ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুলিশের সাজানো মাদক মামলায় কারাগারে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পুলিশের সাজানো মাদক মামলায় কারাগারে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট ॥ লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার থানা পুলিশের সাজানো গাঁজা ব্যবসায়ী মামলায় সমাজকল্যান মন্ত্রনালয় স্বীকৃত ও সনদ প্রাপ্ত মিজানুর রহমান ওরফে মঞ্জু আলী (৩২) নামের এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে লালমনিরহাট কারাগারে আটক রয়েছে। এ বিষয়ে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানানোর পাশাপাশি স্থানীয় জন প্রতিনিধি, সাধারণ মানুষসহ সমাজ সেবা অফিসের কর্মকর্তারা পুলিশের এ ধরণের কাজকে ‘কান্ডজ্ঞানহীন’ হিসেবেই দেখছেন। বাংলাদেশ দন্ড বিধির ৮৪ ধারা অনুযায়ি মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি কর্তৃক অপরাধ শাস্তি যোগ্য নয়। ঘটনাটি প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনের পরিপন্থী বলেও জানিয়েছেন এক জন আইনজীবি। এদিকে, অভাবের কারণে সোমবার পর্যন্ত মঞ্জুর পরিবার জামিনের জন্য আদালতে আবেদনও করতে পারেনি। তবে তাঁর মা গত বুধবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লালমনিরহাট পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মঞ্জু আলী কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতা গ্রামের প্রয়াত আইয়ুব আলীর ছেলে। সে তার মা মাহিলা বেগম মিলির সাথে থাকতো। মাথায় একটি আঘাতজনিত কারণে প্রায় ১২ বছর বয়স থেকে সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। গ্রেপ্তারের পর দেওয়া সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যের প্রত্যায়নপত্রে তাকে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সমাজকল্যান মন্ত্রনালয় কর্তৃক প্রদানকৃত প্রতিবন্ধীর পরিচয়পত্র অনুযায়ী তিনি একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তাঁর আইডি নম্বর ১৯৮৪৫২১৩৯৩৫৬২৮৫৪৪-০৩। পুলিশ জানায়, কালীগঞ্জ থানায় দায়ের করা মামলার বাদী এএসআই বসন্ত রায় এজাহারে দাবি করেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে মাদক কেনাবেচার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের কামারপাড়া বাজারের শুভজিৎ এন্টারপ্রাইজের উত্তর গলিতে উপস্থিত হলে একটি ব্যাগসহ মঞ্জু আলী পালানোর চেষ্টা করলে ওই এএসআইয়ের সাথে থাকা আরো কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ তাঁকে আটক করা হয়। এসময় সেখান থেকে এক কেজি ‘গাঁজা’ উদ্ধার করা হয়। পরে ওই দিনই ‘১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯(১) টেবিল এর ৭(ক)’ ধারায় মঞ্জু আলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তাকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মঞ্জুর মা মাহিলা বেগম মিলি ও তার ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তা লালমনিরহাট পুলিশ সুপার বরাবর প্রতিকার চেয়ে লিখিত আবেদন করেছেন জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, শনিবার সকাল প্রায় নয়টার দিকে তাদের বাড়িতে এসে মাটি কাটার কাজ করার জন্য মঞ্জুকে ডাকাডাকি করে নিয়ে যায় প্রয়াত স্কুল শিক্ষক ওহিদুল ইসলাম ডালুর ছেলে রাখি। এর ঘন্টাখানেক পর আমরা শুনতে পাই মঞ্জুকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ‘ডিবি’ পুলিশ নিয়ে গেছে রাখির বাড়ি থেকে। এরপর ঘটনা জানতে কালীগঞ্জ থানায় ছেলের পরিচয় পত্রসহ গেলে তার সাথে দেখা করতে না দিয়ে পুলিশ দাবি করে তোমার ছেলে গাঁজার ব্যবসা করে তাই তাকে কোর্টে পাঠানো হবে’। মঞ্জুর মা মাহিলা বেগম আরো বলেন, ‘১২ বছর বয়সে মাথায় একটি আঘাতজনিত কারণেই সে মূলতঃ মানসিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরবর্তিতে ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও সুস্থ হয়ে ওঠেনি। তাকে কয়েক দফায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে বেশ কিছু দিন ধরে অভাবের কারণে আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় না। মাঝে মধ্যে খুব বেশি সমস্যা হলে ইনজেকশন দিয়ে টানা দুই-তিন দিন ধরে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়’। তার নাওয়া-খাওয়াসহ কোনো কিছুরই কোনো নিয়ম-ঠিক নাই। আমিই জোর করে বিভিন্ন জায়গা থেকে ওকে ধরে এনে যত্ন করি। অথচ সেই ছেলে জেলখানায় কিভাবে দিন কাটাচ্ছে জানিনা’। প্রত্যক্ষদশী সাইকেল মেকানিক্স ও শ্রীখাতা গ্রামের বাসিন্দা কান্তেস্বর বর্মণ জানান,‘মঞ্জু পাগলাকে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে আমার দোকানের পাশে দাড়ান দু’জন ব্যক্তি। হ্যান্ডকাপ দেখে মনে হয়েছে তারা পুলিশের লোক। পরে তারা আমার দিকে এগিয়ে এসে একজন বলল (বসন্ত এস আই) এই লোকটাকে (মঞ্জু পাগলা) চিনেন। আমি বললাম চিনিতো-ও একটা পাগলা। সারাদিন কোদাল ঘাড়ে নিয়ে এপাড়া-ওপাড়া বেড়ায়। আর একে ওকে বলে মোক (আমাকে) কামোত (কাজ) নিমেন। কিন্তু আমার কাছে এমন কথা শোনার পরেও ওরা মোটরসাইকেলে তুলে মঞ্জু পাগলাকে নিয়ে চলে যায়। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ওই দুজন আবার এসে আমার পাশের দোকানদার নূর মোহাম্মদ ওরফে মিস্টারের কাছে কাগজে সই চায়। ওনি সই দিতে না পারায় আমার কাছে এসে সই (স্বাক্ষর) চায়। আমি সই দিতে পারবো না জানালে আমাকে হুমকি দিয়ে এসআই বলেন- আমাকে চিনো? আমি দারোগা। তোমাকে আমি মামলার সহযোগি আসামি করবো বলে হুশিয়ারি দিয়ে চলে যায়। অপর প্রত্যক্ষদর্শী দক্ষিণ দলগ্রামের বাসিন্দা ও গালামাল দোকানদার নুর মোহাম্মদ ওরফে মিস্টার জানান, ‘মঞ্জু পাগলাকে পড়ানো হ্যান্ডকাপ ছিল এলাকার আশরাফুলের হাতে। আশরাফুল মোটরসাইকেল কেনা-বেচার কাজ করে। তবে স্থানীয় মানুষজন তাকে পুলিশের সোর্স বলেই চিনে। সেই আশরাফুলের সাথে থাকা ব্যক্তি (দারোগা) আমাকে বলে, এই লোকোক (লোক) চিনেন। আমি বললাম- হ্যাঁ চিনিতো, ওই একটা মেন্টাল (পাগল), রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।’ পরে তারা মঞ্জু পাগলাকে মোটরসাইলে করে নিয়ে যায়। কোথায় যেন রেখে একঘন্টা পর এসে আমার কাছে সই (স্বাক্ষর) চায়। আমি সই জানিনা, টিপসই লাগলে নেন। টিপসই নাকি চলে না বলেই তিনি(বসন্ত রায়) আমার পাশের দোকানদার কান্তেস্বরের কাছে সই চান। কান্তেস্বর সই জানলেও তিনি সই দেননি। স্থানীয়রা আরও বলেন মঞ্জুর পাগলামির কারণে মাঝে মধ্যে ওকে শিকল পড়িয়ে রাখা হয় বাড়িতে। মামলার কথিত স্বাক্ষী,পুলিশের সোর্স আশরাফুল বলেন, ‘ঘটনার দিন আমি কামারপাড়া গেলে এসআই বসন্ত দাদার সাথে দেখা হয়। তখন ওনি আমাকে রাঁখি নামের ব্যক্তির বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি দুই জন দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে একজনের হাতে একটি বাগ ছিল। বসন্ত দাদা বলল, ওটা কি? এই কথা বলার সাথে সাথে একজন ব্যাগটি ফেলে দৌঁড় দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন বাগসহ মঞ্জুকে আটক করা হয়।’ পুলিশের সাথে ভালো সর্ম্পক আছে স্বীকার করে আশরাফুল বলেন, ‘আমাকে স্বাক্ষী রাখছে কিনা, আমি জানিনা। তবে আমাকে একজন ফোন করে বলল, তুমি নাকি স্বাক্ষী হয়েছো?’ এসময়, প্রতিবেশী ও এলাকার অতি পরিচিত মঞ্জু পাগলাকে চিনে বলেই দাবি করেন মামলার কথিত স্বাক্ষী ও পুলিশের সোর্স আশরাফুল। দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নং ওর্য়াড সদস্য মোফাজ্জল হোসেন জানান, ‘মঞ্জুর বাড়ি আমার বাড়ির সাথে। সে ছোট বেলা থেকে পাগল। সবাই তাকে মঞ্জু পাগলা বলে চিনে। সে হিন্দু মুসলমান সবার কাছে যায়। তার কাছে কোন জাত-ভেদ নাই। কখনো মসজিদের বারান্দায়, আবার কখনো শ্বশানে, কালীমন্দিরে রাত কাঁটায়। তার প্রতিবন্ধী কার্ডও আছে। এমন একজন পাগলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে শুনে আমি এক দারোগাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম যে সে একটা প্রতিবন্ধী পাগল মানুষ। তবুও পুলিশ তাকে নাকি মাদক মামলায় জড়িয়েছে। দলগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল আলম খন্দকার জানান, মঞ্জু মানসিক প্রতিবন্ধি, এটা সবাই জানে। সে পথে-ঘাটে মসজিদ মন্দিরে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে যা পায় তাই খায়। তাকে এভাবে ধরে নিয়ে গিয়ে মাদকের সাথে যুক্ত করা করাই ঠিক হবে না। তাই তার মতো একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে যেন অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়া না হয় বলে দাবি তোলেন ইউপি চেয়ারম্যান। সরেজমিন ওই এলাকায় মানুষের সাথে কথা বলে কথিত গাঁজা বিক্রির দায়ে গ্রেপ্তারকৃত মঞ্জু যে মানসিক রোগী বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানায়, সে একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। আদর্শপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ৭ বছর ধরে এই মসজিদে আছি। প্রায় দিন ফজরের আযান দেয়ার সময় এসে দেখতাম মসজিদের বারান্দায় সে (মঞ্জু) শুয়ে আছে। সে একটা পাগল। তবে সে কারো সাথে খারাপ আচরণ করতে দেখিনি।’ দলগ্রাম ইউনিয়নের কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুল জব্বার বলেন, মঞ্জু একজন প্রতিবন্ধী। তাকে কেন যে পুলিশ গ্রেফতার করলেন তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন মঞ্জুকে আটকের সংবাদ পেয়ে এএসআই বসন্তকে ফোন করলে তিনি মঞ্জুকে আটকের কথা অস্বীকার করেন। মামলার বাদী এএসআই বসন্ত রায়কে এ বিষয়ে বলেন, ‘মঞ্জুকে মাদকের ব্যাগসহ আটক করা হয়েছে। তাই তার নামে মামলা দায়ের হয়েছে।’ কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মকবুল হোসেন বলেন, ‘মঞ্জু প্রতিবন্ধী কিনা আমি জানি না।’ এ ব্যাপারে লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার এস এম রশীদুল হক বলেন, ‘বিষয়টি জেনেছি, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
×