ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

রামপালকে খোলা মনে দেখুন

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রামপালকে খোলা মনে দেখুন

রামপালের প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও হুমকি-ধমকি যথারীতি অব্যাহত রয়েছে। লক্ষণীয় যে, ইদানীং দেশে সরকার যখনই কোন প্রকল্প হাতে নেয় তখনই এক শ্রেণীর লোক বা সংগঠন নানা নয়-ছয় বলে তা প্রতিহত বা নস্যাত করার চেষ্টা করে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়েও এ ধরনের অপচেষ্টা নিশ্চয়ই কারও দৃষ্টি এড়ায় না। আর রামপাল নিয়ে তো রীতিমতো তুলকালাম বাধানোর চেষ্টা চলছেই। শুধু তাই নয়, সরকার গৃহীত অন্য অনেক কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও অনুরূপ চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। সরকার যদি জনস্বার্থবিরোধী কিছু করে তবে অবশ্যই তা প্রতিহত করার দায়-দায়িত্ব জনগণের ওপর বর্তায় বৈকি! কিন্তু যদি কোন মতলবী উদ্দেশ্যে কোন ব্যক্তি বা সংগঠন নিছক সরকারের বিরোধিতার জন্য কিংবা দেশী-বিদেশী কোন মহলের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দুরভিসন্ধি হাসিলের জন্য ব্যবহৃত হয়ে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে তৎপর হয়, তখন নিশ্চয়ই তা মেনে নেয়া যায় না বা যাবে না। রামপাল কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি যে এই ধরনের একটি বিষয়, তা কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত ছিল আরও সহজবোধ্য করে জনগণের সামনে মেলে ধরা। তা না করে প্রধানত আমলাদের বুদ্ধিতেই পত্রপত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের করে এমনভাবে তা উপস্থাপন করেছে, যা এর পরিবেশনাগত দুর্বলতার কারণেই মানুষের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য বা কনভিনসিং মনে হয়নি। এসব ব্যাপারে পরিবেশবাদী বা বিরোধিতাকারীরা যা বলছে বা যেসব সত্য-মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করছে, তা প্রত্যাখ্যান করতে হলে সরকারের উচিত এ বিষয়ে শুধু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য তুলে ধরা। আর তা যদি সরকারী ব্যানারে করা হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তা মানুষের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের যাবতীয় টেকনিক্যাল ও প্রাকটিক্যাল চিত্রটি বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাটি ছিল অতীব জরুরী এক বিষয়। টিভিতে টক শোতে যারা এসব নিয়ে কথা বলেন বা এই জাতীয় প্রকল্পের বিরোধিতা করেন, তাদের অধিকাংশই এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। বরং বুদ্ধিজীবীর নামাবলী গায়ে চাপানো কিছু ব্যক্তি, যাদের অনেকেই কিনা বিদেশী কোম্পানি বা বিদেশী রাষ্ট্রের স্বার্থের হয়ে ছদ্মবেশে কাজ করে থাকেন। এই জাতীয় ছদ্মবেশীদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য যেসব কার্যক্রম হাতে নেয়া দরকার ছিল, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ও সংশ্লিষ্ট আমলারা তা জানেন বা বোঝেন, এমন কোন দৃষ্টান্ত আমাদের চোখে পড়ে না। সরকার যদি এক শ’ ভাগ নিশ্চিত হয়ে থাকে যে, রামপাল কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পটি কোনক্রমেই জনস্বার্থের ব্যাঘাত ঘটাবে না, তাহলে সে বিষয়ক তথ্য এবং বিশেষজ্ঞ মত (দেশী এবং আন্তর্জাতিক) প্রচার করা আবশ্যক। আর সে সব প্রকাশ-প্রচার বা পরিবেশনা হতে হবে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে স্থানীয় ও জাতীয় স্টেক হোল্ডারদের উপস্থিতিতে বা তাদের উপলক্ষ করে। টিভিতে কেন এই ধরনের বিশেষজ্ঞকে উপস্থিত করা হচ্ছে না? পত্রপত্রিকায় কেন তাদের নিবন্ধ-প্রবন্ধ ছাপার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না? কেনই বা তথ্যচিত্র নির্মাণ করে বিরোধীদের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যকে নাকচ করা হচ্ছে না? উচিত তো ছিল বিরোধীদের অসার যুক্তি বা মতলবী উদ্দেশ্যকে জনসম্মুখে মেলে ধরে তা নস্যাত করে দেয়া। যাহোক, যারা এসব বিষয়ে সরকারের পলিসিমেকার, তারা যদি দেশপ্রেমের চাইতে ব্যক্তি স্বার্থটাকেই বড় করে তোলে, অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন মানে তাদের পকেটও ভারি হবে এমন চিন্তাকেই প্রশ্রয় দেয়, তাহলে বিরোধীরা তাদের মতলব হাসিলের মওকা পেয়ে যাবে বৈকি! আমাদের সরকার এবং প্রশাসনযন্ত্রের মধ্যেও নানান ভূত চেপে বসে থাকায় যে এমনটা হয়, তা বলাই বাহুল্য! রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প বিষয়ে পরিবেশবাদীরা যেসব কথা বলে বেড়াচ্ছেন, তা কতখানি সত্য? গোটা বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণই কেবল পারে এর প্রকৃত স্বরূপটি তুলে ধরতে। মোটা দাগে বিষয়টির বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায়, তা নিম্নরূপ : আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংগঠন বিভিন্ন সময়ে সরকার গৃহীত নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে প্রবল বাধা সৃষ্টি করছে। এই বাধা সৃষ্টির জন্য তাদের উপস্থাপিত নানা যুক্তি ও তথ্য কতখানি বাস্তবসম্মত তা যেমন বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে, তেমনি আবার এসব যুক্তি যদি সঠিক না হয়ে থাকে, তাহলে তা প্রত্যাখ্যানের দায় সরকারের ওপরই বর্তায় নিশ্চয়ই! পরিবেশবাদীরা বলছে যে, কয়লা তুললে পরিবেশের দারুণ ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, এই কথাটি কি সর্বাংশে সঠিক? বাংলাদেশের বিদ্যুত উন্নয়ন খাতে কয়লার ব্যবহার মাত্র ২.০৫ ভাগ। অন্যদিকে, বিশ্বে গড়ে ৪১ ভাগ বিদ্যুত উৎপাদিত হয় কয়লা থেকে। উল্লেখ্য, তেলের দাম স্থিতিশীল না থাকায় বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুত উৎপাদনের ৪৯.১ ভাগ আসে কয়লা থেকে। চীনে এর পরিমাণ ৭৮.৯ আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিদ্যুত উৎপাদনের ৯৩ ভাগই কয়লানির্ভর। অস্ট্রেলিয়ায় ৭৮ ভাগ বিদ্যুত উৎপাদিত হয় কয়লার মাধ্যমে। জাপানে ২৬.৮ ও ভারতে ৬৮ ভাগ বিদ্যুত আসে কয়লানির্ভর প্রকল্প থেকে। এখন কথাটি এই যে, এসব দেশের বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষেত্রগুলো কোন বিশ্ব হেরিটেজের এবং সে দেশের পরিবেশের জন্য কোন হুমকি সৃষ্টি করছে কিনা, সেটি দেখা দরকার। নিশ্চয়ই তারা এসব প্রকল্প চালু করার আগে এ ব্যাপারগুলোর ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিল এবং সেই মোতাবেক প্রকল্প প্রণয়ন করেছে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে পরিবেশবাদীরা কঠিনভাবে প্রশ্ন তুলেছেন রামপাল প্রকল্প নিয়ে। তারা বলেছেন যে, এটি সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে এবং সামগ্রিকভাবে তা বাংলাদেশের পরিবেশকেও বিপন্ন করে তুলবে। উপরন্তু, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবনে এই বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করে এ বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন ও বিধি লঙ্ঘন করা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন প্রথমে এই পরিবেশবাদীদের আপত্তি, বিরোধিতা বা আন্দোলনের সূচনা কিভাবে হয়েছিল, তা দেখা যাক। এতে দেখা যাবে যে, দু’জন জামায়াতপন্থী শিক্ষক এর সূচনা করেছিলেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই শিক্ষক পরিবেশবাদীদের হয়ে এর সূত্রপাত ঘটালে শুরুতে তা পরিবেশ বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও, অচিরেই এর বিস্তার ঘটিয়ে আন্দোলনের ইস্যুর মধ্যে তারা এই কেন্দ্রের কর অবকাশ ও কম সুদে ভারতীয় ঋণ পাওয়ায় ওই দেশের জনগণের ক্ষতির প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানি তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেও আন্দোলনকারীরা তা ‘মানি না মানব না’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। অভিযোগ আছে যে, তারা বাস্তবের সঙ্গে আদৌ মিল নেই এমন সব অসত্য তথ্য দিচ্ছে জনগণকে। আবার বলা দরকার, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের দু’জন শিক্ষক রামপাল ইস্যুতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে পরিবেশবাদীদের উস্কে দেয়। ২০১৩ সালের শুরুতে রামপাল কেন্দ্রের মাধ্যমে সুন্দরবন ধ্বংস করা হচ্ছে এই মর্মে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বীয় গবেষণালব্ধ বক্তব্য তুলে ধরেন ড. আব্দুল্লাহ হারুন (জামায়াতপন্থী বলে পরিচিত)। আর ঠিক এর পর পরই পরিবেশবাদীদের এই ইস্যুতে একটি জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে দেখা গেল। সুতরাং এক্ষেত্রে এই যোগসূত্রটি বিশ্লেষণকারীদের মাথায় রাখা দরকার। মজার ব্যাপার এই যে, ওই গবেষণাপত্রে সুন্দরবন সরকার ধ্বংস করে দিচ্ছে এই অপপ্রচার যেমন চালানো হয়, তেমনি আবার জনগণের একাংশের মধ্যকার ভারতবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগানোর প্রকাশ্য অপচেষ্টাও ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপির ঘরে ওই ফসল তুলে দিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই জামায়াতী শিক্ষক ওই গবেষণাপত্রটি তৈরি করেন। সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে ড. সাহেব সাংবাদিকদের বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি এবং অনেক প্রশ্ন আবার এড়িয়েও গিয়েছিলেন। যেমন, কোন প্রযুক্তিতে সরকার এই কেন্দ্রটি নির্মাণ করছেন সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। যাহোক, এর কিছুকাল আগে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী শিক্ষক আব্দুস সাত্তার আর তার সহকর্মী নিছক ইন্টারনেট ঘেঁটে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন, যাতে এই কেন্দ্রের প্রযুক্তিগত বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই অনুপস্থিত ছিল। এতে প্রতিদিন ১৩০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুতকেন্দ্রটির জন্য কি পরিমাণ কয়লা পোড়ানো হবে, এতে কি পরিমাণ ছাই ও কার্বন নিঃসরণ হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে কিভাবে তার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তার ধারে-কাছ দিয়েও যাননি ‘গবেষকরা’। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এসব তথ্য সম্পর্কে ওই শিক্ষকদ্বয়কে কখনই সংশ্লিষ্ট মহল থেকে কোন জিজ্ঞাসাবাদ বা সরকারী চাকরিতে নিয়োজিত থেকে কিভাবে ও কেন তারা সরকারী প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন, তা নিয়েও কোন প্রকার প্রশ্ন সরকারী মহল থেকে কখনই তোলা হয়নি। বরং বিদ্যুত বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর প্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। এর কত ভাগ সত্যিকার বাস্তবানুগ প্রচারণায় ব্যয়িত হয়েছে আর কত ভাগ তাদের উদর পূর্তি করেছে, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। পরিবেশবাদীদের সরেজমিনে দেখে আসতে যেসব দেশে এই জাতীয় বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে সেগুলো এবং সেগুলোতে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে অবহিত করতে বিভিন্ন দেশ ঘুরিয়ে আনার সরকারী প্রস্তাব পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা তাদের কোন মুরব্বিদের স্বার্থে প্রত্যাখ্যান করে আসছে, সেটাও তলিয়ে দেখা আবশ্যক বলে মনে করেন ওয়াকিফহাল মহল। তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, খালি চোখে বিষয়টি বোঝা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তাই তাদের উচিত কতিপয় বেসরকারী বিশেষজ্ঞকে নিয়ে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। কিন্তু তা তারা করতে সম্মত আছেন কি? পরিবেশবাদীরা বেশকিছু অসত্য তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে, এমন নজির তাদের বক্তব্য ও বাস্তব চিত্র পর্যালোচনা করলেই ধরা পড়বে বলে বিশেষজ্ঞ মহল অভিমত ব্যক্ত করছেন। তারা বলছেন যে, সুন্দরবন থেকে ৭ কিমি দূরে এই কেন্দ্রটি হচ্ছে, যা তাদের মতে প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন। বাস্তবে এটি নির্মিত হচ্ছে ১৪ কিমি দূরে। বাফার জোনের ১০ কিমির মধ্যে শিল্প স্থাপন না করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর এই কেন্দ্রটি ওই জোন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অন্যদিকে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে এটির দূরত্ব ৬৯.৯ কিমি। পরিবেশবাদীরা ও বিএনপি বলছে যে, এটি নাকি সুন্দরবনের মধ্যে স্থাপন করা হচ্ছে! বিএনপিপন্থী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ না হয়েও ওই পরিবেশবাদীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছেন আর বলছেন যে, এই কেন্দ্র নাকি ভারতের স্বার্থে করা হয়েছে! অথচ এই অভিযোগ বাস্তবতা স্বীকার করে না। তাই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, পরিবেশগত বিরোধিতা ছাপিয়ে সরকার ও ভারত বিরোধিতা রামপাল ইস্যুতে সক্রিয় রয়েছে। এখন পরিবেশবাদীদের বক্তব্য বা ভূমিকার উল্টো দিকটার দিকে একটু নজর দেয়া যাক। তারা বোঝাতে চাইছে যে, কয়লা তুললে পরিবেশ নষ্ট হবে। এর উল্টো দিকের কথাটি এই যে, তুলতে না দিলে কয়লা তো বিদেশ থেকে আমদানির প্রয়োজন পড়বে। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় ভাবা চলে যে, যেসব দেশ কয়লা রফতানি করে তারা লাভের একটি অংশ সিএসআরের আওতায় পরিবেশবাদীদের দেয় তাদের হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করার জন্য। কে না জানে যে, বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ বাজার দখল করে নানা এজেন্ট পোষার মাধ্যমে। উন্নয়নশীল দেশে নিজেদের বাজার ঠিক রাখার জন্য দেশ নয়, বাজার দখলের প্রয়োজন বর্তমান সাম্র্রাজ্যবাদীদের। সস্তায় বিদ্যুত পেতে হলে কয়লাভিত্তিক উৎপাদনেই যেতে হবে। তাই কয়লা রফতানিকারকরা স্থানীয় কয়লা উৎপাদনে বাধা সৃষ্টির জন্য নানা ফন্দি-ফিকির করে ও করছে। যে সব দেশ ফার্নেস তেল, জেনারেটরসহ অন্য বিদ্যুত উৎপাদনসামগ্রী রফতানি করে, কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র হলে তারা সে বাজার হারাবে। অভিযোগ আছে যে, এরাই আমাদের পরিবেশবাদীদের খেপাতে সক্ষম হয়েছে ও রামপালবিরোধী আন্দোলনে তৎপর রেখেছে। সত্য বটে, অপপ্রচারের মাধ্যমে তারা মানুষকে খানিক ভড়কে দিতেও পেরেছে। এখন দেখা দরকার যে, রামপালে আসলে হচ্ছেটা কি? এখানে পশুর নদী থেকে পাম্প দিয়ে পানি টানা হবে এবং কয়লা জ্বালিয়ে তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে সেই তাপে পানি বাষ্পীভূত করা হবে। বাষ্পীভূত পানি যে বিপুল চাপ তৈরি করবে, তা দিয়ে টারবাইন জেনারেটর ঘুরবে। আর এভাবেই উৎপন্ন হবে বিদ্যুত। অন্যদিকে ওই বাষ্পীভূত পানিকে ঘনীভবনের মাধ্যমে শীতল করে বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর করে নদীতে ফেরত পাঠানো হবে। এ জন্য থাকবে একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এই সরল বিষয়টিকে জটিল করে পরিবেশবাদীরা জনসাধারণকে এই বলে বিভ্রান্ত করছে যে, দেশ বিক্রির পাঁয়তারা চলছে রামপালে। বোঝা দরকার যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে কয়েকটি বিষয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলোÑ ১. সুবিধাজনক জমি, কয়লা পরিবহনের সুবিধা, পানির যোগান, বিদ্যুত সঞ্চালন সুবিধা, নির্মাণসামগ্রীর সহজপ্রাপ্যতা, নিকটবর্তী বিমানবন্দরে এয়ারফানেলে চিমনির অবস্থান না থাকা, প্রতœতাত্ত্বিক-ধর্মীয়-সামরিক-ঐতিহাসিক স্থান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে থাকা, পরিবেশ অধিদফতরের বিধিবিধান অনুসরণ, নিকটবর্তী কয়লার উৎসে কম মানুষকে উচ্ছেদ এবং স্থানীয় জনসাধারণের মতামত গ্রহণ। এসব লক্ষ্যকে মাথায় রেখে ২০০৯ সালে খুলনা অঞ্চলে এই বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য প্রাথমিকভাবে ৩টি স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল। সেগুলো হলোÑ খুলনার লবণছড়া, বাগেরহাটের রামপাল এবং চুনকড়ি ও দাকোপ। এগুলোর মধ্যে রামপালই উপরোক্ত সব ইন্ডিকেটর পাস করে। সেখানে এক স্থানে ১৮৩০ একর জমি পাওয়া গেছে। আর এ জন্য মাত্র ১২৫টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে (যাদের পুনর্বাসন করা হবে)। সেখানে বেশিরভাগই নিচু ও পতিত জমি, যা মাটি ভরাট করা হয়েছে। এখানকার জনবসতি প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ১২৫ জন। স্থানটি খুলনা বিভাগীয় শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে। নদীর নাব্য ৬.৫ থেকে ৭.৫ মিটার। কয়লা পরিবহন খরচও কম। আন্তর্জাতিকভাবে গভীর ভূমির ১০ কিমি-এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র না করার আইন আছে। আর অভয়ারণ্য থেকে এই বাধ্যবাধকতা ২৫ কিমি। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আর এই স্বীকৃতিকে ঘিরেই পরিবেশবাদীরা তাদের রামপালবিরোধী সেন্টিমেন্ট জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, এই প্রকল্প রামপালের প্রান্ত সীমা থেকে ১৪ কিমি (আইন হচ্ছে ১০ কিমি দূরে হতে হবে) আর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ থেকে ৬৫ কিমি দূরে (২৫ কিমি দূরে হওয়ার বিধান আছে) অবস্থিত। উপরন্তু, ওই এলাকার বায়ুপ্রবাহ সুন্দরবনের ঠিক বিপরীতে। ফলে পরিবেশ বিপন্নের সম্ভাবনাই নেই। বিদ্যুতকেন্দ্র, সোলার প্যানেল ইত্যাদি স্থাপনের জন্য ওই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি থেকে মোট ২ হাজার ৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে। যার মধ্যে ২০১৮ সালেই পাওয়া যাবে ১৩২০ মেগাওয়াট। পিডিবির সঙ্গে ভারতের ঘঞচঈ-এর সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুত কোম্পানি গঠিত হয়েছে। এতে ১৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হবে। উভয় দেশ দেবে ১৫% করে আর বাকি ৭০ ভাগ ঋণ দেবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল এই বিদ্যুতকেন্দ্রটির কয়লা পোড়ানোর ক্ষমতা সাধারণ কেন্দ্রের চাইতে ৩ গুণ বেশি। চিমনির উচ্চতা হবে ২৭৫ মিটার। আর এ থেকে যে কার্বন বের হবে তা বিদ্যুতকেন্দ্রের ১.৬ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিদ্যুত উৎপাদনের পর যে উড়ন্ত ছাই থাকবে তা নিয়েই প্রধানত আশঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা যায় বিরুদ্ধবাদীদের। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দাবি, আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে উদগীরিত ছাই ভস্ম বা ‘এ্যাশ হপার’ ৯৯.৯ ভাগই ধরা হবে এবং তা স্থানীয় সিমেন্ট, সিরামিক কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হবে। এই ছাইয়ের বিরাট বাজারও রয়েছে স্থানীয়ভাবে। ছাই ধরার পর তা সংরক্ষণের জন্য ২৫ একর জমির ওপর একটি সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হবে এবং ছাইকে কোনভাবেই বাতাস বা পানির সঙ্গে মিশতে দেয়া হবে না। ৯০ তলা উচ্চতার চিমনি থেকে বাতাসের স্তর বিবেচনা করে ওই স্তরে চিমনিটি দশমিক ১ ভাগেরও কম ছাই বাতাসে ছাড়বে। ফলে ওই ছাই সুন্দরবন অতিক্রম করে সাগরে গিয়ে পড়বে। বছরে ওই কেন্দ্রে ৪৭ লাখ টন কয়লা পোড়ানো হবে। ফলে বিরুদ্ধবাদীদের আশঙ্কা এই যে, এতে যে সাড়ে ৭ লাখ টন ফ্লাই এ্যাশ ও ৬২ লাখ টন বটম এ্যাশ তৈরি হবে, তাতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক ভারি ধাতব, যেমন : ক্যাডমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, পারদ, আর্সেনিক, ব্যারিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম, সীসা, নিকেল থাকবে। কিন্তু বর্তমানের প্রযুক্তি ওই আশঙ্কাকে যে একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে, এ কথাটি তাদের জেনে রাখা দরকার। লেখক : সাংবাদিক
×