ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চমকের নাম স্টিভ ও’কেফে

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১ মার্চ ২০১৭

চমকের নাম স্টিভ ও’কেফে

‘আমি যদি বলি সোক (স্টিভ ও’কেফের ডাক নাম) অসাধারণ, তা হলে ওকে বরং ছোট করা হবে। পুনেতে সে যা করেছে, এক কথায় এ্যামাজিং, ও আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বিশ্বাস করতে শেখাচ্ছে ভারতের মাটিতেও টেস্টে সাফল্য পাওয়া সম্ভব।’ পুনের প্রথম টেস্টে দুর্ধর্ষ ভারতে ৩৩৩ রানের বড় ব্যবধানে হারানোর পর বলেন, অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ। অসি-সেনাপতির উচ্ছ্বসিত হওয়া খুব স্বাভাবিক। ভারতের মাটিতে দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর পর জয়টা যে এসেছে ও’কেফের অবিশ্বাস্য বোলিংয়ে ভর করে। ১২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছেন আনকোড়া এই বাঁহাতি অর্থোডক্স বোলার। দুই ইনিংসে তার বোলিং ফিগার ১৩.১-২-৩৫-৬ ও ১৫-৪-৩৫-৬; ভারতের মাটিতে কোনো ভিনদেশী স্পিনারের এটিই সেরা বোলিংয়ের নতুন রেকর্ড। ভারত তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটেই ও’কেফে এখন আলোচিত এক নাম। চমকের নাম। স্বভাবসুলভ পরিকল্পনামাফিক পুনের মহারাষ্ট্র ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশনের উইকেট স্পিনবান্ধব করেই গড়েছিল ঘূর্ণি বলে সমৃদ্ধ ভারত। কিন্তু সেই ফাঁদে তাদের আটকে বিপর্যস্ত করেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনভিজ্ঞ স্টিভ ও’কেফে। ৩২ বছর বয়সী এ বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার অভাবনীয় এক কীর্তি দেখিয়েছেন। দুই ইনিংস মিলে ১২ উইকেট শিকার করে স্বাগতিক ভারতকে লজ্জার হার উপহার দিয়েছেন পুনে টেস্ট। ক্যারিয়ার সেরা তো বটেই ভারতের মাটিতে কোন স্পিনারের এবং অস্ট্রেলিয়ান কোন বোলারের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড এটি। প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট নেয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন দ্বিতীয় ইনিংসেও। এবার ভারত সফরে আসার আগে ও’কেফের ঝুলিতে ছিল মাত্র ৪ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা। পুনেতে মাঠে নামার আগে গতবছর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে সবমিলিয়ে খেলেন ৩ টেস্ট। সেই ২০১৪ সালে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সবমিলিয়ে ৪ টেস্টের ৭ ইনিংস বোলিং করে কখনও এক ইনিংসে ৩ উইকেটের বেশি নিতে পারেননি। ঝুলিতে ছিল মাত্র ১৪ উইকেট। এর আগেই অবশ্য ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদযাত্রা শুরু হয়েছিল টি২০ দিয়ে। তারপরও মাত্র ৭ টি২০ খেলতে পেরেছেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত অভিষেকই হয়নি মালয়েশিয়ান বংশোদ্ভূত নিউ সাউথ ওয়েলসের ক্রিকেটার ও’কেফের। কিন্তু ভারতের মাটিতে স্পিনবান্ধব উইকেটে খেলতে হবে এমন চিন্তা করেই এবার তাকে স্কোয়াডে রাখে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)। পুনেতে প্রথম টেস্টের একাদশেই জায়গা করে নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় দিন দেখিয়েছেন ক্যারিশমা। তার ঘূর্ণি বলে দিশেহারা হয়ে ভারতের বিশ্বসেরাদের কাতারে থাকা একাধিক ব্যাটসম্যান কুপোকাত হয়েছেন। প্রথম দুই স্পেলে নিজের বোলিংয়ে নিয়ন্ত্রণ পাননি, কিন্তু তৃতীয় স্পেলে এসে একাই ধসিয়ে দিয়েছেন ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ। মাত্র ১১ রানের মধ্যে শেষ ৭ উইকেট হারায় ভারত। যেখানে ৩৫ রানে ৬ উইকেট শিকার করেন ও’কেফে। তখনই বিশ্ব মিডিয়ায় তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। কারণ, বিদেশী কোন বাঁহাতি স্পিনারের এটি ভারতের মাটিতে ছিল তৃতীয় সেরা বোলিং নৈপুণ্য। হুট করে বিপর্যয় নেমে আসতেই পারে। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এত কম রানে এর আগে ভারতীয় দল শেষ ৭ উইকেট হারায়নি। সেই লজ্জা তাদের দিয়েছেন ও’কেফে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করে। মাত্র ১০৫ রানেই শেষ হয় গত দেড় বছরে নিজেদের মাটিতে সব দলকে নাস্তানাবুদ করা ভারতীয় দল। এবার অসিদের নাকানি-চুবানি দিতে সে কারণেই অন্যতম শক্তি স্পিনকে কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়ে গড়া হয়েছে উইকেট। কিন্তু সেখানে ভারতের বিশ্বসেরা স্পিনারদের পেছনে ফেলে চমকে দিলেন ও’কেফে। বিশ্বের এক নম্বর দলটি দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ কিছু করে ঘুরে দাঁড়াবে সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু আবার যমদূতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ভারতীয় ব্যাটিং ছিন্নভিন্ন করেছেন সেই ও’কেফে। এবার শুরু থেকেই ছোবল হেনেছেন। মাত্র ২ ওভার করানোর পর পেসার মিচেল স্টার্ককে বিশ্রামে পাঠায় অসিরা। বল হাতে নিয়েই ছোবল হানতে থাকেন ও’কেফে। তার সঙ্গে যোগ দেন ৬৪ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লেয়ন। দুজন মিলে আবারও তছনছ করে দেন ভারতকে। ভারতের প্রথম সারির ৭ ব্যাটসম্যানের মধ্যে ৬ জনই তার শিকারে পরিণত হয়েছেন অসহায় আত্মসমর্পণ করে। শুধু লোকেশ রাহুলের উইকেটটা পান লেয়ন এবং শেষ তিন ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরান। আবারও ৩৫ রানে ৬ উইকেট। প্রথম ইনিংসের চেয়ে আরও নিয়ন্ত্রিত এবং ভয়ানক ছিলেন ও’কেফে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৭০ রানে ১২ উইকেট। প্রথমবার ম্যাচে ১০ উইকেটের বেশি শিকার করেন। ভারতে বিদেশী কোন স্পিনারের পক্ষে এটিই সেরা টেস্ট ম্যাচ বোলিং। তবে সার্বিকভাবে তালিকায় ও’কেফের আগে আছেন শুধু ইংলিশ অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম। তিনি ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুম্বাই টেস্টে ১০৬ রানে নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট। আর অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে এর আগে ভারতের মাটিতে সেরা বোলিং নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন মিডিয়াম পেসার এ্যালান ডেভিডসন। ১৯৫৯ সালেল ডিসেম্বরে কানপুর টেস্টে তিনি দখল করেছিলেন ১২৪ রানে ১২ উইকেট। অস্ট্রেলিয়া দলের স্পিন বোলিং পরামর্শক এখন শ্রীধরণ শ্রীরাম, যিনি আবার একজন ভারতীয়। অনেকেই বিষয়টিকে ‘ঘরের শত্রু বিভিষণ’ বলে আখ্যায়িত করছেন। শিষ্যকে কী এমন দীক্ষা দিয়েছেন যে বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনকে এভাবে নাচিয়ে ছাড়লেন? ‘আমি ওকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী কেবল জায়গা মতো বল ফেলতে বলেছি। বাকিটা ইতিহাস। বড় কৃতিত্বটা আসলে ও’কেফেরই।’ বলেন শ্রীরাম। আর গুরুর প্রতি কৃতজ্ঞ ও’কেফে বলেন, ‘আমার মতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল (শ্রীরাম)। ‘এ’ দলের হয়ে খেলতে এসে চেন্নাইয়ে তার সঙ্গে কাজ করেছিলাম। তিনি স্থানীয় লোক, কন্ডিশনটা বোঝেন। তাই তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মধ্যাহ্নবিরতিতে তার সঙ্গে বোলিং করেছি। তিনি জানেন এমন কন্ডিশনে কীভাবে বল করতে হয়, ব্যাটসম্যানরা কী চিন্তা করছে। অন্য কোচিং স্টাফদের চেয়ে তার সাহায্যই বেশি কাজে লেগেছে।’
×