ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

বিএনপি আয়নায় নিজের অতীতের চেহারা দেখছে

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১ মার্চ ২০১৭

বিএনপি আয়নায় নিজের অতীতের চেহারা দেখছে

কানাডার ফেডারেল আদালত অভিবাসন সংক্রান্ত এক মামলায় বাংলাদেশের বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়েছে। বিএনপি তার প্রতিবাদ করে বলেছে, তারা সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, বরং সন্ত্রাসের শিকার। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসী এবং বিরোধী দল বিএনপি হলো তাদের সন্ত্রাসের শিকার। আমি এ সম্পর্কে ঢাকার অন্য একটি দৈনিকে আমার কলামে আলোচনা করেছি। সুতরাং সে আলোচনার পুনরুক্তিতে না গিয়ে সন্ত্রাস সম্পর্কে বিএনপি’র ধারণা কতটা বেঠিক সেদিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। আমি তাদের ধারণা ও প্রচার পাল্টাতে পারবো তা মনে করি না। কারণ, যারা জেগে ঘুমান, তাদের জাগানো মুশকিল। অধুনা বিএনপির নেতানেত্রীদের মধ্যে একটা ‘ভিকটিম সিনড্রম’ দেখা দিয়েছে। তারা নিজেদের নির্যাতীত ভাবতে অথবা নির্যাতিত হিসেবে প্রচার করতে ভালোবাসেন। হয়তো ভাবেন, তাতে তারা জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন পাবেন। হয়তো কিছু মানুষের সহানুভূতি তারা পেতে পারেন, যারা বিএনপির সাম্প্রতিক ইতিহাসও ভুলে গেছেন। কিন্তু দেশের সচেতন মানুষের কাছে সন্ত্রাসের ভিকটিম সেজে বিএনপির নেতানেত্রীরা এত শীঘ্র সহানুভূতি কুড়াতে পারবেন তা মনে হয় না। একথা সত্য, বিএনপি’র সন্ত্রাসী রাজনীতি প্রতিহত করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তাদের শীর্ষ নেতাদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় তারা অভিযুক্ত। এ সম্পর্কে ঢাকার এক তরুণ সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ঠাট্টা করে বলেছেন, “ইঘচ রং নবরহম ঢ়ধরফ নু রঃ’ং ড়হি পড়রহ” (বিএনপি এখন নিজের কর্মফলই ভোগ করছে)। ক্ষমতায় থাকতে তারা যা করেছে এখন অন্য কেউ ক্ষমতায় এসে যদি তা করতে চায় অথবা করে, তাহলে বিএনপির অভিযোগ করার কিছু থাকতে পারে কি? বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের শান্তিতে ঘরে ঘুমাতে দেয়নি। মিটিং মিছিল করতে দেয়নি। জেলে ঢুকিয়েছে, মিথ্যা মামলায় হয়রানি করেছে। বিএনপি শাসনের সবচাইতে বড় কলঙ্ক, তারা বেছে বেছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেককেই (যেমন কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার) হত্যা করিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনাকে পর্যন্ত হত্যার জন্য ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছে। বিএনপি আমলেই হুমায়ুন আজাদের মতো বুদ্ধিজীবীকে বিএনপি’র পোষা মৌলবাদীদের হামলায় শেষপর্যন্ত মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। কবি শামসুর রাহমানের জীবনের উপরেও হামলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে বেগম খালেদা জিয়া এসব মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ প্রকাশতো করেননিই, বিদ্রƒপ করে বলেছেন, “এগুলো হচ্ছে আওয়ামী লীগের সাজানো নাটক।” এখন পাশার দান উল্টে গেছে। বিএনপি আয়নায় নিজের অতীত কর্মকা-ের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে চিৎকার জুড়েছে তারা সন্ত্রাসের শিকার। আসলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে দেশে ভীতির রাজত্ব কায়েম করে শাসন চালাতে চেয়েছে এবং ক্ষমতা হারানোর পরও পেট্রোল বোমায় নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারার সন্ত্রাস দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের নিরাপত্তা ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে কঠোর হয়েছেন। সন্ত্রাস বন্ধ করার জন্য কঠোর দমন নীতি প্রয়োগ করেছেন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী রাজনীতি বন্ধ করার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ভারতে কম্যুনিস্ট পার্টি যখন “সশস্ত্র শ্রেণী যুদ্ধের” নামে হত্যা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি অনুসরণ করেছিল, গণতন্ত্রের উপাসক নেহরু সরকার তখনি তাদের গালে চুমু খেয়েছিলেন, না কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করেছিলেন? আওয়ামী লীগ দল হিসেবে ধোয়া তুলসি পাতা তা বলি না। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির পার্থক্য এই যে, আওয়ামী লীগের জন্ম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় এবং সেভাবেই ক্ষমতায় এসেছে। অন্যদিকে বিএনপির জন্ম সামরিক শাসনের গর্ভে, (যা আসলে সন্ত্রাসী শাসনের নামান্তর) এবং সে ক্ষমতায় যেতে এবং থাকতে চেয়েছে সন্ত্রাসের সাহায্যে। আওয়ামী লীগের নির্ভরতা গণমানুষের সমর্থনের উপর। বিএনপি’র নির্ভরতা প্রথমে ছিলো ক্যান্টনমেন্ট, তারপর জামায়াতসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী মৌলবাদী দল। জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে খালেদা জিয়া পর্যন্ত বিএনপির শাসনকালের সন্ত্রাসের তালিকা দীর্ঘ। মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহেরের রক্তের উপর পা রেখে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছেন। জেলের ভেতর শয়ে শয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে বিচার প্রহসনে হত্যা করেছেন। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, “জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝোলাবার সময় তাদের আর্তচিৎকার মধ্যরাতে জেলের আশপাশের এলাকাগুলোতেও শোনা যেতো।” জিয়াউর রহমানের শাসনামলের অধিকাংশ সময় রাজধানী ঢাকায় সারারাত কারফিউ জারি রয়েছে। প্রকৃত রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতনের কোনো শেষ ছিল না। সন্ত্রাস ও দমননীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। সন্ত্রাসী শাসনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। টর্চার করা হয়। যেমন করতেন চিলির পিনোচেট। বাংলাদেশেও আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের আমলে তা হয়েছে। ড. কামাল হোসেনের মতো নিয়মতান্ত্রিক নেতাকেও আরো অনেক নেতাসহ চোখবেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। নিরস্ত্র মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে ছাত্র হত্যা করা হয়েছে। গণতন্ত্রের সেøাগান পিঠে লেখায় নূর হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সত্যমিথ্যা দুর্নীতির মামলায় জেলে ঢোকানো হয়েছে। তারপর বশ মানলে জেল থেকে বের করে মন্ত্রী বানানো হয়েছে। উদাহরণ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। খালেদা জিয়ার শাসনামলে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতা হত্যাসহ যতো বুদ্ধিজীবীর উপর (শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ) নির্যাতন চলেছে তার তুলনা মিলবে ত্রিশের দশকের ইউরোপের কোনো কোনো ফ্যাসিবাদী দেশে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এই ধরনের সন্ত্রাসী নীতি দ্বারা দেশ পরিচালনা করতে চেয়েছে তার কোনো উদাহরণ নেই। শেখ হাসিনার জীবননাশের চেষ্টা হয়েছে অসংখ্যবার। বেগম খালেদা জিয়ার শরীরে আজ পর্যন্ত একটি ফুলের টোকাও পড়েনি। কিছুকাল আগেও বিএনপির পাঁতি নেতারাও এই বলে শেখ হাসিনাকে হুমকি দিয়েছেন, “আবার পঁচাত্তর ঘটাবো, হাসিনাকে বাপের পথে পাঠাবো।” এই ধরনের সেøাগান একটি সন্ত্রাসী দল দিতে পারে। কোনো গণতান্ত্রিক দল দেয় না। হাসিনা সরকারকে বলপূর্বক উৎখাতের জন্য কয়েক বছর আগে যে সশস্ত্র হেফাজতী অভ্যুত্থান ঘটানোর চক্রান্ত হয়েছিল, অন্য কোনো দেশ হলে তা দমনের জন্য সরকার অভিযান চালাতো। রক্তাক্ত ঘটনা ঘটতো। সবচাইতে কম শক্তি প্রয়োগে হাসিনা সরকার এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়েছেন। আর খালেদা সরকার ঢাকায় কম দামে সার সরবরাহের দাবিতে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা একটি নিরস্ত্র কৃষক মিছিলে গুলি চালিয়ে ১৮ জন কৃষক হত্যা করেছেন। সুতরাং সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া যায় কোন্্ সরকারকে, বর্তমানের হাসিনা সরকারকে, না, অতীতের সবগুলো বিএনপি সরকারকে? বর্তমানে হাসিনা সরকারকে ভয়াবহ সন্ত্রাস দমনের জন্যই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অতীতে বিএনপি ও জামায়াত মিলে আন্দোলনের নামে যে মিনি জেনোসাইড শুরু করেছিল। তা যে কোন দেশে ঘটানো হলে একটি গণতান্ত্রিক সরকারও এর চাইতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। বিএনপি ও জামায়াত বর্তমান সরকারকে বাধ্য করেছে এই পথে যেতে। নইলে হাসিনা সরকারের জন্য এত কঠোর হওয়ার প্রয়োজন হতো না। বঙ্গবন্ধু কঠোর হননি বলেই ১৫ আগস্টের বর্বরতাকে প্রতিহত করতে পারেননি। ক্ষমতালোভী শকুনেরা দেশটি দখল করে নিয়েছিল। আমাদের সুশীল সমাজের যেসব ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে গণতন্ত্রের সবক দেন তারা জ্ঞানপাপী। তারা জানেন, শেখ হাসিনা কঠোর না হলে বহু আগে পিতার পরিণতি বরণ করতেন, দেশ এবং গণতন্ত্রকেও রক্ষা করতে পারতেন না। আওয়ামী লীগ সরকার কৃষক হত্যা করেনি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিয়েছে এবং সন্ত্রাস ও নানা রাজনৈতিক চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত বিএনপির নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গ্রেফতার করছে জঙ্গী এবং সন্ত্রাসীদের। বিএনপি এই অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদেরই দলের কর্মী বলে দাবি করছে এবং তাদের গ্রেফতারকে গণতন্ত্র নিধন বলে প্রচার চালাচ্ছে। অর্থাৎ নিজেরাই নিজেদের সন্ত্রাসী পরিচয় তুলে ধরছেন। আওয়ামী লীগ সরকারকে এই কঠোর ব্যবস্থা অবশ্যই ততদিন অনুসরণ করতে হবে, যতদিন দেশ চক্রান্তের রাজনীতি ও সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত না হয়। গতন্ত্রকে রক্ষার জন্য কঠোর হওয়া অগণতান্ত্রিক হওয়া নয়। বিএনপি সন্ত্রাসী সংগঠন বলেই একাত্তরের সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে গলাগলি করতে পারে। আওয়ামী লীগ তা পারে না। তাকে সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দ- দিতে হয়। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস দমনের জন্য সন্ত্রাসের পথ ধরেনি। গণতন্ত্রের স্বার্থেই যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তাকে দমননীতি আখ্যা দেয়া যায়, তবে সন্ত্রাস নয়। এখন দেখতে হবে এই দমননীতি এই মুহূর্তে প্রযোজন, না অপ্রয়োজন? দেশের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করা হলে হয়ত দেখা যাবে, তারা বলছে প্রয়োজন। একমাত্র সরকার যদি গণতন্ত্রের এবং দেশের স্বার্থে নয়, নিজেদের দলীয় স্বার্থে এই দমন নীতি অনুসরণ করেন। একমাত্র তাহলেই তার প্রতিবাদ করা যাবে। অন্যথায় নয়। লন্ডন, ২৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৭।
×