ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অব্যবস্থাকে মানুষ এখনও তাদের কপালের ফের মনে করে!

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অব্যবস্থাকে মানুষ এখনও তাদের কপালের ফের মনে করে!

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মুখে মুখে অর্থাৎ বাজারে অনেক কথা ঘোরাফেরা করে। অভিযোগ করা হয়ে থাকে, দেশের মানুষ সরকারী হাসপাতাল থেকে শুরু করে কোথাও ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা পান না। আবার সংবাদপত্রে প্রায়ই আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার নেতিবাচক সচিত্র চালচিত্র দেখে মানুষ কেবল হতাশই হয়। আমাদের দেশের জনগণও নেতিবাচক চিকিৎসা ব্যবস্থার সংবাদ পাঠ করে, সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভাল-মন্দের বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে। অনেকে মন্তব্য করে থাকেন, আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা যতই উন্নত কিংবা আধুনিক হোক না কেন, তা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে থাকে সব সময়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা তারাই ভোগ করে থাকে, যাদের পকেটে আছে রাশি রাশি টাকা। অভিযোগ আছে, দেশের সরকারী হাসপাতালে গ্রামের রোগীরা যখন যান তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তখন সুন্দর ব্যবহারটুকু পর্যন্ত করেন না। এসব অভিযোগ নতুন কোন ব্যাপার নয়। আমরা সব সময় শুনে আসছি, আমাদের সরকারী হাসপাতালে ডাক্তার, নার্সসহ সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী ব্যক্তিদের অনেক সময় ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। আবার অনেকে বলেন, আমাদের সরকারী হাসপাতালগুলোতে ‘ওয়ান ইলেভেনের’ মতো ব্যবস্থা এলেই রোগীদের ব্যাপারে হাসপাতালের ডাক্তারসহ চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটু বেশি সময় দেন এবং যথাসময়ে হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন। এটা যে কেবল হাসপাতালের ব্যাপারেই দেখা যায় তা নয়, আমাদের সকল সরকারী অফিসে ‘ওয়ান ইলেভেনের’ মতো ব্যবস্থা এলেই দেশের মানুষ সেবা পেয়ে থাকেন। এসব কথা কথার কথা কিনা জানি না। এমন কথা মানুষ বলে থাকেন। আমাদের দেশের অনেক মানুষ সকল অব্যবস্থাকে তাদের কপালের ফের অর্থাৎ নিয়তি বলে মেনে নেন। এই মেনে নেয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ খোলা থাকে না। আরও অভিযোগ করা হয়ে থাকে, সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর অসাধু ডাক্তার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট অসাধু ব্যক্তিদের বেসরকারী হাসপাতালের সঙ্গে নিবিড় একটা অনৈতিক সম্পর্ক থাকে। সম্পর্কটাকে অনৈতিক এই জন্য বলা হয়ে থাকে যে, সরকারী হাসপাতালের একশ্রেণীর অসাধু ডাক্তার থেকে শুরু করে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যস্ত থাকেন সরকারী হাসপাতালে আসা একজন রোগীকে বেসরকারী হাসপাতালে পাঠিয়ে কমিশন খেয়ে নিজেদের পকেট কিভাবে ভারি করবেন। সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে যখন এমন অভিযোগ ওঠে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপ হয়ে যায়। আবার ভয়ও জাগে। মন খারাপ হয়ে যায় এই জন্যই যে, একজন লোক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়ে থাকেন। একটা লোক যখন অনেক পড়াশোনা করে ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন, তখন ধরে নিতে হবে শিক্ষিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চিন্তার মাঝে কোন ধরনের আবর্জনা থাকতে পারে না। আসলে যাদের চিন্তা-চেতনার মাঝে অন্ধকারের ছোঁয়া থাকে, তারাই অনৈতিক পথ ধরে টাকা-পয়সা আয় করতে চান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় যে, আমাদের দেশের মুমূর্ষু রোগীদের নিয়ে আইসিইউ বাণিজ্য আজকাল ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। সেখানে বিন্দুমাত্রও মানবিকতার কোন স্থান নেই। যে যেমনভাবে পারছে অসহায় রোগীদের নিয়ে এই অমানবিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দেশের রাজধানীর সরকারী হাসপাতালগুলোর ইনটেনসিভ কেয়ার অর্থাৎ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে একজন রোগীর স্থান পাওয়া আর সোনার হরিণ লাভ করা সমান কথা। আইসিইউতে একজন রোগীর জন্য একটি আসন বরাদ্দ পাওয়া খুবই কঠিন থেকে কঠিনতর ব্যাপার। সহজে সেখানে আসন লাভ করা যায় না। কেননা, দেশের হাসপাতালের আইসিইউ কেন্দ্রগুলোতে আসন সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এই সীমিত আসনের কারণে রোগীর স্বজনরা যখন রোগীদের জন্য আসনের ব্যবস্থা করতে পারেন না, তখন তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তখনই সুযোগ বুঝে সক্রিয় হয়ে ওঠেন যারা এই আইসিইউ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। তাদের আইসিইউ বাণিজ্যের সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা খুবই ক্ষমতাবান এবং শক্তিশালী। অভিযোগ আছে, এর সঙ্গে জড়িত আছে বড় বড় মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা একশ্রেণীর অসাধু ডাক্তার, হাসপাতালের ব্রাদার, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ডবয়, এমনকি এ্যাম্বুলেন্সের চালক পর্যন্ত। এই ব্যবসায় একজন পাস করা ডাক্তারের সঙ্গে একজন ওয়ার্ডবয়ের নিবিড় বন্ধুত্বের কোন বাধা নেই। অভিযোগ রয়েছে সরকারী হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীর স্বজনরা তাদের রোগীর জন্য হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটে আসন না পেয়ে শরাণপন্ন হয়ে থাকেন আইসিইউ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের ব্যক্তিদের সঙ্গে। তখন আইসিইউ বাণিজ্যের সিন্ডিকেটের সদস্যরা সুযোগ পেয়ে বেসরকারী হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে (লাখ লাখ নয়) কোটি কোটি টাকা আয় করে থাকে। একজন রোগীর স্বজনকে তার রোগীকে আইসিইউতে আসনের জন্য অনেক টাকা গুনতে হয়। অনেক সময় তা লাখ টাকার পর্যায়ে চলে যায়। অভিযোগ এখানেই শেষ নয়। এর চেয়েও গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে রোগী মারা যাওয়ার পরও রোগীকে আইসিইউতে রাখা হয়। সম্প্রতি রাজধানীর একটি হাসপাতালে ষোলো মাস বয়সী একটি শিশুকে আইসিইউতে মারা যাওয়ার পরও রাখা হয়। বিনিময়ে শিশুটির অভিভাবকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয়ার অভিযোগও উঠেছে। শেষে এই অভিযোগসহ অন্যান্য অভিযোগের কারণে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাড়ে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করেন প্রতিষ্ঠানটিকে। এমন সংবাদ দেখে যে কেউ আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আতঙ্কে থাকবেন। বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক হাসপাতালেই লেখা থাকে মানুষ যেন দালাল থেকে সাবধান থাকে। অথচ অভিযোগ করা হয়ে থাকে, হাসপাতালের এসব অসাধু ডাক্তাররাই, এমনকি কর্মচারীরা পর্যন্ত দালালি পেশায় নিয়োজিত থাকেন। তাদের অর্থাৎ বেসরকারী হাসপাতালের আধুনিক দালালদের কাজ হলো তাদের মূল দায়িত্ব বাদ দিয়ে সরকারী হাসপাতাল থেকে কিভাবে রোগী বেসরকারী হাসপাতালে পাঠিয়ে অনৈতিকভাবে নিজের উন্নতি করা যায় সেই দিকে মন দেয়া। এমন খবর পাঠ করে সবারই মনটা বিষণœতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভাবি আমরা কিসের মধ্যে আছি! আমাদের সকল অর্জনকে একশ্রেণীর নষ্ট মানুষ কি একেবারে শেষ করে দেবে? দায়িত্ববান ব্যক্তিদের কি উচিত নয় সকল অন্যায়ের প্রতিকারের ব্যাপারে একমত হওয়া? তা না হলে দেশের অসহায় জনগোষ্ঠী কষ্টের মাঝেই থেকে যাবে। বলা হচ্ছে, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন অনেক চাঙ্গা। যেখানে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি ছিল, সেখানে গত অর্থবছরে তা ৩ হাজার ৪শ’ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। বিস্ময়কর উচ্চতায় অবস্থান করছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আরও বলা হচ্ছে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রির হার বাড়ায় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতাও কমেছে। ৫ মাসে পণ্য রফতানি করে ১ হাজার ৩শ’ ৬৯ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময় থেকে ৬.৩০ শতাংশ বেশি। আগের বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি পণ্য ৪ মাসে আমদানি হয়েছে। এমন সুখবর যখন আমরা সংবাদপত্রে পাঠ করি তখন খুবই ভাল লাগে। ভাবি আমাদের দেশেরও পৃথিবীর উন্নত দেশের সারিতে দাঁড়াতে আর বেশি বাকি নেই। আমাদের কেউ তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের নাগরিক বলতে পারবে না। দেশের বাইরের এবং ভেতরের যে সব ব্যক্তি আনন্দের সঙ্গে আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশের নাগরিক বলে ঠাট্টা-তামাশা করতেন, তারা আমাদের এই উন্নতির পরিসংখ্যান দেখে অবশ্যই চুপসে যাবেন। দেশের বাইরে আমাদের কেউ আর ভিক্ষুক বলতে পারবেন না। কিন্তু আমরা যখন পত্রপত্রিকায় একশ্রেণীর লোকের অনৈতিক কা--কারখানার ব্যাপকতা দেখি, তখন আমাদের মন চুপসে যায়। প্রশ্ন জাগে, আমাদের মন থেকে কি মানবিক মূল্যবোধের কণাটুকু উড়ে গেছে? একদল লোক মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করবে, তা কি মেনে নেয়া যায়? তা চলতে দেয়া যায় না। আমাদের দেশের ডাক্তারদের বড় বড় সংগঠন আছে। তারা কি পারেন না গুটিকয়েক অসাধু ডাক্তারকে শাস্তি দিয়ে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্নাম দূর করতে? এ ব্যাপারে হৃদয়বান ডাক্তারদের উচিত হবে নিজেদের পেশার সম্মান রক্ষা করার তাগিদে কিছু অসাধু ডাক্তার থেকে শুরু করে চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা চিকিৎসা ব্যবস্থার নামে অপচিকিৎসা কিংবা দুর্বৃত্তপনায় জড়িত তাদের শাস্তি দিয়ে আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থার শ্রীবৃদ্ধি করা। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে যদি হৃদয়বান ডাক্তাররাও আইসিইউ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন, তবে রক্ষা পাবে দেশের মানুষ এবং উজ্জ্বল হবে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রে নিয়োজিত সাধু ব্যক্তিদের মুখ। লেখক : আইনজীবী ও সমাজসেবক
×