ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

৫০ আসনে জয় সামনে রেখে সংস্কারপন্থীদের ফিরিয়ে নিচ্ছে বিএনপি

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

৫০ আসনে জয় সামনে রেখে সংস্কারপন্থীদের ফিরিয়ে নিচ্ছে বিএনপি

শরীফুল ইসলাম ॥ অবশেষে দুঃখিত বলে দলে ফিরছেন সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতারা। ঘরে ফিরিয়ে এনে এসব নেতাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাল ফলের আশায় বিএনপির নানামুখী কৌশলের মধ্যে সংস্কারপন্থী নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনা একটি অন্যতম পদক্ষেপ। বিএনপি চেয়ারপার্সনের নির্দেশে দলের মহাসচিবসহ ক’জন সিনিয়র নেতা ইতোমধ্যেই অর্ধশতাধিক সংস্কারপন্থী নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে অতীতের কর্মকা-ের জন্য ভুল স্বীকার করে ঘরে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপির সংস্কারপন্থী যেসব নেতা এখনও দলের বাইরে রয়েছেন তারাই ছিল এক সময় দলের মূল শক্তি। দলীয় যে কোন কর্মকা-ে তাদের সরব উপস্থিতি বিএনপির এগিয়ে চলার পথে সাহস জোগাত। কিন্তু দলের দুর্দিনে তারা এখন নেই। দীর্ঘদিন পর হলেও বিএনপি হাইকমান্ড তাদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তবে সংস্কারপন্থীদের প্রতি দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের ক্ষোভ থাকায় একটি কৌশল প্রয়োগ করে তাদের দলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আর এ কৌশলের অংশ হিসেবেই সংস্কারপন্থীদের দলে ফিরে পদ-পদবি পেতে হলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে অতীত কর্মকা-ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। সূত্র মতে, গত কয়েক মাস ধরেই সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যেই সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতারা নিজেদের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। প্রথমে সরি বলার বিষয়ে তাদের আপত্তি থাকলেও পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির পদ পাওয়া ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে তারা এ বিষয়ে নমনীয় হন। সম্প্রতি সংস্কারপন্থী নেতা জহির উদ্দিন স্বপন (দলের সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক) ও সাবেক সাংসদ সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল গভীর রাতে গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এ সময় খালেদা জিয়া তাদের দলের জন্য কাজ করে যেতে বললে তারাও খালেদা জিয়াকে আশ্বস্ত করেন। শীঘ্রই কয়েক ধাপে আরও বেশ ক’জন সংস্কারপন্থী নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করবেন বলে জানা গেছে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার আগে থেকেই দলের কিছু নেতা সংস্কারের পক্ষে সংগঠিত হতে থাকে। বিশেষ করে দলের হাইকমান্ডের একগুঁয়েমির কারণে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে হলো না এবং এ নিয়ে সঙ্কট দেখা দেয়ায় দেশে ওয়ান-ইলেভেন আসে। আর ওয়ান-ইলেভেনের পর বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুইয়া এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানসহ দলের শতাধিক নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে সংস্কারপন্থী বিএনপি গঠন করে। এর পর চলতে থাকে সংস্কারপন্থী বিএনপি ও খালেদাপন্থী বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচী। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ বিএনপির বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা কারাবন্দী থাকায় এক পর্যায়ে বিএনপির রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে সংস্কারপন্থীরা। ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া জেল থেকে মুক্ত হলে এবং তারেক রহমান চিকিৎসার জন্য লন্ডন চলে গেলে সংস্কারপন্থী নেতাদের তৎপরতা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ২৯ নবেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কারপন্থী বিএনপির বেশ ক’জন নেতা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে ঘরে ফিরে আসে। আর সংস্কারপন্থী বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতা রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আর আব্দুল মান্নান ভুইয়া ও সাইফুর রহমানসহ ক’জন সিনিয়র নেতা পরে মারা যান। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের ক’জন সিনিয়র নেতার বিভিন্ন মামলায় সাজা হওয়ার বিষয়টি সামনে এলে দলীয় হাইকমান্ড নতুন উদ্যমে সংস্কারপন্থী নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনার কৌশল নেন। এরই অংশ হিসেবে প্রায় দশ বছর পর বিএনপির আলোচিত প্রায় অর্ধশতাধিক সংস্কারপন্থী নেতাকে এবার ঘরে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছে। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা মনে করছেন এরফলে দল নতুন উদ্যমে সারাদেশে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত ৫০টি আসনে অপেক্ষাকৃত ভাল প্রার্থী পাবে। এ কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভাল ফল করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। জানা যায়, সংস্কার পন্থী নেতারাও মনে করছেন প্রায় ১০ বছর রাজনীতির বাইরে থাকায় তারা এখন অনেক পিছিয়ে পড়েছেন। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান করে নিতে না পারলে তাদের আস্তে আস্তে রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে হবে। তাই মানঅভিমান ভুলে সরি বলে হলেও দলে ফিরে গিয়ে পদপদবি পাওয়া গেলে এবং পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে। এ কথা চিন্তা করেই তারা সরি বলে ঘরে ফিরে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। বিএনপি সূত্রে জানা যায়, যেসব সংস্কারপন্থী নেতা অন্য রাজনৈতিক দলে যাননি এবং নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রিয় তাদের ঘরে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তবে যেসব নেতা নিজ এলাকায় জনপ্রিয় নয় তারাও ফিরে আসতে চাইলে স্বাগত জানানো হবে। তবে যাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল এমন সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতারা ফিরে আসতে চাইলে খালেদা জিয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়াও আরও ক’টি শর্ত মানতে হবে। বহিষ্কৃত সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতাদের মধ্যে রয়েছেন দলের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আশরাফ হোসেন ও সাবেক দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি। সূত্রমতে, সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতাদের মধ্যে আরও যারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে দলে ফেরার অপেক্ষায় তাদের মধ্যে রয়েছেন ময়মনসিংহ এলাকা থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য দেলোয়ার হোসেন খান দুলু, নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান আঙ্গুর, বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) জেড এ খান, মোফাজ্জল করিম, চাঁদপুরের সাবেক সংসদ সদস্য এস এ সুলতান টিটু, কক্সবাজার এলাকার সাবেক সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার শহিদুজ্জামান, বরগুনার সাবেক সাংসদ নুরুল ইসলাম মনি, বরিশালের ইলেন ভুট্টো, রাজশাহীর আবু হেনা, মেহেরপুরের আবদুল গণি, মৌলভীবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য এম এম শাহীন, নোয়াখালীর ফজলে আজিম, বগুড়ার সাবেক সংসদ সদস্য ডাঃ জিয়াউল হক মোল্লা, জি এম সিরাজ, সাবেক সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ শাম্মী শের, শাহরিয়া আক্তার বুলু, জয়পুরহাটের আবু ইউসুফ খলিলুর রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) আনোয়ারুল কবীর তালুকদার, নেত্রকোনার আবদুল করিম আব্বাসী, গাইবান্ধার শামীম কায়সার লিঙ্কন, সুনামগঞ্জের নজির হোসেন, সাবেক এমপি খলিলুর রহমান, মনি স্বপন দেওয়ান, ডাঃ সালেক চৌধুরী, দিলদার হোসেন সেলিম, আবদুল মতিন, আবু রেজা ফজলুল হক, সাবেক অর্থপ্রতিমন্ত্রী শাহ মোঃ আবুল হোসাইন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীর প্রমুখ। প্রসঙ্গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বচনের আগে বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে সংস্কারপন্থী বেশ ক’জন নেতাকে নিয়ে রাজধানীতে একটি বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকে সংস্কারপন্থী নেতারা যাতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেন সে ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা চান এবং সংস্কারপন্থী নেতাদের আশ্বস্ত করা হয় সময় ও সুযোগ মতো তাদের মূল দলে আবার ফিরিয়ে নেয়া হবে। সেদিন দলের মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথা রেখেছিলেন সংস্কারপন্থী বিএনপি নেতারা। তাই এখন নতুন উদ্যমে সংস্কারপন্থী নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনতে বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ জন্য একটি তালিকা করে সেখান থেকে ধাপে ধাপে সংস্কারপন্থী নেতাদের ডাকা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে যারা খালেদা জিয়ার সামনে গিয়ে সরি বলতে চাইবেন না তাদের আপাতত ডাকা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে সংস্কারপন্থী এক বিএনপি নেতা জনকণ্ঠকে বলেন, দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দলের পদ ফিরিয়ে দেয়া ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ারও আশ্বাস দেয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। ধাপে ধাপে অন্যরাও দেখা করবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, একটা বিশেষ প্রেক্ষাপটে দলের কিছু নেতা একটা অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সবাই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির রাজনীতি করছেন। তবে দলের কিছু নেতা এখনও বিভিন্ন কারণে দলীয় কর্মকা- থেকে দূরে অবস্থান করছেন। তবে শীঘ্রই তারা সবাই দলীয় কর্মকা-ে সক্রিয় হবেন। ইতিমধ্যেই কেউ কেউ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে দলে সক্রিয় হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আর দলে ফিরে এসে সক্রিয় হলে অবশ্যই তাদের মূল্যায়ন করবেন বিএনপি হাইকমান্ড।
×