ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এতদিন জুতার ভেতরে সোনা এসেছে, এখন যাচ্ছে ইয়াবা

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

এতদিন জুতার ভেতরে সোনা এসেছে, এখন যাচ্ছে ইয়াবা

আজাদ সুলায়মান ॥ মিয়ানমার থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সড়ক পথে আসে ঢাকায়। ৭ দিন বিরতি দিয়ে আকাশ পথে আবার উড়ে যায় সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে। এভাবেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এতবার পাচার হলেও কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। ধরা পড়ার পর জানা গেল ছয়মাস ধরেই বেশ নীরবে নিভৃতেই চলছে ইয়াবার একচ্ছত্র রমরমা বাণিজ্য। দেশের বাঘা বাঘা সব গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে এই ব্যবসা চলছে সেটা ভাবিয়ে তুলেছে বিমানবন্দর কর্র্তৃপক্ষকে। ইয়াবা পাচারের নতুন রুট হযরত শাহজালাল আন্তর্র্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইকবাল করিম উদ্বেগের সঙ্গেই বলেছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার ফলেই ইয়াবা পাচারের বিষয়টি ফাঁস হলেও এটা তো কল্পনারও বাইরে। কুয়েতগামী দুই যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এই চালান। জুতার ভেতর লুকিয়ে ইয়াবা নিয়ে বিদেশ যাচ্ছিল তারা। এতদিন জুতোর ভেতর সোনা এসেছে। এখন দেখছি জুতার ভেতরে ইয়াবাও যাচ্ছে। সোনা আসে-ইয়াবা যায়। পুলিশ জানিয়েছে, এটাই বিমানবন্দরে ইয়াবা ধরা পড়ার প্রথম ঘটনা। এর আগে কখনও ধরাও পড়েনি। নিরাপত্তাকর্মীদের চিন্তায়ও আসেনি। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক শ্রেণীর বহির্গামী যাত্রীদের লাগেজ-ব্যাগেজে শুধু বিস্ফোরক ও ধারালো জাতীয় অস্ত্রাদিই ভালভাবে চেক করা হতো। ইয়াবার মতো মাদকদ্রব্য বিমানবন্দর দিয়ে পাচার করা হতে পারে বা করা হচ্ছে সেটা ছিল কল্পনাতীত। এ সম্পর্কে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান বলেন, চোরাচালানের সর্বশেষ পণ্য হিসেবে যোগ হয়েছে ইয়াবা। যা গোটা দেশের ভয়ঙ্কর মাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এখন যদি সেই ইয়াবা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও অবস্থান পাকাপোক্ত করার সুযোগ পায়- তাহলে সেটা হবে আরও উদ্বেগের। বিমানবন্দরের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এর আগে ওমরাহ ও হজের নামে সৌদি মানবপাচারের ঘটনা ব্যাপক হারে ফাঁস হওয়ায় অনেক বড় খেসারত দিতে হয়েছে। দীর্ঘদিন ওমরাহ বন্ধ থাকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দেনদরবার করে সেই ওমরাহ চালু করা হলেও এখনও কঠোর নজরদারিতে রাখা হয় হজ যাত্রীদের। এ অবস্থায় যদি ইয়াবার মতো মাদক মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও ধরা পড়ে তার জন্য বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ জানায়, যে কায়দায় ধরা পড়ে এই ইয়াবার চালান, সেটা ছিল অবিশ্বাস্য। পেটের দায়ে কুয়েতগামী এমন হাবাগোবা যাত্রীর কাছে ইয়াবা থাকতে পারে সেটা কোন নিরাপত্তাকর্মীরও সন্দেহ জাগার মতো নয়। সেদিন ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি। সকাল সাড়ে দশটায় কুয়েত ফ্লাইটের (কেইউ-২৮৬) যাত্রীরা চেকইন ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে হোল্ডিং লাউঞ্জে অপেক্ষায়। অন্য আর দশজন যাত্রীর সঙ্গে নাইম হোসেন ও রায়হান শেখ। তাদের হাতে দুইটি ব্যাগ। কুয়েত এয়ারলাইন্সের নিরাপত্তাকর্মীরা সন্দেহভাজন যাত্রীদের হ্যান্ড ব্যাগেজ ও ট্রলি ব্যাগ তল্লাশি শুরু করে। এ দুজন যাত্রীর ব্যাগও তারা হাতে নিয়ে তল্লাশি চালায়। এ সময় হাতে পড়ে একজোড়া জুতা। জুতা দেখে সন্দেহ হয়নি। কিন্তু হাতে নাড়া চাড়া করার সময় জুতা দুইটিকে ভারি মনে হয়। তখন জুতার ব্যাগ থেকে নামানোর সময়ও বেশ ভারি মনে হওয়ায় সন্দেহ গাঢ় হয়। তিনি জানতে চান এত ভারি কেন। নাইম হাসান ও রায়হান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। তারা মাথা নিচু করে চুপ। নিরাপত্তাকর্মী এবার জুতার সোলের সঙ্গে লাগানো ওপরের রাবারের স্তর টেনে খুলে ফেলেন। তখনই তার চোখ ছানাবড়া। একি লাল ট্যাবলেট। এতদিন পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনের পর্দায় ইয়াবার চিত্র দেখলেও আজ নিজের হাতে নিয়েই ইয়াবা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই নিরাপত্তাকর্মী। তিনি নেড়ে চেড়ে দেখেন জুতার ভেতরেই বিশেষ কায়দায় লুকানো হাজার খানেক ইয়াবা। প্রতিটি পাঁচশত টাকার দরে যার মূল্য প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। ওই ব্যাগ থেকে কয়েক কেজি গাজাও উদ্ধার করা হয়। তাৎক্ষণিক তলব করা হয় বিমানবন্দরের মাদক বিভাগের পরিদর্শক রুমা ও বেলায়েতকে। কিন্তু তারা কেউই সেদিন বিমানবন্দরের কর্মস্থলে না থাকায় ডাকা হয় আর্মড পুলিশকে। এ সময় দুজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিমানবন্দর থানায় সোপর্দ করা হয়। আর্মড পুলিশ অধিনায়ক রাশেদুল ইসলাম খান জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রেফতারকৃত নাইম হাসান ও রায়হান শেখের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দোলতলা বাজারে। তারা নিজেদের পরিস্থিতির শিকার বলে দাবি করেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও নিরীহ মনে হয়েছে উল্লেখ করে রাশেদুল ইসলাম খান বলেন, এ দুজনের ভাষ্যমতে হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি তাদের বিমানবন্দরে এসে এই জুতাজুড়ো দিয়ে অনুরোধ করেছেন যাতে কুয়েতে এক আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। নাইম ও রায়হান এক জোড়া জুতা হাতে নিয়ে কুয়েত পৌঁছে দেয়াটা খুব কঠিন বিষয় নয় বলে মন্তব্যও করেন। তারা একবারও ভেবে বা সন্দেহের চোখে দেখেননি এ জুতা। তারা ব্যাগে ভরে সোজা চলে যান চেকইন হয়ে ইমিগ্রেশনে। সেখান থেকে হোল্ডিং লাউঞ্জে গিয়ে ধরা খেয়ে যান। এক প্রশ্নের জবাবে রাশেদুল ইসলাম খান বলেন, জুতার মালিক হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এদের পরিচয় ঘটে কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। বিদেশে যাওয়ার আগে যেখানে বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিতে হয়। সেখানেই তিনদিনের পরিচয় মাত্র। এতেই তাকে বিশ্বাস করে বিপদে পড়েছেন দুজন। এখন হাবিবুর রহমানকে ধরার চেষ্টা চলছে। তাকে ধরলেই সব বেরিয়ে আসবে কুয়েতে কার কাছে কতদিন ধরে এ ধরনের ইয়াবার চালান পাঠানো হচ্ছিল। এদিকে বিমানবন্দরের হোল্ডিং লাউঞ্জের আগে কেন ধরা পড়েনি জানতে চাইলে পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইকবাল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, ইয়াবা কোন বিস্ফোরক বা ধাতব পদার্থ নয় যে তা মেটাল ডিটেক্টর বা আর্চওয়ে গেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ধরা পড়বে। তাদের ব্যাগ নিশ্চয়ই গেটে ঢুকতেই স্ক্যানিং করা হয়েছে। যা ধরা পড়েনি। যদি এক্সপ্লোসিভ বা ধাতব পদার্থ থাকত নিশ্চয়ই ধরা পড়ত। তারপরও তো এটা ম্যানুয়েলে ধরা পড়েছে। এতে তো প্রমাণিত হয় নিরাপত্তাকর্মীরা সক্রিয়। এ ঘটনার পর থেকে তো আরও সতর্ক ও তৎপর হয়েছে নিরাপত্তাকর্মীরা।
×