ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাপানী নাগরিক হত্যা মামলায় ৫ জেএমবি জঙ্গীর মৃত্যুদণ্ড

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১ মার্চ ২০১৭

জাপানী নাগরিক হত্যা মামলায় ৫ জেএমবি জঙ্গীর মৃত্যুদণ্ড

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর, ২৮ ফেব্রুয়ারি ॥ জাপানী নাগরিক কুনিও হোসি হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির ৫ সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়েছে আদালত। সেই সঙ্গে প্রত্যেক আসামিকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। মামলার অপর আসামি আবু সাঈদের (২৮) বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। দ-প্রাপ্ত আসামিরা হলো জেএমবির রংপুর অঞ্চলের কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩) ওই জঙ্গী সংগঠনের সদস্য ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২) ও সাখাওয়াত হোসেন (৩০)। রায় ঘোষণার সময় ৫ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিল। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আরেক আসামি কুড়িগ্রামের আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব (২৪) এখনও পলাতক রয়েছে। এই মামলার দুই আসামি সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেররিজম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। আর নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে হাসান গত বছরের ২ আগস্ট ভোরে রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুর নগরীর অদূরে কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ৬৬ বছর বয়সী জাপানী নাগরিক হোসি কুনিওকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঢাকায় ইতালির নাগরিক সিজার তাভেল্লা হতাকা-ের পাঁচ দিনের মাথায় একই কায়দায় রংপুরে জাপানী নাগরিক হত্যার ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোড়ন তোলে। পুলিশ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়ার পর গত বছরের ১৫ নবেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু করেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার। এ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের বলেন, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পরিকল্পিতভাবে এই বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা সাক্ষ্যপ্রমাণ সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছি। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় তিনি খুশি। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন বলেন, তাদের পরিকল্পিতভাবে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীত কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। মামলা সূত্রে জানা যায়, কাউনিয়া উপজেলার আলুটারি গ্রামে দুই একর জমি ইজারা নিয়ে কুনিও যে ঘাসের আবাদ করেছিলেন, মুন্নাফ নামের এক ব্যক্তির রিকশায় চড়ে প্রতিদিন সকালে সেই খামার দেখ ভাল করতে যেতেন তিনি। ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সেখানে যাওয়ার পথেই তিনি খুন হন। ওই দিনই কাউনিয়া থানার তৎকালীন ওসি রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পরপর আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস এর দায় স্বীকার করলেও সরকার তা নাকচ করে। প্রথম দিকে পুলিশের তদন্ত স্থানীয় এক বিএনপি নেতাকে ঘিরে আবর্তিত হলেও পরে এ ঘটনায় জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পান তদন্তকারীরা। প্রায় নয় মাস তদন্তের পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ওসি আবদুল কাদের জিলানী গত বছর ৩ জুলাই রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগ পত্র দেন। সেখানে জেএমবির আট জঙ্গীকে আসামি করা হয়। প্রাথমিক সন্দেহের ভিত্তিতে গ্রেফতার হওয়া ছয়জনকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করা হয়। অভিযোগপত্রে বলা হয়, কুনিওকে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি করেন জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা। মোটরসাইকেলে তারা তিনজন ছিলেন। গুলি করার পর মোটর সাইকেলে করে তারা পালিয়ে যান। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৬৬ বছর বয়সী কুনিও। হত্যার পরপরই কুনিওর ব্যবসায়িক পার্টনার হুমায়ুন কবির হিরাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে দুই দফায় ১৫ দিন রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে পুলিশ আরেকটি হত্যা মামলায় হিরাকে আবারও গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়। সেময় পুলিশ দাবি করেছিল হিরা ২৮ অক্টোবর আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দী দেন। তিনি বলেন, হত্যাকা-ের বিষয়টি তিনি জানতেন । এ ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন তিনি জবানবন্দীতে। অপরদিকে এ মামলায় বিএনপি নেতা হাবিবুন্নবী খান সোহেলের ছোট ভাই রাশেদুন্নবী খান বিপ্লবকে রংপুরের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাকেও ১০ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। কিন্তু রিমান্ড শেষ হওয়ার আগেই বিপ্লবকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এদিকে গত ১২ নবেম্বর রংপুর মহানগর যুবদলের সদস্য রাজিব হাসান সুমন ওরফে মেরিল সুমন, যুবদলের সদস্য জুম্মাপাড়ার নওশাদ হোসেন রুবেল ওরফে কালা রুবেল এবং শালবন এলাকার কাজল চন্দ্র বর্মণ ওরফে ভরসাকে র‌্যাব সদস্যরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে। তাদের কুনিও হত্যার আসামি দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয় এবং রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে অভিযোগপত্রে নাম না আসায় কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির হীরা, রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ-উন-নবী খান বিপ্লব, রংপুর মহানগর যুবদলের সদস্য রাজীব হাসান সুমন ওরফে মেরিল সুমন, নওশাদ হোসেন রুবেল ওরফে ব্ল্যাক রুবেল, বিজয় দাশ এবং রংপুর নগরীর শালবন মিস্ত্রিপাড়ার কাজল চন্দ্র বর্মণ ওরফে ভরসা কাজল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান। হাকিম আদালত থেকে মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তরের পর ২০১৬ সালের ১৫ নবেম্বর বিচারক অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরু করে। চলতি বছর ৪ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর রাষ্ট্রপক্ষে ৫৭ জনের মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। আসামি মাসুদ রানা ও সাদ্দাম হোসেনের গুলিতে কুনিও মারা যান বলে তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানর ওসি আবদুল কাদের জিলানী তার সাক্ষ্যে বলেন। অন্যদিকে আসামি সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুলের পক্ষে তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়াবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবদুল মজিদ ম-ল সাফাই সাক্ষ্য দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য ও জেরা শেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক শোনে আদালত। এরপর আজ মঙ্গলবার বিচারক রায় ঘোষণা করেন। রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া বালা নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশে এসে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় একটি ঘাসের খামার করছিলেন কুনিও । ওই উপজেলার সারাই ইউনিয়নে আলুটারি কাচু গ্রামের মানুষ তাকে নিপাট ভদ্রলোক বলেই জানত। ২০১১ সাল থেকে রংপুরে যাতায়াত শুরু হলেও ২০১৫ সালের মে মাসের পর মুন্সীপাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি। বেশ কিছুদিন থাকায় ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলেতেও শিখেছিলেন এই বিদেশী। কারও সাথে দেখা হলে সালাম দিতেন, কেউ সালাম দিলে জবাবও দিতেন। কুনিও নিহত হওয়ার পর তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের খবর গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে। স্থানীয়রা দাবি করেন, ইসলাম গ্রহণ করে কুনিও ‘গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া’ নাম নিয়েছিলেন। বাড়ির পাশের মসজিদে তাকে শুক্রবার জুমার নামাজ এবং মুন্সীপাড়া কবরস্থান মাঠে ঈদের নামাজ পড়তে দেখার কথাও তারা বলেন। নগরীর মুন্সিপাড়া কাদেরিয়া জামে মসজিদের ইমাম সিদ্দিক হোসেনের ভাষ্য, তার কাছেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন ওই জাপানী। স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশ কয়েকজনের সামনেই তা হয়েছিল। স্থানীয়দের কাছে একটি ছবিও পাওয়া যায়, যাতে কুনিওকে মসজিদে টুপি পড়ে আরও অনেকের মাঝে বসে থাকতে দেখা যায়। কুনিও খুন হওয়ার পর জাপান দূতাবাসের কর্মকর্তারা রংপুর ঘুরে গেলেও লাশ হস্তান্তর ও শেষকৃত্যের বিষয়টি ঝুলে থাকে ধর্ম বদলের কারণে। পরে রংপুরের মেয়র শরফুউদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানেই হোসি কুনিওর লাশ দাফন করতে অনুরোধ করে জাপান কর্তৃপক্ষ। জাপান কর্তৃপক্ষের অনুরোধের ভিক্তিতে হত্যাকান্ডের ১০ দিন পর কুনিওকে মুন্সিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। আসামিদের মধ্যে জেএমবির রংপুর অঞ্চলের কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩), ওই জঙ্গী সংগঠনের সদস্য ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২), আবু সাঈদ (২৮) ও সাখাওয়াত হোসেন (৩০) কারাগারে আছেন। আরেক আসামি আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব (২৪) এখনও পলাতক। বিপ্লব রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। গত বছরের জানুয়ারি থেকে তিনি অনুপস্থিত বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইব্রাহীম কবীর জানিয়েছেন। এ মামলর অভিযোগপত্রে আরও দুজনের নাম ছিল। তাদের মধ্যে পলাতক সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেররিজম পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। আর নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে হাসান গত বছরের ২ আগস্ট ভোরে রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। কারাগারে থাকা পাঁচ আসামি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা ও বাহাই নেতা রুহুল আমীন হত্যাচেষ্টা মামলারও অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। আর পলাতক আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব বাহাই নেতা হত্যা চেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।
×