ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তোয়াব খান

মৃত সত্যবাবুকে নতুন করে মারা

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ১ মার্চ ২০১৭

মৃত সত্যবাবুকে নতুন করে মারা

প্রথমেই এবিএম মূসা ও সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ। আজীবন সম্মাননার জন্য আমাকে কি কারণে বেছে নিয়েছেন, সেটা তারাই ভাল জানেন। আমি শুধু এটাই বলতে পারি, অগ্রজ সাংবাদিক এবিএম মূসা সাংবাদিকতার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে যে উচ্চতর ধারা সৃষ্টি করে গেছেন সেই পথ অনুসরণ করেই আমার নিরন্তন অভিযাত্রা। সাংবাদিকতার বিপদসঙ্কুল পথে সত্য ও ন্যায়ের অভিমুখ যেন বিপথগামী না হয়। সাংবাদিকতার উন্নততর বিকাশের ধারায় নানা পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। সাতচল্লিশের উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর পর্যায়ক্রমগুলো সুস্পষ্ট হতে থাকে। একেবারে প্রাথমিক অবস্থার আদিম রূপ থেকে লাইনো-রোটারির পথ ধরে অফসেট হয়ে এখন ডিজিটাল মুদ্রণের যুগ। পর্যায়ক্রমের নেতৃত্বও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের পথ পরিক্রমায় স্বৈরসামরিক শাসক আইয়ুব খানের যুগে এই বাংলায় সাংবাদিকতায় থ্রি ম্যাস্কেটিয়ার্স বা ত্রিরত্ন মানিক মিয়া তফাজ্জল হোসেন, জহুর হোসেন চৌধুরী ও আব্দুস সালামের অভ্যুদয়। পরবর্তীকালে আধুনিক সাংবাদিকতার প্রবর্তনে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, এবিএম মূসা প্রমুখ একটি সুস্পষ্ট ধারার সৃষ্টি করেন। বৈরী পরিবেশে শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্য উপস্থাপনই এই ধারার প্রধান প্রতিপাদ্য। এটাকে অবশ্যই এ্যাকটিভিস্ট সাংবাদিকতা রূপে অভিহিত করা চলে। আজকের দিনে অর্থাৎ ২০১৭ সালের অমর একুশের মাসের শেষ লগ্নে তথ্য বিস্ফোরণের পৃথিবীতে বাংলাদেশেও তথ্যপ্রযুক্তির সব ক্ষেত্রেই ঘটে চলেছে বিস্ময়কর পরিবর্তন। বৈশ্বিক জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও দেশ গঠনের লক্ষ্য সামনে থাকলে তথ্যের কোন বিকল্প থাকে না। তথ্য ও তথ্যবিশ্লেষণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তিমূল। তথ্যপ্রযুুক্তির ছোঁয়ায় মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে খবরাখবর। সংবাদপত্র রেডিও টেলিভিশন ছাড়াও অনলাইন নিউজ পেপার, ফেসবুক, টুইটার, হটসএ্যাপ ও ইমুর মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দূরের মানুষকে কাছে নিয়ে এসেছে। পরিচয় ঘটিয়েছে অপরিচিতের সঙ্গে। এবার প্রিন্ট মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্রের দিকে একটু নজর দেয়া যেতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ৩৫৫। ২০১৬ সালের ১৫ জুন জাতীয় সংসদে তথ্যমন্ত্রী জানান, সারাদেশে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ১০৭৮। সাপ্তাহিক ২৩০, পাক্ষিক ৬৮, মাসিক ১৩২, দ্বিমাসিক ২, ত্রৈমাসিক ১১, ষাণ¥াসিক ১- এগুলো ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে এখন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল ৪১। বিটিআরসি জানিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বেতারসহ মোট ২৬ প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট তরঙ্গ বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সব মিলিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় ২৯ প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। এদের মধ্যে ২৮টিই বেসরকারী রেডিও। তিনটি নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে কমিউনিটি রেডিওর জন্য। দুর্যোগের বার্তা পৌঁছে দিতে উপকূলীয় এলাকায় আরও কয়েকটি কমিউনিটি রেডিওর লাইসেন্স দেয়া হতে পারে। গত বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ে অনলাইন নিউজ পেপারের জন্য আবেদন জমা পড়ে এক হাজার ৭১৭টি। প্রতিটি দৈনিক সংবাদপত্রই চলে এসেছে অনলাইন প্রচারে। এই সঙ্গে ৯৩টি সাপ্তাহিকও রয়েছে। ঘরে বসে কেনাকাটা এখন জনপ্রিয় বিষয়। গত বছরের শেষদিন অর্জিত হয়েছে ডট বাংলা ডোমেইন। ডিজিটাল শব্দটি এখন সবচেয়ে আলোচিত এবং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। উন্নত দেশগুলোর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। আমাদের দেশেও উন্নত দেশের ডিজিটালাইজেশনের পরোক্ষ প্রভাব ও চাপ এসে পড়ছে। ত্বরান্বিত হচ্ছে ডিজিটাল কার্যক্রম। তথ্য প্রসারে অনলাইন মিডিয়ার ক্ষিপ্রগতির আধিপত্য লক্ষণীয়। যদিও তাৎক্ষণিকতার বিপত্তিও অনস্বীকার্য। অনেকেই মনে করছেন ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে অনলাইন মিডিয়া ছাড়া পশ্চাৎপদ বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধিশালী মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করা সম্ভব হবে না। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণের ফলে তথ্যের আদান-প্রদানের গতি যেমন ক্ষিপ্র, তেমনি নির্বাধ হয়ে পড়েছে। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে অনলাইন পাঠকগোষ্ঠী। সুদূর কানাডা বা বাংলাদেশের সুন্দরগঞ্জ যেখানেই যা কিছু ঘটুক না কেন এ পাঠকগোষ্ঠী আগেই দ্বারস্থ হন অনলাইনের। খবরের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক হয়ে উঠছে ফেসবুক। অনলাইন মাধ্যমে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুতগতিতে সরকারের সেবামূলক কাজ জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। বারো থেকে চৌদ্দ কোটি মোবাইল ফোন সচিত্র তথ্য পৌঁছে দিতে বিরাট ভূমিকা নিচ্ছে। তবে মনে রাখা দরকার, মাধ্যমটি অন্যভাবেও ব্যবহার হতে পারে। জাগ্রত সচেতনতা এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় নিয়ামক। যাই হোক, অনলাইন সাংবাদিকতা বিগত বছরে এবং এখনও যথেষ্ট আলোচিত বিষয়। জাতীয় অনলাইন নীতিমালা চূড়ান্ত হয়েছে। প্রেস ইনস্টিটিউট তাদের সাংবাদিকতার ডিপ্লোমা কোর্সেও অনলাইন সাংবাদিকতার বিষয়টি যুক্ত করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় অনলাইন সাংবাদিকতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটাকে কেউ কেউ বলছেন ডিজিটাল সাংবাদিকতা। বলা হচ্ছেÑ অনলাইন সাংবাদিকতা সময় ও পরিবহন ব্যয় সাশ্রয়ে সহায়ক। বড় বড় শহরে যানজট কমাতে তথ্যপ্রযুক্তি ভূমিকা রাখছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায়, তথ্যের স্বচ্ছতা বিধানের মাধ্যমে দুর্নীতি ও অদক্ষতা নির্ণয় সহজ হবে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতি মোবাইল সিম নিবন্ধন, আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি, আইটি স্ট্রাকচার, ই-গবর্ন্যান্স, এইচআরডি ল্যাব ও সার্ভিস বাস্তবায়ন, উপজেলা পর্যন্ত ফাইবার অপটিক সংযোগ, ৫৫৪ বিপিও সেন্টার, বিচারিক ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন ইত্যাদির লক্ষ্য একটিÑ তথ্যকে দ্রুত প্রশাসন ও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করা। আর তথ্যই যখন জ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি, জ্ঞানভিত্তিক সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠন কি তখন সুদূরের বিষয়? এখন প্রশ্ন হলোÑ অনলাইন সাংবাদিকতা, ‘ডিজিটাল তথ্যের দ্রুত প্রসার-প্রচারের এই পরিম-লে প্রিন্ট মিডিয়াম তথা সংবাদপত্রের অবস্থান কোথায় দাঁড়াচ্ছে।’ ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহে অনলাইন সাংবাদিকতা প্রায় অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা দিলেও তার অর্থনৈতিক ভিত্তিটা কি হবে। প্রিন্ট মিডিয়ামে সংবাদপত্রের আর্থিক ভিত্তি নিজস্ব রাজস্বÑ পত্রিকা বিক্রি এবং বিজ্ঞাপন থেকে লব্ধ অর্থ। বিজ্ঞাপন রাজস্বের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের আয় ক্রমবর্ধিত হারে নিম্নগামী। রেডিও ও টেলিভিশন ইতোমধ্যেই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। বিশেষভাবে বেসরকারী বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। অন্যদিকে ডিজিটালাইজের ফলে সরকারী বিজ্ঞাপনের পরিমাণ ও পরিধি দুটোই কমে আসছে। এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ, শুধু সংবাদপত্র বিক্রির অর্থে কোন পত্রিকা চালু রাখা সম্ভব নয়। অনলাইন সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপনদাতারা অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং ইতোমধ্যে করছেনও। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী দালিলিক প্রামাণ্যতা বিজ্ঞাপনদাতাদের হাতে থাকে। রেডিও-টিভির ক্ষেত্রেও এটা অনেকাংশে প্রযোজ্য। অনলাইনে এমন কিছু পাওয়া কি সম্ভব? এখনও পর্যন্ত অনলাইনে পত্রিকার প্রধান সাইটগুলো বড় বড় সংবাদপত্রের অনলাইন সংবাদপত্রেরই অংশ। তবে ব্যক্তি পর্যায়ের সামাজিক মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদানে বাণিজ্যিক ভিত্তির প্রশ্ন অবান্তর। এ ধরনের তথ্যের একটি বিপজ্জনক দিক হলো, সত্য ও ব্যক্তিÑ পর্যবেক্ষণের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকতে পারে। এমনকি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ এবং ঘটনা ধারার চূড়ান্ত পরিণতি আগাগোড়া পরিবর্তন হয়ে যেতেও পারে। তাই সামাজিক মাধ্যম কোন কোন সময়ে নিউজ ব্রেকের মতো কিছু সৃষ্টি করতে পারলেও স্থায়ী আস্থা অর্জনে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। দুনিয়াজুড়ে এখন বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও ডিজিটালের দাপট। বেচারা গুটেনবার্গের মুভেবল টাইপের দিন গেছে সেই কবে। কম্পিউটারে ছাপা স্থান করে নিয়েছে। ল্যাপটপে বা ট্যাবে বই পড়ার কত সুযোগ। তবুও লোকে বই কিনছেন বিখ্যাত লোকদের রচনাবলী পড়ার জন্য। পবিত্র কোরান শরীফ বা বাইবেল পড়ার জন্য কেউ ল্যাপটপ খুলে বসেন না। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও জ্ঞানার্জনের শাশ্বত স্পৃহা মেটাতে প্রধান অবলম্বন মুদ্রিত হরফ তথা বই। মুদ্রিত হরফ তথা সংবাদপত্র আর অনলাইনের ডিজিটাল যুগে এখন নাকি সত্যবাবুর দিন শেষ। বাংলাদেশের এককালের তুখোড় সাংবাদিক প্রয়াত ফয়েজ আহমদ সাহেব অনেক আগেই অবশ্য বলে দিয়েছেন ‘সত্যবাবু’ মারা গেছেন। দুনিয়া এখন নাকি সত্য-উত্তর। পোস্ট ট্রুথ। কোন্ কথাটি সত্য আর কোন্টি নয়, সেই বিচার নাকি এখন অবান্তর। কোন্ ধারণাটি কতটুকু গভীর ও প্রতাপশালী, কোন্ ধারণাটি কত দ্রুত সাধারণ্যে প্রসারিত হতে পারে, সেটাই নাকি বিবেচ্য। আমাদের দেশের বা বিদেশের কিছু নেতাকে দেখলে পোস্ট ট্রুথ মাহাত্ম্য বুঝতে সময় লাগে না। সত্য-মিথ্যার বিভেদহীন, এসব নেতার সৃষ্ট অদ্ভুত এক পরিবেশ গুজবের জন্য আদর্শ। এদের বচনান্মৃত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একের পর এক অসত্য বিবৃতি বারবার তারা দিয়েই যাচ্ছেন। এরা গোয়েবলসের মতো বিশ্বাস করেন মিথ্যা কথা বার বার বললে গোবেচারা জনগণ সত্য বলে মেনে নেবে। সত্যের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে দেশ-বিদেশের এসব নেতা সত্য-উত্তর দুনিয়া সৃষ্টি করতে চান। সত্য এখানে ঢুকতেই পারছে না। বাংলাদেশে কিছু নেতা-নেত্রী আছেন যাদের বুলি বা আপ্তবাক্য মানুষকে সত্য ভুলিয়ে সত্য-উত্তর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। মৃত সত্যবাবুকে নতুন করে মারার অপচেষ্টা। অতএব, সাধু সাবধান! [এবিএম মূসা ও সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের দেয়া আজীবন সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ]
×