ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আগামীতে মানুষ অতিমানবে পরিণত হবে ॥ ইউভাল হারারি

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আগামীতে মানুষ অতিমানবে পরিণত হবে ॥ ইউভাল হারারি

ইউভাল নোয়াহ হারারি একজন স্বনামধন্য ইসরাইলী ইতিহাসবিদ। তাঁর রচিত “সেপিয়েনস” ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে বেস্ট সেলারের মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর একটি নতুন গ্রন্থও বেরিয়েছে। নাম “হোমো ডিউস”, সেখানে তিনি মানবজাতির ভবিষ্যত চিত্র এঁকেছেন। সম্প্রতি মার্কিন সাময়িকী “টাইম” পত্রিকায় তার এক সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। হারাবির নতুন গ্রন্থে এমন এক ভবিষ্যতের কল্পনা করা হয়েছে যেখানে মানুষ সর্বাধিক বিকশিত বিশ্বে বাস করলেও তারা সেখানে নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং তাদের জীবনের যাবতীয় অর্থ হারিয়ে যায়। মাথার উপর এমন এক মেঘমালা ঝুলন্ত থাকা অবস্থায় তার কেমন লাগে সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্যেক প্রজন্মেই মানবজাতি কোন না কোন মেঘমালার নিচে বাস করেছে। এক মেঘমালা চলে গেছে, অন্য মেঘমালা এসে সেস্থান দখল করেছে। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধি নিঃসন্দেহে সমাজকে আমূল পরিবর্তন করে দিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে সম্ভাব্য বিপদও নিহিত। কেউ যদি ভাবে যে, আমাদের করার কিছু নেই তাহলে মানুষের মন খারাপ করে দিয়ে লাভ কি। হারারির নতুন গ্রন্থ হোমো ডিউসের অর্থ অতিমানব। গ্রন্থে তিনি এই সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন যে আগামী দিনে বাছাই করা মানুষ হোমো ডিউস বা অতিমানবে পরিণত হবে। এই অতিমানবরা সারাদিন কি করবে? হারারে তা জানেন না। তার কোন ধারণা নেই। তবে তারা নিজেদের ক্ষমতা ও সামর্থ্যকে উন্নত করার জন্য জৈব প্রকৌশল ও কৃত্রিম বুদ্ধিকে কাজে লাগাবে। তারা নিজেদের বদলানোর জন্য, নিজেদের মনকে বদলানোর জন্য, নিজেদের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে বদলানোর জন্য যদি আপন ক্ষমতাকে কাজে লাগায় তাহলে তারা কি করতে চাইবে কেউ বলতে পারে না। হারারি বলতে পারেন না কি হতে পারে যদি ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস ব্যবহার করে দুই মস্তিষ্কের মধ্যে এমনভাবে সংযোগ সাধন করা যায় যে একজন আরেকজনের স্মৃতির রাজ্যে চলে যেতে এবং অন্যজনের শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে মানুষের নিজস্ব পরিচিতি বা সত্তার কি হবে সেটাও তার জানা নেই। কিংবা জানা নেই তাঁর লিঙ্গ পরিচিতির। হারারি বলেন, “আজ আমি একজন নারী হিসেবে দ্বি-মাত্রিক কম্পিউটার গেম খেলতে পারি...কি হবে যদি আমরা সেই কাজটাই এমন এক ত্রি-মাত্রিক ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে করতে পরি সেখানে আমাদের শুধু ভিশন ও অডিওই নয়, উপরন্তু আমাদের গোটা শরীর রয়ে গেছে? সেখানে হয়ত সত্তা বা পরিচয়ের খোদ ধারণাটি, একটা নির্ধারিত কাহিনীই সেকেলে বা বাতিল হয়ে দাঁড়াতে পারে। হারারিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল : “আপনি লিখেছেন যে যুদ্ধ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ নির্মূল করার পর মানবজাতি প্রশান্তি, অমরত্ব ও দেবত্ব খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবে। সেই তালিকায় কোন লক্ষ্যটি আপনি যোগ করবেন?” হারারি বলেছেন : “আমি সত্যকে যোগ করব এবং বিশেষ করে নিজেদের আমাদের মন সম্পর্কে উপলব্ধিটা যোগ করব। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা আমাদের বাইরের জগতকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্জন করেছি কিন্তু আমাদের ভিতরের জগতটাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে নয়। আপনি একটা নদীর প্রবাহকে রুদ্ধ করতে পারেন। তবে দেহের বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করতে পারেন না। আপনি মশা মেরে ফেলতে পারেন। কিন্তু আপনার মাথার মধ্যকার যে বিরক্তিকর ভাবনাগুলো গুণ গুণ করে বেজে চলেছে সেগুলোকে নয়। একবিংশ শতকে আমরা আমাদের ভিতরকার জগতকে নিয়ন্ত্রণ করার, শুধু মশাকে নয়, মস্তিষ্কের ভেতর মশার মতো গুন গুন করে চলা ভাবনাগুলোকে মেরে ফেলার ক্ষমতা করায়ত্ব করতে চলেছি। বিপদটা হচ্ছে এই যে, আমরা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করব এবং এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেশগত বিপর্যয়Ñমানসিক দিকদিয়ে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি টানব। প্রশ্ন করা হয়েছিল হারারিকে : “তাঁর মানে অজ্ঞতা পরম সুখ নয়?” তার জবাব ছিল : স্রেফ অজ্ঞতা খুব বেশি বিপজ্জনক নয়। অজ্ঞতার সঙ্গে ক্ষমতাকে যুক্ত করা হলে তা এক বিষাক্ত মিশ্রণে পরিণত হয়। প্রযুক্তিকে পরিহার করলে দ্রুত পিছিয়ে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। আর সেটা ব্যবহার করলে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ঝুঁকি থাকে। এক্ষেত্রে হারারি কোন পথটা বেছে নিয়েছেনÑএই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিনি মাঝামাঝি পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি এখনও বিযুক্ত হতে সক্ষম হওয়ার চেষ্টা করেন। এক ঘণ্টা মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে তিনি তার দিবসের কাজ শুরু ও শেষ করেন। প্রতিবছর তিনি ৩০ থেকে ৬০ দিনের দীর্ঘ মেডিটেশনের অবকাশে যান। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হবার খবর প্রকৃতপক্ষে শুনেছিলেন ২০ ডিসেম্বর তারিখে। কারণ তিনি ৪৫ দিনের এক নীরব মেডিটেশনে ছিলেন। হারারিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এমনটা ধরে নেয়া নিরাপদ কি না যে, তিনি নিজের সম্পর্কে ড্যাটা হস্তান্তরিত করার ব্যাপারে সন্দেহ বাতিক? এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, কথায় বলে যে কখনও কোন কিছু যদি মুফতে পেয়ে যান তাহলে আপনার জানা উচিত, আপনি নিজেই একটা পণ্যে পরিণত হয়েছেন। ফেসবুক, জিমেইল ও ইউটিউবের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সত্য আর কখনই কিছু হতে পারে না। আপনি ফ্রি সোশ্যাল মিডিয়া সার্ভিস পাচ্ছেন, ফ্রি ফানি ক্যাট ভিডিও পাচ্ছেন। বিনিময়ে আপনার সবচেয়ে মূল্যবান যে সম্পদ যা কি না আপনার ব্যক্তিগত ড্যাটা তা হাতছাড়া করে ফেলছেন। এ্যামাজন ইকো কেনার ব্যাপারে কিসের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে হারারি বলেন : “আমার বিকল্প কোন পথ থাকবে না। ইকো না থাকলে আমি খাবার কিনতে পারব না, স্বাস্থ্য পরিচর্যা লাভ করতে পারব না। আমি যে বিষয়টার উপর গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করছি তা হচ্ছে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পথে যাত্রাকে থামিয়ৈ দেয়ার চেষ্টা করা নয়, বরং আমি আরও দ্রুত ছুটে চলার চেষ্টা করি। আপনার নিজেকে জানার চাইতে এ্যামাজন যদি আপনাকে বেশি জেনে ফেলে তাহলে তো খেলাই শেষ হয়ে গেল। অনুবাদ: এনামুল হক ॥ সূত্র : টাইম
×