ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন এবং তাঁর কর্মতত্ত্ব

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন এবং তাঁর কর্মতত্ত্ব

যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়- এই অমোঘ সত্য থেকে প্রাণী জগতের নিষ্কৃতি নেই, জেনেও মানুষ অমরত্বের সন্ধানে দশদিগন্তে রেখে যেতে চায় তার সৃষ্টি, সম্ভার রাজা প্রজার শিল্পী সাহিত্যিক প্রশাসক শাসক সকলেই সেই নিরন্তর চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চায়। সাফল্যতার সাফল্য পেতে যদিও সময় প্রয়োজন। একদিন সেই সময়ই এগিয়ে নিয়ে যায় অনন্ত দুয়ারে। অনন্ত দুয়ার পেরিয়ে যারা উজ্জ্বলতম পথের দিকে অগ্রসর হতে পারেন, তারাই হয়তবা শিল্প সাহিত্যে মেধা মননে অধ্যাপনা সাংবাদিকতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। সমাজের আলোকিত লোকালয়ে। আলোকিত লোকালয়ের তেমনই একজন মানুষ মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দুটি পরীক্ষাতেই ৫০ দশকের গোড়ার দিকে ‘জলপানি’ পেয়েছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী গ্রামে মোহাম্মদ মুহিউদ্দিন ভূইয়ার আর্থিক অবস্থাও খুব উজ্জ্বল না হলেও তারই একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পরপর ছাত্রজীবনেই শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা। সেকালের দৈনিক মিল্লাত থেকে শুরু করে দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাকে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু মাত্র ৩০ টাকায়। ৫০ দশকের গোড়ার দিকে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ার সুবাদে তিনি ইতিহাস বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় পুনরায় মিলেছিল সেই ‘জলপানি’। সম্ভবত কালীরঞ্জন স্কলারশিপ যার অর্থমূল্য ছিল ৫ টাকা। এমএ চূড়ান্ত পরীক্ষায় ১ম হওয়ার কিছুদিন পর তিনি জগন্নাথ কলেজের শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে সেকালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা, প্রবন্ধ এবং প্রাচীনকালের ইতিহাস ও আধুনিক ইতিহাস বিষয় নিয়ে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ইত্তেফাক-সংবাদসহ মাসিক পত্রিকাগুলোতে জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনার সময়ে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেকালের অধিকাংশ কৃতী ছাত্ররাই ছিল ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক। ৬০ দশকের গোড়ার দিকে মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে পড়তে হয়েছিল আইয়ুব খানের রোষানলে। সেই রোষানল থেকে বাঁচবার পরামর্শ দিয়েছিলেন ড. আব্দুল মতিন চৌধুরী। শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে উভয় পাকিস্তানের ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে মাত্র ১১ জন সে বছর সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সম্ভবত সেটি ১৯৬০ অথবা ১৯৬১ সাল। প্রথম জীবনের মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে এসডিও পদে মেহেরপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবং পরবর্তীতে তিনি আমাদের পাবনার এডিসি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৬ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের এক কবিতা পাঠের আসরে তাকে প্রথম দেখি। পাকিস্তান সরকারের সিএসপি অফিসারদের যত্রতত্র মেলামেশার সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও তিনি সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন এবং অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলেই ছিলেন তার প্রতি অনুগত। সেই সঙ্গে সুদক্ষ প্রশাসক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন আমাদের অগ্রজ কবি নাট্যকার অধ্যাপক জিয়া হায়দারের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক থাকবার কারণে। মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের স্ত্রী আলো সিরাজ ছিলেন জিয়া হায়দারের ছাত্রী নারায়ণগঞ্জের তুলারাম কলেজের ১৯৬১-৬৩ সালের শিক্ষা বছরে। উপরোক্ত আলো সিরাজ জিয়া হায়দার নির্দেশিত তুলারাম কলেজের বার্ষিক নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার হঠাৎ একদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে বদলি করলেন পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। বদলির কারণ মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন তার একটি লেখায় পাঠকদের জানিয়েছিলেন, পাবনার এডিসি থাকাকালীন সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মোনায়েম খানের একটি অন্যায় কাজের নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করায় তাকে রাতারাতি বদলি করা হয়েছিল। সম্ভবত বেশ কিছুকাল তাকে চেয়ারে বসতে দেয়নি পাকিস্তান সরকার। পরে সেই মোনায়েম খানের রোষানল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি চলে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বড় বড় দায়িত্বশীল পদে যে সকল বাঙালী পাকিস্তান সরকারের পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন, সে সকল বাঙালীর প্রত্যেককেই অন্তরীণ গৃহবন্দী অবস্থায় কষ্টের ভেতরে দিন যাপন করতে হয়েছিল প্রায় ২ বছর। ইসলামাবাদ থেকে একদিন সপরিবারে পালিয়ে আফগানিস্তান হয়ে দিল্লীতে কয়েক রাত কাটিয়ে ১৯৭৩ সালে নবেম্বর মাসে ঢাকার শ্যামলীতে প্রকৌশলী আবু মুনসুরের ইছামতী হাউসে কিছুদিন থাকার পরে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পদে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্ম-সম্পাদনা শেষে ১৯৮০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) চেয়ারম্যান পদে তাকে নিয়োগ দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। তার যোগদানের আগে বিসিক সুনাম অর্জন করেছিল ‘চোর’ হিসেবে এবং কয়েকজন অফিসারকে কয়েক মাস জেল খাটতে হয়েছিল ‘চোর’ হিসেবে। বিসিকের নাম শুনলে লোকে বলত, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে সকল লোকজনই ‘চোর’। সেই অপবাদ ঘোচাতেই মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনকে পোস্টিং দেয়া হয়েছিল চেয়ারম্যান পদে। যেহেতু তিনি তার শিক্ষাজীবনে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি জানতেন ‘প্রচার-ই-প্রসার’। কিন্তু বিসিকের জনসংযোগ না থাকায় বিসিকের এক কর্মকর্তা নিজেই মাঝেমাঝে পত্রপত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠাতেন যা অধিকাংশ ছাপা হতো না। চেয়ারম্যান মহোদয় বিষয়টি উপলব্ধি করে গণসংযোগ বিভাগে জনসংযোগ নির্বাহী পদ সৃষ্টি করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। সেই বিজ্ঞাপনের একাধিক শর্তের ভেতরে একটি শর্ত ছিল জনসংযোগ নির্বাহীর পদে আবেদনকারীর অবশ্যই পাবলিকেশন্স থাকতে হবে এবং রেডিও টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বিজ্ঞাপনের শর্ত পূরণ হওয়ার প্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালের শেষ দিকে ১৩ জন প্রার্থীর ভেতরে গণসংযোগ নির্বাহীর চাকরিটা আমার হয়েছিল। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রথম হওয়ার ছাত্র মতিউর রসূল মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর পাবলিকেশন্স না থাকায় তার সেই চাকরি হয়নি। তবে ১৯৮১ সালে বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণীর চাকরি দিয়েছিলেন মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন। আমি গণসংযোগ নির্বাহীর দায়িত্ব নেয়ার পরে বিসিকের চোর নামটা ঘোচাতে বেশ কষ্ট হলেও যেহেতু বাংলাদেশ টেলিভিশনের রেডিওর এবং পত্রপত্রিকার সকলের সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক থাকায় বিসিকের সংবাদ নিয়মিত প্রকাশিত হতো ওই সকল পত্রপত্রিকায় এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ বিভাগের প্রধান কবি হুমায়ুন চৌধুরী এবং কবি ফারুক আলমগীর তাদের কাছে যখনই কোন বিসিকের সংবাদ নিয়ে গিয়েছি, এমনকি প্রতি সপ্তাহে টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান মহোদয়ের উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল এবং টেলিভিশনের বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের এমনকি কুতুবদিয়া মহেশখালী অঞ্চলের লবণ প্রকল্পের কর্মকা- প্রচারিত হতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে। অপরদিকে সেই সময়ে বাংলার মাত্র কয়েকটি পত্রিকা ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আজাদ এবং বাংলাদেশ টাইমস ও বাংলাদেশ অবজারভারে বিসিকের সংবাদ নিয়মিত ছাপা হওয়ার সুবাদে বিসিকের চোর নাম মুছে দিতে বেশি সময় লাগল না। বোধকরি আমার কাজ-কর্মে সন্তুষ্টি হয়ে ১৯৮১ সালে আমাকে বেশ কয়েক মাসের জন্য মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন ফিলিপিন্সের ম্যানিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্সে পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডস সরকারের স্কলারশিপে। ইতোমধ্যে বিসিক চেয়ারম্যান বিসিক থেকে নিয়মিত ইংরেজী বাংলায় বুলেটিন প্রকাশ শুরু করেছিলেন। মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের বিখ্যাত কয়েকটি বইয়ের ভেতরে ইংরেজীতে লেখা ১. কান্তজির মন্দির, ২. ক্রাপ্টস ফ্রম বাংলাদেশ এবং মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিনের নিয়মিত কলামগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতো এবং অধিকাংশ ব্যঙ্গাত্মক। তাকে বিএনপি সরকারের সময় বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর কটূক্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদসহ জনাকয়েক সিএসপির রোষানলেও পড়তে হয়েছিল তাকে। ১৯৮৪ সালে তাকে বিসিকের চেয়ারম্যান থেকে বদলি করে সরকারের গেজেটিয়ারের সম্পাদক বানিয়ে অপমান করা হয়েছিল। তিনি বিসিকের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে ইউএসএইডএ’র অর্থায়নে উইমেন্স এন্টার প্যানিওরশিপ প্রজেক্টের অধীনে শিক্ষিত মেয়েদের চাকরিসহ ভারতের হায়দরাবাদ ফিলিপিন্সে, সিঙ্গাপুরে, নেদারল্যান্ডসের এবং থাইল্যান্ডে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে বিসিকের চোর নাম ঘোচে গেলেও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। এরশাদ আমল শেষ হওয়ার পরে তিনি সরকারী সচিব এবং প্লানিং কমিশন মেম্বারসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যেমন, ব্রিটিশ সরকারের প্রাইমারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শিক্ষককে দেশের বাইরে বিশেষত ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন। তার একটি কবিতা বইয়ের নাম ‘বিচ্ছিন্ন অনুভূতি’। আমি সেই বিচ্ছিন্ন অনুভূতিকে বুকে নিয়ে দেখতে পাচ্ছি দীর্ঘ ৩৭ বছরে কয়েক হাজার অনুভূতির স্মৃতি আমাকে কাঁদিয়ে যাচ্ছে দিবারাত। মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে পৃথিবীর যাবতীয় প্রেম, ভালবাসা ফেলে রেখে পাড়ি দিলেন ৮৩ বছর বয়সে এক অনন্তের দিকে। তার জন্ম হয়েছিল ২৮ আগস্ট ১৯৩৩।
×