ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যা-তদন্ত কোন দিকে মোড় নেবে- যা লিখেছে বাবুল ফেসবুকে

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মিতু হত্যা-তদন্ত কোন দিকে মোড় নেবে- যা লিখেছে বাবুল ফেসবুকে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ শেষ পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যাকা-ের নেপথ্যের সত্য কি বের হবে? শুধুমাত্র এ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা কে? তার উত্তর সুনির্দিষ্টভাবে উদ্ঘাটন না হওয়ার কারণে এ হত্যাকা-ের তদন্ত ঘুরপাকই খাচ্ছে। মিতু হত্যা প্ল্যানিং কিভাবে হয়েছে, কার নির্দেশে হয়েছে, সবই পরিষ্কার। কিন্তু রেকর্ডকৃত নয়। কেন নয় তা রহস্যময়। এছাড়া প্ল্যানিংয়ে জড়িতদের অন্যতম দুজনের মধ্যে একজনের কোন হদিস নেই। পলাতক, গুম না মৃত এ নিয়েও কোন তথ্য নেই। যা আছে সবই রেকর্ডবিহীন। এছাড়া অন্যজন যিনি হত্যাকা-ের অস্ত্র যোগানদাতা তার বক্তব্য নেয়া হয়েছে কিন্তু আদালতে স্বীকারোক্তি জবনাবন্দীমূলক নেয়া হয়নি। আরও বিস্ময়কর হচ্ছে, বাবুল আক্তারের যে পুত্রকে স্কুলগামী বাসে উঠিয়ে দিতে গিয়ে মা মাহমুদা খানম মিতু মৃত্যুদূতদের উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত ও গুলিতে প্রাণ হারান তখন পুত্র আকতার মাহমুদ মাহিরই ছিল চাক্ষুস সাক্ষী। অন্য যারা ঘটনা দেখেছেন তারা পথচারী। এদের এখন খুঁজে বের করাও সম্ভব নয়। হত্যাকারীদের একজনের মুখ থেকে ‘মিতু ভাবি দাঁড়ান’ এ বক্তব্য শুনেছে মাহির এবং তা হত্যাকা-ের পরপরই পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়েছে। সেই পুত্র মাহিরের জবানবন্দীও আদালতের মাধ্যমে নেয়া হয়নি। কিন্তু আদালত সূত্রে জানানো হয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক হলেও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দী নেয়া যায়। কিন্তু তদন্ত সংস্থার পক্ষে তা করা হয়নি। এছাড়া হত্যাকা-ের পরপর বাবুলকে জরুরীভিত্তিতে র‌্যাবের হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়েছিল। স্ত্রীর দুঃখজনক হত্যাকা-ে ব্যথিত হয়ে সিএমপির তৎকালীন একজন উর্ধতন কর্মকর্তা সহানুভূতিশীল হয়ে বাবুলের হাতে নগদ এক লাখ টাকা প্রদান করেন। ওই টাকার প্যাকেটটি পরে বাবুল আক্তারের প্রধান সোর্স ও কিলিং মিশনের প্রধান প্ল্যানার মুসার বাসায় অভিযান চলাকালে উদ্ধার করা হয়। তাও রেকর্ডে আনা হয়নি। এসব নিয়ে পুলিশ মহলেই নানা গুঞ্জন রয়েছে। এছাড়া তদন্তভার গোয়েন্দা বিভাগের হাতে ন্যস্ত হওয়ার পর সহায়তার জন্য আইজির নির্দেশে পাঁচটি আলাদা কমিটি করে দেয়া হয়। আসামিদের গ্রেফতার দেখানোর আগ পর্যন্ত টানা কয়েক দিন পর্যন্ত বিশেষ নিরাপত্তায় দফায় দফায় নিশ্চিত হন কারা, কেন এবং কিভাবে হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে। এর পরেই ক্লিলিং মিশনের সদস্যদের গ্রেফতার দেখানো হয়। বাদ যায় বাবুলের প্রধান সোর্স মুসা। সেসহ অন্য আসামিদের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার গোয়েন্দা দফতরে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সামনে বক্তব্য দিতে প্রেরণ করা হয়। তারা বক্তব্য দিয়েছে। রেকর্ডও হয়েছে। এর পরেই তো বাবুলকে গভীর রাতে পুলিশ ঢাকার শ্বশুরের বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। মূলত ওই সময় তাকে গ্রেফতারর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু পরদিন বিকেল ৫টা নাগাদ অর্থাৎ ১৫ ঘণ্টা যাবত গোয়েন্দা দফতরে রেখে ছেড়ে দেয়া হয়। ১৫ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বিস্ময়কর এ ঘটনা কিভাবে ঘটল তা রহস্যজনক। এদিকে, শুরু থেকে বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন এবং শাশুড়ি শাহেদা মোশাররফ তাদের কন্যা মিতু হত্যার ব্যাপারে বাবুল আক্তারের প্রতি কোন সন্দেহ প্রকাশ করেননি। কিন্তু দিন যতই গড়াচ্ছে বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে তারা এখন আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এবং নানান বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাৎ তাদের সন্দেহের তীরও জামাতা বাবুল আক্তারের দিকে। তদন্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান গত রবিবার ঢাকায় বাসায় গিয়ে বাবুল আক্তারের শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালিকা ও ঘরের অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দীর্ঘ বক্তব্যও প্রদান করেছেন। মোশাররফ হোসেনের দীর্ঘ এ বক্তব্য তদন্ত কর্মকর্তা লিপিবদ্ধ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মোশাররফ হোসেন তার প্রদত্ত বক্তব্যে বাবুলের অতীত নানা ইতিহাস তুলে ধরেছেন। বলেছেন, পরকীয়ার কারণে তাদের কন্যা মিতুর বিবাহিত জীবন অশান্তিময় ছিল। মিতু একবার আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিল। তারা বলেছেন, এ পর্যন্ত যেসব তথ্য তাদের কাছে এসেছে এতে তারা মিতু হত্যার নেপথ্য নায়ক হিসেবে মনে করছেন জামাতা বাবুলকেই। মোশাররফ হোসেনের বনশ্রীর বাসায় তদন্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান দীর্ঘ চার ঘণ্টা তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন এবং লিপিবদ্ধ করেন। এ নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেনকে তিন দফায় এবং স্ত্রী সাহেদা মোশাররফকে দুই দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। উল্লেখ্য, মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা। পাশাপাশি বাবুল আক্তারের বাবাও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। এদিকে, বাবুল আক্তারের পরকীয়ার একটি ঘটনা প্রচারমাধ্যমে বিভিন্নভাবে এসেছে। পুলিশের এক এসআইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পর্ক ছিল। সে কারণে পরিকল্পিতভাবে বর্ণির স্বামী পুলিশের এসআই আকরামকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশী তদন্তে তাকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বলে ঘটনা ধামাচাপা বলা হয়েছে- এ অভিযোগ আকরামের আত্মীয়স্বজনদের। কিন্তু আকরামের স্ত্রী বর্ণি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য, গেল বছরের ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসি মোড় এলাকায় পুত্র মাহিরকে স্কুলগামী বাসে তুলে দিতে গিয়ে পথিমধ্যে কিলিং মিশনের সদস্যদের টার্গেট হয়ে প্রাণ হারান মিতু। এরপর নানা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহল বাবুল আক্তারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে নেপথ্যের নানা কাহিনী বের হয়ে আসতে থাকায় সন্দেহের তীর বাবুল আক্তারের প্রতি জোরালো হচ্ছে। মিতুর বাবা-মাও এখন আগের অবস্থানে নেই। তারাও বলছেন, তাদের সন্দেহ বাবুল আক্তারের প্রতি। এছাড়া ঘটনার পর বেশ কিছুদিন বাবুল আক্তার তার পুত্র-কন্যাকে নিয়ে শ্বশুরের বাসায় ছিলেন। এখন নেই। আলাদা হয়েছেন। যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছেন। অবশ্য এ নিয়ে বাবুল আক্তারের বক্তব্য এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অতীতে তিনি বিভিন্ন ঘটনার অভিযান নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেন। কিন্তু তার স্ত্রী হত্যাকা-ের ব্যাপারে সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত তো দূরের কথা, মুখে রীতিমতো কুলুপ এঁটেছেন। মিডিয়ার সঙ্গে বরাবরই দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। এ পর্যন্ত যা বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েই উত্তর দিয়েছেন। সর্বশেষ স্ট্যাটাস দিয়েছেন সোমবার। এতে তিনি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছেন। ফেসবুকে প্রদত্ত বাবুল আক্তারের স্ট্যাটাস ॥ গত রবিবার তদন্ত কর্মকর্তা সিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি কামরুজ্জামানের কাছে মাহমুদা খানম মিতুর বাবা-মা অর্থাৎ বাবুল আক্তারের শ্বশুর-শাশুড়ি যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং তার কিছু তথ্য সোমবার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে বাবুল আক্তার তার ফেসবুকে সোমবার দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এতে তিনি শ্বশুর-শাশুড়িকে উল্টো নানাভাবে অভিযুক্ত করেছেন। এছাড়া বলেছেন ‘সবাই বিচারক, আর আমি তথ্য প্রমাণ ছাড়াই খুনী’। ‘অনেকের অনেক জানতে চাওয়া আমার কাছে। আমি কথা বলার জন্য মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে কারও বিকার নেই। তবে আমার নিরুত্তর থাকার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে মনের মতো কাহিনী ফাঁদতে ফাঁদতে পরকীয়া থেকে খুন পর্যন্ত গল্প লেখা শেষ করে ফেলেছেন অনেকে। আমার কোন মাথাব্যথা নেই এসব নিয়ে, আমি আমার মা হারা সন্তান দুটোকে নিয়েই ব্যস্ত এখন। তাছাড়া প্রমাণের দায়িত্ব যারা অভিযোগ করেন তাদের। তবে আমার পরিবার পরিজন এবং শুভাকাক্সক্ষীদের কথা ভেবে কিছু কথা না বললেই নয়। শেষ থেকেই শুরু করি। ঐ শেষটা, যেখান থেকে আমার আর আমার সন্তানদের সব গ্লানির শুরু। বাচ্চা দুটো হয়েছে তাদের মায়ের মতো। ছিমছাম সাজানো ঘর ছেড়ে ঢাকায় বাবার বাড়ি বেড়াতে আসলে মিতু চট্টগ্রামে নিজের বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠত। ছেলেমেয়ে দুটোও কিছুদিনের মধ্যেই নানার বাড়ি ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু সন্তান আমার হলেও তাদের ওপর নানা-নানির অধিকারটুকু আমি বিলীন করতে চাইনি। ভেসে যাওয়ার দিনগুলোতে তারা (আমার শ্বশুরপক্ষ) আমায় আর আমি তাদের আঁকড়ে ছিলাম। তাই ছেলেমেয়ে নিয়ে দূরে সরে গিয়ে আমি অকৃতজ্ঞ হতে চাইনি। যত কষ্ট আর অস্বস্তিই হোক বাচ্চাদের নানা-নানির কথা ভেবে আমি তাদের ঘরেই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম। আমরা বাসায় কেবল লাইন রাখা মোটেও পছন্দ করতাম না শুধুমাত্র ছেলেমেয়ে অরুচিকর অভ্যাস বন্দী হবে বলে। আর মিতু মারা যাওয়ার পর থেকে নানার বাড়িতে তার বাচ্চাদের দিন শুরু হত স্টার জলসা দিয়ে, শেষও হত স্টার জলসা দিয়ে। যে মিতুর দিন শুরু হত নামাজ দিয়ে তার সন্তানেরা সকাল সাতটায় জেগে টিভিতে সিরিয়াল দেখে দেখে বেলা এগারটায় নাশতা খেতে পেত। আমরা এ ধরনের খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত ছিলাম না। ছেলে শাকসবজি খেতে পছন্দ করলেও মাসে দুই-একবারের বেশি তা খাওয়া হতো না। অন্যের বাড়িতে বাচ্চার ক্ষুধা আর স্বাস্থ্যের তাগাদা দেয়ার সুযোগ আমার ছিল না। তবুও আমি চুপ ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম। আমার ছেলেটার চোখের সামনে তার মা খুন হয়েছে। নিয়মিত কাউন্সিলিং করিয়েছি তাকে। কাউন্সিলরের একটাই কথা কোন অবস্থাতেই ছেলের সামনে তার মায়ের মৃত্যু সংক্রান্ত কোন কথা বলা বা তাকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করা যাবে না। ছয়টা মাস আমি চব্বিশ ঘণ্টা ছেলেটার পাশে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি । খেয়াল রেখেছি যেন সে এসব কথাবার্তার মুখোমুখি না হয়। তবে বাইরে একদম না বের হয়ে তো পারা যেত না। যেদিনই বাইরে যেতাম ফিরলে দেখতাম ছেলে আমার মুষড়ে আছে। বাইরে থেকে ফেরার পর এক মধ্যরাতে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা আমায় প্রশ্ন করে, “বাবা, কান্না চেপে রাখলে কী বুকে ব্যাথা হয় আমার বুকে এত ব্যাথা করে কেন? আমি তাকে বুকে জড়িয়ে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? সে বলল, “নানা-নানি সারাদিন আম্মুর কথা বলে আমার খুব কান্না আসে। কিন্তু কান্না করতে পারি না, আমার বুকে ব্যথা করে। তারপর আমাকে বলল যেন তাকে চট্টগ্রামের বাসার মতো সুন্দর বাসায় নিয়ে যাই, দু’মাসের মধ্যেই। ছেলের নানার বাড়িতে অস্বস্তি হওয়ার অনেক কারণ ছিল। আমার শ্বশুরবাড়িতে যৌথ পরিবার। অর্থাৎ, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার শ্যালিকা ও তার স্বামী, আমার শাশুড়ির নিজের বোন এবং সেই বোনের স্বামী-সন্তানসহ মোট তিনটি পরিবার আমার শ্বশুরের চার বেডরুমের ঘরটিতেই থাকে। আমার শ্বশুরপক্ষের জামাতারা নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে শ্বশুরবাড়িই থাকে। এটা তাদের পারিবারিক রীতি (যাতে আমি অভ্যস্ত নই)। মিতু মারা যাওয়ার পর আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির একটি রুমে থাকতাম। ঘরটা যেন আরও ঘিঞ্জি হয়ে উঠল। শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরও আরও কষ্টে পড়তে হলো। তাছাড়া চারপাশে বস্তিবাসীর চেঁচামেচি আর অশ্লীল কথোপকথন ছেলেকে আরও খিটখিটে করে তুলছিল। জন্মের পর থেকে যে সন্তানদের আমরা সুবচনে অভ্যস্ত করেছিলাম তারা মায়ের মৃত্যুর পর চারপাশ থেকে গালমন্দ শিখতে শুরু করল। এভাবেই দিন কাটছিল। মাঝে আর বাসা পরিবর্তন নিয়ে ছেলের সঙ্গে কোন কথা হয়নি, ভাবলাম হয়ত সে ভুলে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলে আমাকে টেনে ক্যালেন্ডারের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, “বাবা, আজ তোমার দু’মাসের সময় শেষ।” আমি অবাক হয়ে দেখলাম ছেলে আমার দু’মাস ধরে ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে দিন গুনছিল নানার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার। তারপর আমি ছেলের কাছ থেকে আরও ১৫ দিন সময় চেয়ে নিলাম। সবদিক বিবেচনা করে আমি শ্বশুর-শাশুড়িকে জানালাম যে বাচ্চারা এই পরিবেশে অনভ্যস্ত এবং থাকতে চায় না, তাই তাদের নিয়ে সুন্দর পরিবেশে থাকা প্রয়োজন। তারা খুব সুন্দর সমাধান দিলেন। বললেন তাদের ঘরের ওপরেই আরও ঘর তৈরি করতে আমি যেন ১০ লক্ষ টাকা দেই এবং সেখানেই থাকি। আমি যে দশ টাকার লোকও নই, একথা বোঝানোর মতো সাধ্য আমার ছিল না। আর ঘর ঘিঞ্জি না হওয়ার সমাধান স্বরূপ বললেন যেন আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন কেউই আমার কাছে না আসে। আমার শ্বশুর বললেন, হয় আমাকে আমার বাবা-মা ছাড়তে হবে, না হয় শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়তে হবে। আমি কী মরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম? কী জানি! তবে আমি চুপ ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম। দিন কাটছিল যুগের গতিতে। ছেলেমেয়ে রাত বারোটা পর্যন্ত পড়াশোনা করতে শুরু করল। আমি ভীত হয়ে উঠলাম। কারণ শিশু বয়সে পড়াশোনার চাপ নেয়াটা আমি মানসিক বিকাশের অন্তরায় হিসেবেই দেখি। তাছাড়া মা হারিয়ে আমার সন্তানেরা এমনিতেই তীব্র মানসিক চাপের মাঝে ছিল। আমি একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম এত রাত পর্যন্ত তারা কী পড়াশোনা করে। তখন ছেলে বলল নানি বলেছে তাকে বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে চান্স পেতেই হবে এবং তাই ‘ছোটআম্মু’ তাদের মধ্যরাত পর্যন্ত পড়ায়। ভাবলাম মিতুর ছোটবোন শায়লার কথা বলছে। কিন্তু পরে আবিষ্কার করলাম মিতুর সদ্য এসএসসি পাস করা ১৬ বছর বয়সী খালাত বোনকে (যে তার পরিবারসহ মিতুর বাবার বাড়িতেই থাকে) আমার ছেলেমেয়েকে ‘আম্মু’ ডাকা শেখানো হয়েছে এবং আমাদের সবকিছুর তদারকিও সেই বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে করানো হয়। একদিন ছেলের স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে মায়ের ভূমিকায় পাশে এসে বসে মেয়েটি। বিভিন্ন সময়ে তাকে এগিয়ে দেয়া হতো বাচ্চাদের মায়ের ভূমিকায়। রাতে ফিরে দেখতাম ছেলেমেয়ে নিয়ে সে আমার ঘরেই আছে। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ায় আমি এতটা বিকারগ্রস্ত হইনি যে, একটা ইন্টার পড়ুয়া ১৬ বছরের বাচ্চামেয়েকে বিয়ে করে আমার বাচ্চাদের ‘মা’ বানাতে হবে। তাদের একটাই কথা, শ্বশুরের বাড়িতেই নতুন ঘর বাঁধতে হবে এবং সেখানেই থাকতে হবে। আমার ঐসময়কার অনুভূতি কোন শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে দিনদিন এসব আচরণ এতটাই বিধতে লাগল যে, আমি আমার দ্বিমত প্রকাশের জন্য কোন শব্দ না খুঁজে বরং একটা চাকরি ও বাসা খুঁজে নিলাম। আমার শ্বশুর পক্ষকে জানিয়েই বাসা নিয়েছি এবং এতে তারা ভীষণ মনক্ষুণœও হয়েছিলেন। বলেছিলেন এর পরিণাম হবে খারাপ এবং আমাকে পচিয়ে ছাড়বেন তারা। তবে প্রস্থানে আমি চুপই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম। বাস্তব জীবনটা কোন চলচ্চিত্র না। আমি সুপারকপের মতো উঠে গিয়ে স্ত্রীর খুনী বের করে ফেলব?! সবকিছুর নিয়ম থাকে, প্রক্রিয়া থাকে। তদন্ত তদন্তের নিয়মে চলছে এবং সেই প্রক্রিয়ায় আমার যতটুকু প্রয়োজন অংশগ্রহণও রয়েছে। আমাকে যখনই তদন্তের প্রয়োজনে ডাকা হয়েছে আমি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছি। তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। বাদীর কাজ সাক্ষীকে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া, এটা আমি বুঝতে পারিনি! আমার মা-বাবা কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ি কাউকেই তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার মতো বিলাসিতা করার সুযোগ আমার নেই কারণ মায়ের মৃত্যুর পর থেকে একরাতও বাচ্চারা আমায় ছেড়ে থাকেনি। জন্মের পর থেকেই তারা রাতে আমার সঙ্গে ঘুমিয়েই অভ্যস্ত। আমাকে কয়েকঘণ্টা না দেখলেই কেঁদে অস্থির হয় তারা। আমাকে দিনের মধ্যে কয়েকবারই বাসায় যেতে হয়, অনেক সময় ছেলেমেয়েকে নিয়েই অফিসে যেতে হয়। তাই প্রথমে আমার শ্বশুরের পছন্দমত তার বাড়ির কাছের স্কুলটিতে ভর্তি করালেও ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকে আবার আমার অফিসের কাছাকাছি একটি স্কুলে ভর্তি করাই। মিতু যেদিন মারা যায় সেদিন সারাদেশই ছিল দিশেহারা। আমার শাশুড়ি ও শ্যালিকাও (শায়লা) ছিল শোকে বিহ্বল। তারা সেদিন দুঃখে মিতুর লাশ বাদ দিয়ে আমাদের আলমারী থেকে আমাদের সব কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি আর জমানো কিছু টাকাপয়সা ব্যাগে ভরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসাতেই ব্যস্ত ছিল! তাছাড়া এর কিছুদিন পর তারা মিলাদ পড়ানোর নামে চট্টগ্রাম গিয়ে বাইরে থেকে মিস্ত্রী ডেকে নিয়ে আমার বাসার আলমারী ভেঙ্গে বাকি যা কিছু ছিল তাও নিয়ে আসে। পরবর্তীতে মিতুর ব্যবহৃত জামাকাপড় ও জিনিসপত্র তার আত্মীয় স্বজনদের ব্যবহার করতে দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম। মায়ের স্মৃৃতি হিসেবে বাচ্চা দুটোর জন্য আমার কাছে আর কিছুই নেই। শোকগ্রস্ত আমি চুপই ছিলাম, কৃতজ্ঞ ছিলাম। পৃথিবীর এমন একটি দম্পতি আমি দেখতে চাই যাদের মধ্যে মতবিরোধ এবং মনোমালিন্য হয় না। আমি কী আকাশের চাঁদই হাতে চেয়ে ফেললাম? হ্যাঁ, অতি অবশ্যই হ্যাঁ। আমি আগেও বলেছি, নির্ঝঞ্ঝাট সংসার দেবদূতেরও হয় না। আমার সংসারেও ছোট বড় রাগ অভিমান হত, যেভাবে আর দশজনের হয়। সবাই নিশ্চয় এজন্য একে অন্যকে মেরে ফেলে না। তাছাড়া একে অন্যকে মেরে ফেলার জন্য কেউ চৌদ্দ বছর সংসার করে না। একে অন্যকে মেরে ফেলার জন্যই কী কেউ দুটি সন্তানের জন্ম দেয়? আর আমার পরকীয়া সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম থেকে জেনে একজন যৌক্তিক পাঠক হিসেবে আমার প্রশ্ন এসবের কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে কী না? নিহত আকরামের বোন রিনি অভিযোগ করেছেন যে আমার প্রভাবে পুলিশ আকরাম হত্যার অভিযোগ থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছিল। অথচ তিনি তখন আমার নামে কোন অভিযোগই করেননি। রিনি তখন আদালতে অভিযোগ করেছিলেন যে আকরামের স্ত্রী তার ফুপাত ভাই মুনের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কের জের ধরে আকরামকে খুন করে। ঐ অভিযোগে আকরামের স্ত্রী, তার কথিত প্রেমিক মুন এবং আকরামের শ্বশুর-শাশুড়ির নাম উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া ঘটনার সময় আমি দেশেও ছিলাম না। এত বছর পর রিনি আগের সব অভিযোগ ভুলে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে তার ভাই হত্যার বিচার চাইতে গিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের (আমার শ্বশুর) কাছে!!! আর নিহত আকরামের স্ত্রী থাকেন মাগুরা এবং ঝিনাইদহে; আমার পদোন্নতির আগ পর্যন্ত আমি থাকতাম চট্টগ্রামে। আর আমার বছরে একবারও বাড়ি যাওয়ার মতো সময় সুযোগ হতো না। পরিচয় ছাড়া, যোগাযোগ ছাড়া, দেখা সাক্ষাত ছাড়াও যে পরকীয়া হয় এটা জানা ছিল না। আকরামের বোন অভিযোগ করেছেন যে ছেলের শোকে তার মা মারা গিয়েছেন। এখন আকরামের মায়ের মৃত্যুর দায়ও যদি আমার ওপর চাপানো হয় আশ্চর্য হব না!!! কারণ তিনি তো বিচার চাইতে গেছেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের (আমার শ্বশুর) কাছে। এটা ঠিক যে মৃত আকরামের স্ত্রী মাগুরায় আমাদের একই এলাকায় থাকতেন এবং তার স্বামী মারা যাওয়ার পর আকরামের রেখে যাওয়া সম্পদ নিয়ে পারিবারিক বিরোধের কারণে সে আমার ছোট ভাইয়ের (পেশায় আইনজীবী এবং মাগুরায় থাকে) কাছ থেকে আইনী সহায়তা নিয়েছিল, যে ঘটনায় আমার কোন সংশ্লিষ্টতাই ছিল না। একই এলাকায় থাকলে কিংবা বাবা-ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় থাকলেই যদি পরকীয়া হয়ে যায় তবে আমার পরকীয়ার প্রেমিকাদের নাম লেখা শুরু করলে তা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে পৌঁছলেও শেষ হবে না। যখনই আমি শ্বশুর-শাশুড়ির অমতে বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা বাসায় আমার মা-বাবাকে নিয়ে থাকা শুরু করলাম, তখনই আমার শ্বশুর আমার পরকীয়ার খোঁজ পেলেন, ঠিক তখনই আমার শাশুড়ি মিতুর সঙ্গে আমার খারাপ সম্পর্কের কথা জানতে পারলেন, আর তখনই আকরামের বোন জানতে পারলেন তার ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরকীয়া ছিল; তখনই তারা জানলেন চিত্রনাট্যের নাট্যকার ছিলাম আমি!!! আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর-শাশুড়ি হয়তো সেই নীতি অনুসরণ করেছেন, ‘একটা মিথ্যা দশবার বললে তা সত্যে পরিণত হয়।’ তারপরও আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। কারণ, তারা তো আমার স্ত্রীর বাবা-মা, আমার সন্তানের নানা-নানি। আমি চাই আমার স্ত্রী হত্যার সঠিক বিচার হোক। সে আমার সন্তানদের মা, আমার পৃথিবীর ভিত ছিল সে। তাকে হারিয়ে আমি এবং আমার বাচ্চা দুটোর চেয়ে বেশি কষ্ট কেউ পেয়েছে বলে আমার বোধ হয় না। এখনও সামলে উঠতে পারিনি আমরা। বাচ্চাদের একটা স্বাভাবিক জীবন দেয়ার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরমধ্যেই যে যা ইচ্ছে বলছে, ছাপছে। আমার ছেলেটা যখন এসব সংবাদ পড়ে ও দেখে তখন তার মানসিক অবস্থাটা কী দাঁড়ায়? কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র কারও ব্যক্তিস্বার্থে করা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে যারা কথা বলছেন, তারা আমার জায়গায় নিজেকে একবার রাখুন, নিজের সন্তানটিকে আমার ছেলের জায়গায় ভাবুন। তারপর কলম হাতে নিন, সংবাদ বাণিজ্য করুন। আজ আমার ছেলের জন্মদিন, মাকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন তার। কী ভাবছে সে মনে মনে? কতটা কষ্ট পাচ্ছে সে? এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায় কার? কথাগুলো একান্তই পারিবারিক। মেয়ে হারিয়ে মা-বাবার কষ্ট প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়ত এসব ভিত্তিহীন অসংলগ্ন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাবার্তা, তাই আমি প্রত্যুত্তরে এতটুকু শব্দ করতেও নারাজ। কিন্তু এখন কথাগুলো পরিবারের সীমা পেরিয়ে লোকের ঘরে ঘরে বিনোদোনের উৎস হিসেবে স্থান পেয়েছে। তাই আজ কিছু বলতে হল। এত স্বল্প পরিসরে সবটুকু বলে শেষ করা সম্ভব নয়। যদি সব বলতে বসি তবে হয়ত একটা বই-ই হয়ে যেত।’
×