ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অবসরে বুম বুম আফ্রিদি

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১ মার্চ ২০১৭

অবসরে বুম বুম আফ্রিদি

ভক্তরা ডাকেন ‘বুম বুম’, টিমমেটদের কাছে তিনি ‘লালা’ বোর্ড কর্তাদের মতে ‘অতি মেজাজী’, অগণিত তরুণী ভক্ত-হৃদয়ে আবার ‘ক্রেজি’! শহীদ খান আফ্রিদি আসলে আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনেরই এক আন্দোলিত নাম, পাকিস্তান ক্রিকেটের শেষ স্বীকৃত তারকা বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি যা করেন, যা বলেন, যেভাবে হাঁটেন, মাঠে দুহাত তুলে উদ্যাপন করেন সবকিছুতেই আনন্দের অনুসঙ্গ, ভাল লাগা গ্যারান্টেড! সেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে গত দেড় যুগে আধুনিক ক্রিকেটের অত্যন্ত সফল ও আকর্ষণীয় অলরাউন্ডারের নাম আফ্রিদি। মাঠে দুরন্ত পারফর্মেন্সের পাশাপাশি ক্যারিয়ারজুড়ে ক্রেজি সব কর্মকা- ও কথাবার্তার জন্যও ব্যাপক আলোচিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন সেই আফ্রিদি, ‘আমি আমার ভক্তদের জন্য খেলি এবং পিএসএলে আরও দুই বছর খেলতে চাই। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়ে নিচ্ছি। এই মুহূর্তে আমার দাতব্য সংস্থা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি দেশের হয়ে দায়িত্ব নিয়ে ও পূর্ণ পেশাদারিত্বের সঙ্গেই প্রতিনিধিত্ব করেছি।’ সপ্তাহের শুরুতে পিএসএলের এক ম্যাচ শেষে বলেন তিনি। টেস্ট ছেড়েছেন অনেক আগে, ২০১০ সালে; গত বিশ্বকাপে ওয়ানডে (২০১৫), আর সর্বশেষ গত বছর টি২০ বিশ্বকাপের (২০১৬) পর সকল ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগাম সিদ্ধান্ত জানিয়েও ইউটার্ন করেছিলেন। বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর অবশ্য দল থেকেই বাদ পড়েন। এরপর অনেক নাটকীয়তা। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) উর্ধতন কর্তারা ইঙ্গিতে জানিয়ে দেন আফ্রিদি-অধ্যায় আসলে ওখানেই শেষ। তবে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ঘরোয়া টি২০ আসর বিপিএলে দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর নতুন প্রধান নির্বাচক ইনজামাম-উল হক আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। এরপরও উইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া সিরিজে ৩৬ বছর বয়সী তারকা উপেক্ষিত থেকে গেছেন। টি২০ বিশ্বকাপে কোচ ওয়াকার ইউনুসের রিপোর্ট, ‘অধিনায়ক আফ্রিদি আসলে কি বলতে বা বোঝাতে চাইছেন, ক্রিকেটাররা এ নিয়ে দ্বিধায় থাকত!’ সে সময়ের পাকিস্তান ম্যানেজার তার প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘আফ্রিদি একদমই দিশাহীন একজন অধিনায়ক।’ ওই দুই রিপোর্টেই তার ভবিষ্যত লেখা হয়ে যায়, আফ্রিদি একটু দেরিতে বুঝলেন, এই যা। মাঝে মাঠ থেকে অবসর নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেটিও হয়নি। কালকের ঘোষণায়, বোঝা যাচ্ছে সেই সাধটাই এখন তার মরে গেছে! ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে কেনিয়ার চার জাতি প্রতিযোগিতায় অভিষেক হয়েছিল আফ্রিদির। জীবনের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। ধুরন্ধর ব্যাটিংয়ের জন্য ভক্তদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ‘বুম বুম’ খ্যাতি। ক্রমশ আফ্রিদি পাকিস্তান ক্রিকেটের এক অধ্যায়ে পরিণত হন। ২১ বছরে সেই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে ২৭ টেস্ট, ৩৯৮টি ওয়ানডে ও ৯৮ টি২০ খেলেছেন ১ মার্চ ৩৭ বছরে পা দিতে যাওয়া তুখোড় এই অলরাউন্ডার। ওয়ানডেতে ৩৯টি হাফসেঞ্চুরি ৬ সেঞ্চুরিতে আফ্রিদির মোট রান ৮ হাজার ৬৪। ১৯৯৮-২০১০ পর্যন্ত টেস্ট খেলেছেন মাত্র ২৭টি। রান ১ হাজার ৭১৬, সেঞ্চুরি ৫টি। আর ৯৮টি টি২০-তে তাঁর মোট রান ১ হাজার ৪০৫। বোলার আফ্রিদির রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ। ৯৭ উইকেট নিয়ে আন্তর্জাতিক টি২০-র সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি। ওয়ানডেতে উইকেট ৩৯৫, টেস্টে ৪৮টি। ১ মার্চ ৩৭Ñএ পা রাখতে যাওয়া আফ্রিদি তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ভাগে লেগস্পিন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই বেশি পরিচিতি লাভ করেন। টি২০-তে পাকিস্তানের সাফল্যের মূলে তার অবদান সবার ওপরে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে টি২০ বিশ্বকাপ অর্জন ছিল বড় সাফল্য। ১৯৯৬Ñএ নাইরোবিতে তার করা অসাধারণ সেঞ্চুরিটি ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের কোরি এন্ডারসন ৩৬ বলে সেঞ্চুরি পূরণ করে ভেঙ্গেছিলেন। এরপর ২০১৫ সালে জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্স ৩১ বলে পূরণ করেন। কেনিয়ায় করা আফ্রিদির ওই অসাধারণ সেঞ্চুরির ফলে সমর্থকরা যখনই তাদের প্রিয় ব্যাটসম্যানকে ক্রিজে দেখতো তখনই ওই ধরনের একটি ইনিংসের প্রত্যাশা করতেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০৫ সালে ফয়সালাবাদে পিচে পা দিয়ে ঘষে বোলিং করার অপরাধে আফ্রিদি একটি টেস্ট ও দুটি ওয়ানডে ম্যাচে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া ২০১০ সালে পার্থে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে বলে কামড় দেয়ার অপরাধে দুটি টি২০ ম্যাচে নিষিদ্ধ ছিলেন। বুম বুম আফ্রিদি আসলে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তার উদাহরণ গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে এক ভক্তের মন্তব্য। ‘ক্রিকেটই একমাত্র মাধ্যম যার মধ্যে আমরা সুখ খুঁজে পাই। পেশোয়ার থেকে করাচি, মুলতান থেকে লাহোর, প্রতিদিন কেবলই নৃশংসতা, খুন-হত্যা আর সন্ত্রাস। গত অর্ধশতাব্দীজুড়ে আমি এটাই দেখে আসছি। আতঙ্কিত হৃদয়ে খনিকের আনন্দ দিয়েছে কেবল ক্রিকেট। যেখানে ক্রিকেটাররা আমাদের জন্য আনন্দদায়ী দূত; ওয়াসিম আকরাম, সাঈদ আনোয়ার, শহীদ আফ্রিদি সেখানে সামনের সারিতে। বুম বুম আফ্রিদির খেলা দেখতে ট্যাক্সি গ্যারেজে রেখে কতদিন যে মাঠে গিয়েছি...।’ বলেন ৫৯ বছর বয়সী পাকিস্তানী নাগরিক কামাল খান, যিনি গত ১৩ বছর ধরে আবুধাবির রাস্তায় ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকানির্বাহ করছেন। ২০১৫ বিশ্বকাপের আগেই ওয়ানডে ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে আফ্রিদি বলেছিলেন, ‘প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে নিজের ইচ্ছায় অবসর নেয়ার মধ্যে এক ধরনের সুখ আছে! আসন্ন বিশ্বকাপ শেষে ওয়ানডেকে পুরোপুরি বিদায় জানাব আমি। ভক্তদের কথা ভেবে খারাপ লাগছে, তবে আমার শূন্যস্থান একদিন পূরণ হবে।’ উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে লাহোরে সফরকারী শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের বহনকারী বাসে বন্দুকধারীদের হামলার পর থেকে আর কোন বিদেশী দল সে দেশ সফর করেনি। নিজ ঘরে অচ্ছুত পাকিস্তানের জন্য আরব আমিরাত হয়ে ওঠে ‘দ্বিতীয়’ হোম ভেন্যু। আফ্রিদি ওয়ানডে অবসরের ঘোষণাটা সেখানে দিয়েছিলেন। কাকতালীয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও ছাড়ার ঘোষণা দিলেন সেই আমিরাতেই, শারজায় পিএসএলের এক ম্যাচ শেষে।
×