ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভিশন ঘাটতিতে ছয় ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রভিশন ঘাটতিতে ছয় ব্যাংক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ৬ ব্যাংক। এ তালিকায় সরকারী ও বেসরকারী খাতের ৩টি করে ব্যাংক রয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকেরই ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। তবে এ সময়ে কয়েকটি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ তিন মাসেই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণেই ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোন লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এতে নিরুৎসাহিত হন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া এ সময়ে যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্র্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোন প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলোÑ প্রভিশন সংরক্ষণ। বেসিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, সার্বিকভাবে তাদের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণও বেড়েছে। তিনি বলেন, ক্যালকুলেশনের মারপ্যাঁচেও অনেক সময় খেলাপি ঋণ বাড়তে পারে। আবার একটা ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করার পর পুনরায় খেলাপি হয়ে পড়তে পারে। আর খেলাপি হলেই ওই ঋণের বিপরীতে নিয়মমাফিক প্রভিশন রাখতে হয়। তবে তার সময়ে খেলাপি ঋণের প্রায় ৯৭৮ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণীকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। সূত্রগুলো বলছে, হলমার্ক, বিসমিল্লা ও বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকিং খাত থেকে গত কয়েক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ বের করে নেয়া হয়েছে। যার সামান্য অংশও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যার সবটাই এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বেসরকারী কিছু ব্যাংক থেকেও নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশেষ সুবিধায় যে ঋণগুলো পুনঃতফসিল ও পুনগর্ঠনের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছিল ওইসব ঋণের একটি অংশ নতুন করে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। আর ব্যাংকগুলোকে আয়ের খাত থেকে অর্থ এনে এই প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশবঞ্চিত হন। এছাড়া যেসব ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণ বেশি হলে ঋণের সুদও বাড়ে। এতে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদোক্তারা নিরুৎসাহিত হন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। এক বছর আগে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ ছিল। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। তবে গেল বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই তিন মাসে এ খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় ৩ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এদিকে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৩৬ হাজার ২০৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩০ হাজার ৭৩৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৪৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে প্রভিশন ঘাটতি ছিল প্রায় ৪ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে ছিল। জুনে তা বেড়ে ৭টি ও সেপ্টেম্বরে তা ৮টিতে পৌঁছায়। তবে ডিসেম্বরে ২টি কমে আবার ছয়টিতে নেমেছে। এ সময়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও বেসরকারী স্টান্ডার্ড ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতি থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৭৭৬ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ২৪১ কোটি ৬০ লাখ ও বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৬৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। এ সময়ে বেসরকারি খাতের তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৪৫৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১২৩ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৮৮ কোটি ৫৬ লাখ ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৪৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে ৮টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল। এ তালিকায় ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, বেসিক ও রূপালী ব্যাংক, বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং বেসরকারী খাতের প্রিমিয়ার, ন্যাশনাল, স্টান্ডার্ড ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা ৮টি ব্যাংকের মধ্যে ৫টিই মূলধন ঘাটতিতে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারী-বেসরকারী মিলে ৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল। এর মধ্যে সরকারী খাতেরই সাতটি। এগুলো হলোÑ সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। তাদের মোট ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। সরকারী ব্যাংকগুলোর বাইরে মূলধন ঘাটতির তালিকায় ছিল ২টি বেসরকারী ব্যাংকও। এগুলো হলোÑ বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়।
×