ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাটো মানুষকে নিয়ে তামাশা নয়

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

খাটো মানুষকে নিয়ে তামাশা নয়

সমাজে খাটো মানুষকে নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাশা করা হয়, ব্যবহার করা হয় সিনেমায় বা সার্কাসে ভাঁড় হিসেবে। কিন্তু মনে রাখা উচিত এই বামনত্ব কোন ঠাট্টার বিষয় নয়, বরং এটি এক ধররের শারীরিক সমস্যা এবং এর বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা আছে। এমনকি বিশ্বখ্যাত ফুটবলার লিওনেল মেসিও ছোটবেলায় এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ও দীর্ঘদিন চিকিৎসার আওতায় ছিলেন। আর এই সফল চিকিৎসার কারণেই বিশ্ব আজ তার মতো খেলোয়াড়কে পেয়েছে। কিন্তু শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার কারণ, সমস্যা নির্ণয় ও এর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষই এখনও রয়েছেন অন্ধকারে। যদিও এই সব সমস্যার সফল চিকিৎসা এখন আমাদের দেশেও সুলভ। কী করে বুঝবেন আপনার শিশু বাড়ছে না? একটি শিশু যদি তার সমবয়সীদের তুলনায় কম উচ্চতাসম্পন্ন হয় তবেই অভিভাবকরা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হতে পারেন। জেনে রাখুন একেক বয়সে উচ্চতা বৃদ্ধির হার একেক রকম ২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু বছরে ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এরপর এই হার কমে আসে এবং ৫/৬ বছর বয়স পর্যন্ত এই হার বছরে ১০-১২ সেন্টিমিটার। ৬/৭ বছরে আরও কমে বছরে ৫-৬ সেন্টিমিটার হারে বাড়ে। আবার বয়ঃসন্ধিকালে হঠাৎ করেই লম্বা হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং বছরে ১০-১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে থাকে। ১৪/১৫ বছরের পর থেকে বৃদ্ধির হার আবারও কমতে থাকে, গড়ে ১ সেন্টিমিটার হারে বেড়ে চলে ১৯ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত। উল্লেখ্য, যে এর পর বৃদ্ধি থেমে যায়। শিশুর বৃদ্ধি কেন ব্যাহত হয়? একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি অনেকটাই যেমন জিনগত ও পরিবেশগত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে তেমনি নির্ভর করে তার সার্বিক সুস্থতা ও হরমোনের ওঠানামার ওপর। একেক এলাকায় ও একেক পরিবারে উচ্চতার প্রবণতা একেক রকম। এছাড়া শৈশবে কোন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা, যেমন কিডনি বা ফুসফুসের রোগ, অপুষ্টি, হজমের গোলামাল ইত্যাদি কারণে শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীরের প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি যে হরমোনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তার মধ্যে থাইরয়েড ও গ্রোথ হরমনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই হরমোনগুলোর অভাবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি থমকে যেতে পারে বা ধীরে হতে পারে। নানা ধরনের জেনেটিক সমস্যায় মানুষ খাটো হয়, যেমন টার্নার বা ডাউনস সিনড্রোমে। বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা কী সমস্যার সৃষ্টি করে? ঠিক মতো বৃদ্ধি না হলে একটি শিশু নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। অনেক সময় এই বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যৌবন প্রাপ্ত না হওয়ার সমস্যাও দেখা দেয়, যা পরবর্তীতে তার বিবাহ, সন্তান ধারণ বা পারিবারিক জীবনকে ব্যাহত করবে। এছাড়া এই শিশুরা টিজিং ও বুলিং এর শিকার হয় বেশি, সমাজে একঘরে হয়ে পড়ে, শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে অনেক মেধা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়ে। আমাদের দেশে নানা কুসংস্কারের শিকারও হয় এরা। বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতার কি চিকিৎসা আছে? কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে বামনাকৃতি শিশুদের চিকিৎসা বিপত্তিকর ছিল। কেননা তখন মৃতদেহের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে হরমোন নির্যাস সংগ্রহ করা হতো এবং এতে প্রায়ই প্রতিক্রিয়া ও নানা রোগের আশঙ্কা থাকত। ১৯৮৫ সালে এই পদ্ধতি বাতিল করা হয় এবং বর্তমানে কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন সোমাট্রপিন বা নরডিট্রোপিন দিয়ে সাফল্যের সঙ্গে এর চিকিৎসা করা হচ্ছে। বর্তমানে যে কয়েকটি সমস্যায় গ্রোথ হরমোন থেরাপি ব্যবহৃত হয় তা হলো : ১ বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত শিশু যার গ্রোথ হরমোন অপর্যাপ্ত, ২. টার্নার সিনড্রোম ৩. কম ওজন ও ছোট আকার নিয়ে ভূমিষ্ঠ শিশু এবং ৪. কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত কারণে যাদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন রাতে নির্দিষ্ট মাত্রার গ্রোথ হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয় এবং পর্যবেক্ষণ করা হয়। গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ছাড়া বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার অন্য কোন কারণ থাকলে সঠিক কারণটি নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। তবে দুটো বিষয় মনে রাখবেন-এক. সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও পরামর্শ নিতে হবে, এবং দুই . যত কম বয়সে চিকিৎসা শুরু করা যায় ততই ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। কৈশোর বা তারুণ্য এসে উচ্চতা বৃদ্ধি কি সম্ভব? উচ্চতা সমস্যা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয় আমাদের দেশে কৈশোরে বা তারুণ্য এসে। যখন একটি তরুণ বা তরুণী দেখে যে সে আর দশজনের মতো নয়। এসময় এরা উচ্চতা বাড়ানো কৌশল হিসেবে নানা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয় এবং নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার আশ্রয় নেয়। আামদের হাড়ের উচ্চতা ততদিনই বাড়ে যতদিন পর্যন্ত লম্বা হাড়ের শেষ মাথায় অবস্থিত তরুণাস্থি বা প্লেটটি হাড়ের সঙ্গে মিশে না যায়। যৌবন প্রাপ্ত হলে হরমোনের প্রভাবে এই প্লেট মূল হাড়ের সঙ্গে মিশে যায় বা ফিউশন হয়ে যায় এবং এর পর আর হাড় লম্বায় বাড়তে পারে না। সাধারণত এই ফিউশন ঘটে ছেলেদের বেলায় ১৬ বছর ও মেয়েদের ১৪ বছরের মধ্যে। যদিও ১৯ থেকে ২১ বছর পর্যন্ত আরও কিছুটা উচ্চতা বৃদ্ধি হতে পারে তবু ফিউশন হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা করলে ও তেমন কোন ফল পাওয়া যাবে না। অধ্যাপক মোঃ ফারুক পাঠান হরমোন ও ডায়াবেটিস বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল
×