ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

১ মার্চ থেকে সব আন্তঃনগর, মেল ও এক্সপ্রেস ট্রেন চলবে নতুন সিডিউলে

নয়া দিগন্তের সূচনা ॥ গন্তব্যে পৌঁছার সময় কমছে

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নয়া দিগন্তের সূচনা ॥ গন্তব্যে পৌঁছার সময়  কমছে

মশিউর রহমান খান ॥ আগামী ১ মার্চ থেকে দেশব্যাপী নতুন সময়সূচী অনুযায়ী বা ওয়ার্কিং টাইমটেবিলে (ডব্লিউটিটি) দেশের সকল আন্তঃনগর ও মেল ট্রেন পরিচালনা করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রায় দুই শতাধিক ট্রেন নতুন এ সময়সূচী অনুযায়ী পরিচালনা করা হবে। এতে বর্তমানের চেয়ে কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। ফলে ট্রেনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে বাড়ানো হবে ট্রেনের গতি। এর ফলে বর্তমান সময় অনুযায়ী ট্রেন চলাচলের সময়ের চেয়ে প্রতিটি আন্তঃনগর ও মেল ট্রেন সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা ৫০ মিনিট থেকে সর্বনিম্ন ৩০ মিনিট পর্যন্ত কম সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছবে বলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। নিয়মানুযায়ী প্রতিবছর এ সময়সূচী পরিবর্তন করার কথা থাকলেও প্রায় দুই বছর ধরে পুরনো ৫০ নম্বর টাইমটেবিল দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করে আসছিল রেলওয়ে। ৫১তম এ টাইমটেবিল কার্যকর হলে বেশি দূরত্বের প্রায় সকল রুটের ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছার সময় অনেক কমে আসবে। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত এ পরিবহনে যাত্রীসেবার মান যেমন বাড়বে। এল ফলে সড়কপথের চেয়ে রেলপথে যাত্রার দিকে সবার মনোযোগ আকৃষ্ট হবে। এর ফলে যাত্রী বাড়ায় লোকসানে থাকা এ খাতটির রাজস্ব আয়েও বড় ধরনের অগ্রগতি আসবে বলে মনে করছে রেল কর্তৃপক্ষ। নতুন নিয়মে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৫ ঘণ্টা ১০ মিনিট। রেলের পূর্বাঞ্চলে মেল, এক্সপ্রেস ও ৭০ কমিউটার ট্রেনের মধ্যে চুয়াল্লিশটির গন্তব্যে পৌঁছার সময় কমলেও পনেরোটির সময় বাড়ছে। অপরিবর্তিত রয়েছে ১১ ট্রেনের সময়সূচী। অপরদিকে আন্তঃনগর ছাড়াও পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব মেল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছার সময় কমানো হয়েছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে রেলওয়েতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে। রেলের সার্বিক উন্নয়নে প্রায় অর্ধশত বৃহৎ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। নতুন লাইন নির্মাণের পাশাপাশি পুরনো লাইন সংস্কার করা ও নতুন কোচ ও ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে রেল বহরে। যার প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে রেল খাতে। তবে বৃহদাকারের এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যার কারণে প্রতিবছর ট্রেন পরিচালনার সময় হালনাগাদ করা হলেও প্রায় ২ বছর ধরে ট্রেন পরিচালনার সময়সূচী হালনাগাদ করা হয়নি। ফলে নতুন লাইন নির্মাণ ও সংস্কারের পরও যাত্রাপথে ট্রেনের গতি বাড়াতে সক্ষম হয়নি রেল কর্তৃপক্ষ। তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হলেও নতুন টাইমটেবিল চালুর মাধ্যমে এ পরিবর্তনে রেল তার চলার পথে নতুন গতি পাবে। যাত্রীরা পাবেন তাদের কাক্সিক্ষত সেবা। রেলের ইতিহাসে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে প্রায় দশ বছর আগেও মাত্র ৫ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছতে পারত। বর্তমানে এ রুটটিতে পুরনো ট্র্যাক, তুলনামূলক অবকাঠামোগত অগ্রগতির অভাবে বর্তমানে এ পথে ট্রেনটি যেতে ৭ ঘণ্টা সময়ও লেগে যায়। কখনও কখনও তা ৮ ঘণ্টাতেও গড়ায়। তবে গত বছর এ রুটটিতে বড় দুটি ডাবল লাইন প্রকল্প উদ্বোধন হওয়ার পর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ট্রেনের সময় ৫ ঘণ্টায় নামিয়ে আনার দাবি ওঠে। এছাড়া এ রুটটিতে প্রায় ২৫ কিলোমিটার রাস্তায় ব্যাপক সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যার কারণে টাইমটেবিল বাস্তবায়ন না হওয়ায় তা বাস্তবায়নে বিলম্বিত হয়। নতুন টাইমটেবিলে বিরতিহীন সোনার বাংলা এক্সপ্রেসও যথাক্রমে ৫ ঘণ্টা ১০ ও ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিটে উভয় পথে যাত্রী পরিবহন করবে। সর্বনিম্ন ৫ ঘণ্টা ১০ মিনিটে সুবর্ণ এক্সপ্রেস (বিরতিহীন) ট্রেন ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রী পরিবহন করবে। রেলসূত্র জানায়, গত বছরের শেষের দিকে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের টাইমটেবিল সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে দুই অঞ্চলের পরিবহন বিভাগ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। মেল ও এক্সপ্রেসের নির্দিষ্ট কিছু ট্রেনের সময়সূচী অপরিবর্তিত থাকলেও প্রায় সব ধরনের ট্রেনের সময় কমবে। সূত্র জানায়, নতুন নিয়মে পশ্চিমাঞ্চলে রাজশাহী-খুলনা রুটের কপোতাক্ষ এক্সপ্রেসের গন্তব্যে পৌঁছার সময় ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট কমানো হয়েছে। যা সবচেয়ে বেশি সময় সাশ্রয় হবে। অপরদিকে পূর্বাঞ্চলে আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সুবর্ণ এক্সপ্রেস ও মহানগর প্রভাতী ট্রেনের সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় কমছে। একই অঞ্চলে সিলেট-চট্টগ্রাম রুটের ট্রেন জালালাবাদ এক্সপ্রেসের গন্তব্যে পৌঁছার সময় কমছে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট। অনুমোদিত নতুন ডব্লিউটিটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চলে ৪৫ আন্তঃনগর ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছার সময় সর্বনিম্ন ৫ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট পর্যন্ত কমছে। ৭০৩ নম্বর মহানগর গোধূলির ১ ঘণ্টা ৫ মিনিট, ৭০৪ নম্বর মহানগর প্রভাতী ও ৭৪১ নম্বর তূর্ণার ১ ঘণ্টা ৫ মিনিট এবং ৭৮৫ নম্বর বিজয় এক্সপ্রেসের ১ ঘণ্টা সময় কমছে। এছাড়া ১ ঘণ্টার বেশি সময় কমছে ছয়টি আন্তঃনগর ট্রেনের। এর মধ্যে ৭০১ নম্বর সুবর্ণ এক্সপ্রেসের ১ ঘণ্টা, ৭০২ নম্বর সুবর্ণ এক্সপ্রেসের ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় কমানো হয়েছে। এছাড়া মেল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ৭০টি ট্রেনের মধ্যে ৪৪টির গন্তব্যে পৌঁছার সময় কমলেও ১৫টির সময় বাড়ছে। অপরিবর্তিত রয়েছে ১১টি ট্রেনের সময়সূচী। মেল ট্রেনের মধ্যে নোয়াখালী এক্সপ্রেসের (ঢাকা-নোয়াখালী) ১ ঘণ্টা ও ১৪ নম্বর জালালাবাদের (সিলেট-চট্টগ্রাম) ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট করে সময় কমানো হয়েছে। ময়মনসিংহ এক্সপ্রেসের (বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে চট্টগ্রাম) সময় কমছে ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট সময় কমানো হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলের ৩৫ আন্তঃনগর ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছার সময় কমছে নতুন টাইমটেবিলে। এর মধ্যে রাজশাহী-খুলনা রুটের কপোতাক্ষ এক্সপ্রেসের সময় কমছে ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। আর গন্তব্যের দূরত্ব কমানোর কারণে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেসের (ঢাকা-সিরাজগঞ্জ বাজার) সময় যথাক্রমে ২ ঘণ্টা ৩৫ ও ৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময় কমানো হয়েছে। এ হিসেবে আগের টাইমটেবিলে ট্রেন দুটি ঈশ্বরদী থেকে ছেড়ে সিরাজগঞ্জ বাজার হয়ে তারপর ঢাকায় পৌঁছত। এতে এ ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছতে ৭ ঘণ্টা সময় লাগত। নতুন টাইমটেবিলে ট্রেনটি গন্তব্যে পৌঁছবে যথাক্রমে ৪ ঘণ্টা ও ৪ ঘণ্টা ২৫ মিনিটে। ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট করে দিনাজপুর-ঢাকা রুটের দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও ঢাকা-খুলনা রুটের চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনের সময় কমছে। একই রুটের ৭২৫ নম্বর সুন্দরবন এক্সপ্রেসের ১ ঘণ্টা, ঢাকা-দিনাজপুরের ৭০৫ নম্বর একতা এক্সপ্রেসের ৫০ মিনিট, খুলনা-রাজশাহী রুটের ৭১৫ নম্বর কপোতাক্ষের ৫০ মিনিট, খুলনা-ঢাকা রুটের ৭৬৩ নম্বর চিত্রা এক্সপ্রেসের ৫০ মিনিট, ঢাকা-চিলাহাটী রুটের ৭৬৫ নম্বর নীলসাগর এক্সপ্রেসের ৫৫ মিনিট সময় কমছে। এর বাইরে ছয়টি ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছার সময় সর্বনিম্ন ১০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা কমছে। ট্রেনগুলো হচ্ছে ৭১৪ নম্বর করতোয়া, ৭২৭ নম্বর রূপসা, ৭৩১ নম্বর বরেন্দ্র, ৭৬৫ ও ৭৬৬ নম্বর নীলসাগর, ৭৬৮ নম্বর দোলনচাঁপা। গন্তব্যের সময় অপরিবর্তিত রয়েছে ৭৩২ নম্বর বরেন্দ্র, ৭৫১ নম্বর লালমনি এক্সপ্রেস, ৭৭১ নম্বর রংপুর, ৩১০৮ নম্বর মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের। ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন (৩১০৭) আগে সকাল আটটা ১০ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে কলকাতার উদ্দেশে ছেড়ে গেলেও নতুন নিয়মে আগামী ১ মার্চ থেকে সকাল আটটা ১৫ মিনিটে ছাড়বে। আন্তঃনগর ছাড়াও পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব মেল, এক্সপ্রেস ও কমিউটার ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছার সময় কমানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বায়লাদেশ রেলওয়ে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আরামদায়ক চলাচল ও অর্থ সাশ্রয়ের মাধ্যমে প্রতিটি যাত্রীকে কম সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে নাগরিকদের অধিক পরিমাণ সেবা প্রদানই আমাদের মূল লক্ষ্য। বর্তমান সরকারের আমলে রেলের উন্নয়নে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- সম্পাদিত হয়েছে। এছাড়া প্রায় অর্ধশত বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে ও সারাদেশের রেললাইনে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়েছে। ফলে ট্রেন পরিচালনার গতিও বাড়ানো হবে। নাগরিকদের সেবার পরিমাণ বর্তমানের চেয়ে বাড়াতে ও নাগরিকদের অন্য সকল রুটের চেয়ে রেলওয়েতে ভ্রমণে আগ্রহী করে তুলতে আমরা নতুন সময়সূচী পরিবর্তন করছি। যা আগামী ১ মার্চ থেকে সারাদেশের প্রায় সকল আন্তঃনগর ও মেল ট্রেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এর আগে কখনও গন্তব্যে পৌঁছনোর সময় এত কমানো হয়নি। নতুন নিয়মে প্রায় ৬৮ আন্তঃনগর ও ১২০ মেল ট্রেন পরিচালনা করা হবে। এর বাইরে নির্দিষ্ট কিছু রুটের লোকাল ট্রেনেও এ সময়সূচী প্রযোজ্য হবে। কিছু ট্রেনে আগের সময়সূচীই থাকবে। মহাপরিচালক বলেন, নতুন সময়সূচী অনুযায়ী পূর্বের সময়ের চেয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে প্রতিটি ট্রেন সর্বনিম্ন ৩০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিট আগেই যাত্রীরা পৌঁছাতে পারবেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে সময় লাগবে ৫ ঘণ্টা ১০ মিনিট। এতে ৩০ মিনিট সময় কমবে। এছাড়া ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত যেতে সময় কমবে এক ঘণ্টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত এ পরিবহনে যাত্রীসেবার মান বাড়বে। এছাড়া গন্তব্যে পৌঁছতে সময় অনেক কমে আসায় যাত্রীরা ট্রেনে যাতায়াতে বেশি আগ্রহী হবে ও এর ফলে সড়কপথের চেয়ে রেলপথে যাত্রার দিকে সবার মনোযোগ আকৃষ্ট হবে। আশা করি যাত্রী বাড়ায় লোকসানে থাকা এ খাতটির রাজস্ব আয়েও বড় ধরনের অগ্রগতি আসবে। যার মাধ্যমে যাত্রীসেবার মান আরও বাড়ানো সম্ভব হবে।
×