেই পথ অনুসরণ করেই আমার নিরন্তর অভিযাত্রা। সাংবাদিকতার বিপদসঙ্কুল পথে সত্য ও ন্যায়ের অভিমুখে যেন বিপথগামী না হয়। তবে সাংবাদিকতার উন্নতর বিকাশের ধারায় নানা পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায়। সাতচল্লিশের উপমহাদেশে ভাগ হওয়ার পর পর্যায়ক্রমগুলো সুস্পষ্ট হতে থাকে। একেবারে প্রাথমিক অবস্থার আদিম রূপ থেকে লাইনো-রোটারির পথ ধরে অফসেট হয়ে এখন ডিজিটাল মুদ্রণের যুগ। পর্যায়ক্রমের নেতৃত্বও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। তোয়াব খান বলেন, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কাজী মোহাম্মাদ ইদ্রিসের পথ পরিক্রমায় স্বৈরসামরিক শাসক আইয়ুব খানের যুগে এই বাংলায় সাংবাদিকতায় থ্রি মাস্কেটিয়ার্স বা ত্রিরতœ- তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী ও আব্দুস সালামের অভ্যুদয়। পরবর্তীকালে আধুনিক সাংবাদিকতার প্রবর্তনে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, এবিএম মূসা প্রমুখ একটি সুস্পষ্ট ধারার সৃষ্টি করেন। বৈরী পরিবেশে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্য উপস্থাপনই এই ধারার প্রধান প্রতিপাদ্য। এটাকে অবশ্যই এ্যাকটিভিস্ট সাংবাদিকতা রূপে অভিহিত করা চলে। সংবাদপত্রের চলমান ধারা তুলে ধরে তোয়াব খান বলেন, অনলাইন সংবাদপত্র সংবাদপত্রের অংশ। তবে ব্যক্তি পর্যায়ের সামাজিক মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদানে বাণিজ্যিক ভিত্তির প্রশ্ন অবান্তর। এ ধরনের তথ্যের একটি বিপজ্জনক দিক হলো, সত্য ও ব্যক্তি পর্যবেক্ষণের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকতে পারে। সামাজিক মাধ্যম কোন কোন সময় নিউজ ব্রেকের মতো কিছু সৃষ্টি করতে পারলেও স্থায়ী আস্থা অর্জনে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। অনুষ্ঠানে স্মারক বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, বাংলাদেশে এখন যুগসংক্রান্তি চলছে। সংবাদক্ষেত্রে (মিডিয়া) এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপকহারে। যুগের প্রয়োজনে এখন নতুন নতুন সংবাদক্ষেত্র (মিডিয়া) সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে পড়লেও এ সুযোগ আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ খুব কমই নিতে পেরেছেন। তাই যে স্বর্ণালি নিকট অতীত ছিল বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জগতে তা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। সংবাদপত্রের মালিক ও কর্মীদের মধ্যে স্বাজাত্যবোধ ও ভাষাপ্রীতি না থাকলে এ থেকে পরিত্রাণের পথ নেই। অনুষ্ঠানের সভাপতি ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আমি খুব বেশি কথা বলি না। শুধু এতটুকু বলতে চাই, এ বি এম মূসার কর্মময় জীবন পাঠ না করলে কেউ সাহসী সাংবাদিক হতে পারবেন না। তিনি অনেক সাংবাদিকের পিতৃতুল্য হলেও মিশতে পেরেছেন বন্ধুর মতো। এটাই ছিল তার বড় গুণ। সবাইকে তিনি খুব আপন করে নিতে পারতেন। নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, মূসা ভাইয়ের হাত ধরেই সাংবাদিকতা শিখেছি। তিনি এত সুন্দর সুন্দর হেডিং দিতেন যা পাঠককে মুগ্ধ করত। তিনি ছিলেন আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক। মূসা ভাই রাগী মানুষ ছিলেন। তবে তিনি রাগ করতেন, কাজের জন্য। আবার সেই রাগ তিনি কখনই পুষে রাখতেন না। একটু পরেই তিনি রাগ ভুলে যেতেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, জাতীয় প্রেসক্লাব ছিল মূসা ভাইয়ের সেকেন্ড হোম। জুনিয়র-সিনিয়র সবার সঙ্গে মজার মজার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেন। মানুষ হিসাবে উনি ছিলেন খুব বড় মাপের মানুষ। মূসা ভাইকে হারিয়ে আমরা একজন সাংবাদিকতার অভিভাবককে হারিয়েছি। আমি তার উত্তরসূরিদের কাছে তার আদর্শ ধরে রাখার আহ্বান জানাচ্ছি। এছাড়া চমৎকার স্মারক বক্তৃতা প্রদানের জন্য ড. সৌমিত্র শেখরকে ধন্যবাদ জানান ফরিদা ইয়াসমিন। শওকত মাহমুদ বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন নিরন্তর। মূসা ভাইয়ের মতো একজন সাহসী সাংবাদিক আমরা কখনও দেখিনি। যেখানেই তিনি অন্যায় দেখেছেন সেখানেই লড়াই করেছেন। বার্ধ্যকের ভাব নিয়েও তিনি টকশোতে গিয়েছেন মানুষের কথা বলতে। আজ যারা সাংবাদিকতা করছেন তাদের অনেকেরই ভাষাজ্ঞানও নেই। সমাজের বিত্তশালীদের অনুকম্পা লাভের জন্যই আজ অনেকে সাংবাদিকতা করতে আসেন। এটা আমাদের জন্য বিপর্যয়ের বড় কারণ। শেষে বলতে চাই বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে হলে অবশ্যই এবিএম মূসার নাম লিখতে হবে। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, সাংবাদিকতা থেকে একজন মানুষ জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসেছেন। খুব কম মানুষই এভাবে উঠে আসতে পারেন। এবিএম মূসা তেমনই একজন। এদেশের সাংবাদিকতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি। সাহসী ও বলিষ্ঠ মানুষ ছিলেন তিনি। প্রেসক্লাবের নয়, আমাদের সাংবাদিকদেরই অভিভাবক ছিলেন তিনি। মুহম্মদ জাহাঙ্গীর আরও বলেন, এবিএম মূসা আজীবন সম্মাননা এমনই একজনকে আজ দেয়া হলো, তিনি এখন সাংবাদিকতায় একজন আদর্শ। তিনি তোয়াব খান। এদেশের সাংবাদিকতা জগতে তার অনেক কৃতিত্ব রয়েছে। তাই এই সম্মাননা একেবারেই যথার্থ বলে তিনি মন্তব্য করেন। সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবিএম মূসার জীবনী পাঠ করেন কবি হাসান হাফিজ। তিনি বলেন, জাতীয় প্রেসক্লাবের সঙ্গে এবিএম মূসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল নিবিড়। জাতীয় প্রেসক্লাবের অখ-তার প্রতীক ছিলেন তিনি। এটি ছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি। তার মৃত্যুর পর আমরা বইমেলার আয়োজন করেছিলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করেন এ বি এম মূসার বোনের মেয়ে তানিসা মাহমুদ সালাম।
×