ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডেমরায় দুটো জুতা কারখানায় আগুন, বিপুল ক্ষতি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ডেমরায় দুটো জুতা কারখানায় আগুন, বিপুল ক্ষতি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বেআইনীভাবে সরু গলিতে গড়ে ওঠা ছোট ছোট কারখানায় তৈরি হচ্ছে নামীদামী ব্র্যান্ডের জুতো। এসব জুতো কিনে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। তবে লাভবান হচ্ছেন নামীদামী ব্র্যান্ডের কোম্পানির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। রাজধানীতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে এসব জুতো তৈরির কারখানায় একের পর এক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেই চলেছে। তাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। গত শনিবার ঢাকার একটি জুতো তৈরির কারখানায় আগুনে তিন জনের মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই সোমবার ডেমরায় পাশাপাশি থাকা দুইটি জুতো তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। যদিও আগুনে কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্তত অর্ধকোটি টাকার মালপত্র। একটি কারখানা পুরোপুরি পুড়ে গেছে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন শতাধিক শ্রমিক। সম্প্রতি কয়েকটি জুতো তৈরির কারখানায় আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। সোমবার বেলা এগারোটার দিকে রাজধানীর ডেমরা-যাত্রাবাড়ী সড়কের সামাদনগর এলাকায় ক্ল্যাসিক-নাবিল সু নামের দুটি জুতো তৈরির কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্র জানায়, দুপুর আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ১১ ইউনিট প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। স্থানীয়রা জানান, ক্লাসিক সু নামের একতলা টিনশেড কারখানাটিতেই অন্তত একশ শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। কারখানার ভেতরে ওয়েল্ডিং মেশিন দিয়ে ঝালাইয়ের কাজ চলছিল। আগুনের স্ফুলিঙ্গ কারখানার ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেখানে পাউডার জাতীয় কেমিক্যাল বস্তায় ভরে থরে থরে সাজানো ছিল। সেই বস্তার ওপর আগুনের স্ফুলিঙ্গ পড়লে আগুন লেগে যায়। মুহূর্তেই সেই আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কারখানার শ্রমিকরা দৌড়ে বেরিয়ে যান। আগুনে পাশের নাবিল সু কারখানায়ও লেগে যায়। ক্লাসিক সু কারখানাটি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে নাবিল কারখানাটি। কারখানাটি দুইটির প্রতিষ্ঠাতা দুই ভাই জুয়েল ও নোবেল। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ঘটনার পর থেকেই তারা লাপাত্তা। ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশনস্) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজ জানান, কারখানাটি যেখানে অবস্থিত, সেখানে কোন পানির ব্যবস্থা নেই। এজন্য ফায়ার সার্ভিসের পানি দিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছে। কারখানার গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের কোন ব্যবস্থা নেই। কারখানায় আগুন নেভানোর কোন প্রশিক্ষিত জনবল ছিল না। জুতো তৈরির আঠা জাতীয় দাহ্য পদার্থ এবং কেমিক্যাল থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। জানা গেছে, কারখানাটিতে বাটা জুতো তৈরি হতো। এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে ঢাকার চকবাজার থানাধীন ইসলামবাগের বেড়িবাঁধ এলাকায় অবস্থিত লৌহজং কোম্পানি নামের একটি রাবারের সেন্ডেল তৈরির কারখানায় অগ্নিকা-ে তিন জনের মৃত্যু হয়। সেখানেও জুতো তৈরির কেমিক্যালে আগুন লেগে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু কারখানা নয়, কেমিক্যালের আগুনে পুড়ে যায় পাশের নয়টি বসতঘর। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট টানা প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের ভেতরে বাজারজাত করা অধিকাংশ নামীদামী ব্র্যান্ডের জুতোর বেশিরভাগই তৈরি হচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন অখ্যাত কারখানায়। এসব কারখানাগুলোর অধিকাংশই ডেমরা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, লালবাগ, চকবাজার, বাবুবাজার, নিমতলী, কামরাঙ্গীরচর, ইসলামবাগসহ পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে। কারখানাগুলোর শতকরা নব্বই ভাগই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা। বেশিরভাগ কারখানারই ব্যবসা করার কোন ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত নেই। এজন্য এসব কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। কারখানাগুলো বাসাবাড়ি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার সরু গলির ভেতরে বাসা বা ফ্ল্যাট ভাড়া করে গড়ে তোলা হচ্ছে। যাতে সহজেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের নজর এড়ানো যায়। এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে দেশের খ্যাতিমান ব্র্যান্ডের জুতো। তার মধ্যে অন্যতম বাটা। গত কয়েক বছরে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও ডেমরা এলাকা থেকে তৈরিকৃত অসংখ্য বাটা জুতো জব্দ করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারপরও থেমে নেই বেআইনীভাবে নামীদামী ব্র্যান্ডের জুতো তৈরি। বেশি লাভের আশায় নামীদামী কোম্পানিগুলো তাদের জুতো এসব কারখানায় তৈরি করাচ্ছে। এরপর তৈরিকৃত জুতোর ওপর ওইসব নামীদামী ব্র্যান্ডের সিল দেয়া হচ্ছে। এতে করে ক্রেতা প্রতারিত হলেও, লাভবান হচ্ছেন ওইসব নামীদামী কোম্পানির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এসব বেআইনী কর্মকা-ে জড়িত জুতো কোম্পানিগুলোর ওপর তেমন কোন নজরদারিও নেই। পুরো এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিশাল এক সিন্ডিকেট। নামীদামী ব্রান্ডের জুতো তৈরির কারখানার উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হর্তাকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। তারা ছোট ছোট কোম্পানিকে জুতো তৈরির অর্ডার দিচ্ছে। এসব কোম্পানিগুলো গোপনে তৈরি করছে জুতো। এজন্য কোম্পানিগুলোর সামনে কোন সাইনবোর্ড দেখা যায় না। জুতো তৈরি হয়ে গেলে তা কোম্পানির উৎপাদন কর্মকর্তা ভুয়া বাউচারে গাড়িতে নির্দিষ্ট পরিমাণ জুতো থাকার রসিদ তৈরি করেন। আসলে গাড়িতে থাকে তার চেয়ে অনেক কম জুতো। কম থাকা জুতোগুলো নিম্নমানের কারখানা থেকে গাড়িতে ভরা হয়। এরপর সেই গাড়িতে করেই জুতোগুলো বিভিন্ন সু রুমে সরবরাহ করা হয়। এতে করে প্রকৃতপক্ষে জুতো কোম্পানির মালিক বিষয়টি কোনমতেই ধরতেই পারেন না যে, তার কোম্পানির নামে নিম্নমানের জুতো তৈরি হয়ে তা বাজারে চলে যাচ্ছে। বেআইনীভাবে এভাবে জুতো তৈরি করে গ্রাহকদের প্রতারিত করে, ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি কোম্পানি গ্রাহকের আস্থাহীনতার মধ্যে পড়েছে। হালে এই কোম্পানির জুতো আর মানুষ উৎকৃষ্ট বলে মনে করে না। প্রকাশ্যেই ক্রেতাদের বলতে শোনা যায়, এই কোম্পানির জুতো কেনা যাবে না, কারণ এসব জুতো সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীতে নিম্নমানের কোম্পানিতে তৈরি হয়। ঢাকার লালবাগে অবস্থিত একটি জুতো তৈরির কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের সব নামীদামী ব্র্যান্ডের জুতো তার কারখানায় তৈরি হচ্ছে। এমনকি এসব জুতো বিদেশ পর্যন্ত রফতানি হচ্ছে। রফতানি হওয়া জুতোর যে মান থাকার কথা, তা নেই। তারপরও এসব জুতো রফতানি হচ্ছে। দ্রুত এ অবস্থার উন্নতি না হলে জুতো রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিদেশের বাজার হারাতে পারে। তারপরও তারা বাধ্য হচ্ছেন, এসব নামীদামী ব্র্যান্ডের জুতো তৈরি করতে। কারণ এসব কোম্পানির কথামতো কাজ না করলে, তাদের কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে এমনকি নানা হয়রানি নেমে আসবে তাদের ওপর। এর সঙ্গে নামীদামী ব্র্যান্ডের জুতোর উৎপাদন কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট জড়িত। তারা শুধু নামীদামী ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করে নিম্নমানের জুতো তৈরি করে তাতে নামীদামী ব্র্র্যান্ডের নকল সিল ব্যবহার করে তা বাজারজাত ও রফতানি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বিষয়টি মনিটরিং হওয়া জরুরী। অন্যথায় দেশের জুতো শিল্প বড় ধরনের হুমকি মুখে পড়বে। স্টার পার্টিকল বোর্ড মিলে আগুন আহত ৫ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ, থেকে জানান বন্দরের হরিপুরে পারটেক্স গ্রুপের স্টার পার্টিকল বোর্ড মিলে সোমবার সন্ধ্যা পৌনে ছ’টায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকা-ের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট প্রায় ২ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে রাত পৌনে আটটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে কেমিক্যাল, পার্টিকল বোর্ড ও মূল্যবান মেশিনারিজ পুড়ে গেছে বলে মিল কর্তৃপক্ষ জানায়। মালিক পক্ষ আগুনে ২০ কোটি টাকার ক্ষতি দাবি করেছে। এ ঘটনায় কমপক্ষে ৫ জন আহত হয়েছে। জানা গেছে, তিন তলার কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লেগে তা দ্রুত মেশিনারিজ রুমে ছড়িয়ে পড়লে কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। ঢাকার ডেমরা, নারায়ণগঞ্জের বন্দর, আড়াইহাজার, হাজীগঞ্জ ও আদমজী ইপিজেডের ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌছে ২ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে রাত পৌনে আটটায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আগুন লাগায় আতঙ্কে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে ইলেক্ট্রিশিয়ান সুকুমার ও মিস্ত্রি রুবেলসহ ৫ শ্রমিক আহত হয়। মিলের সিইও তোফাজ্জল হোসেন জানান, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত। কেউ হতাহত হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানাতে পারেননি। নারায়ণগঞ্জ জেলা ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ জানান, আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপন করা সম্ভব হয়নি। তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে।
×