ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সওজের শত কোটি টাকার সম্পত্তি অন্যের দখলে

প্রকাশিত: ০১:৪৮, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সওজের শত কোটি টাকার সম্পত্তি অন্যের দখলে

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা ॥ সড়ক ও জনপথ বিভাগের মালিকানাধীন বেড়ার ১০০ কোটি টাকা বেশি দামের পাঁচ একর স্ট্যাক ইয়ার্ডসহ অন্যান্য ভূসম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারির যোগসাজসে ওই ভূসম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে। সেখানে তারা নানা ধরণের ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে। চক্রটি ষ্ট্যাকইয়ার্ডের দু’একর পুকুরটি বালু দিয়ে ভরাট করেছে। তারা স্ট্যাক ইয়ার্ডের ভেতরে হাট বসিয়ে খাজনা আদায়ের হাজার হাজার টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে দেশের পূর্বাঞ্চলের সড়কপথে যোগাযোগ এবং সীমান্ত এলাকার সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৬০ সালে বেড়ার নগরবাড়ী থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ১৯৬২ সালে সড়ক ও জনপথ বিভাগ সড়ক নির্মাণ কাজের সুবিধার জন্য নগরবাড়ী-দিনাজপুর সড়কের কোল ঘেষে বেড়া সিএন্ডবি বাসষ্ট্যান্ডের উত্তর-পূর্ব পাশে পাঁচ একর জমি হুকুম দখল করে সেকশনাল অফিস স্থাপন করে। পরে সেকশনাল অফিসটি কাশিনাথপুরে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে পরিত্যক্ত সেকশনাল অফিসটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান স্ট্যাক ইয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল। মহাসড়কের পাশে ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের এই ভূসম্পত্তির ওপর নজর পরে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির। তারা পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে হাত করে ২০১০ সালে ষ্ট্যাকইয়ার্ডের স্থাপনাসহ পাঁচ একর ভূসম্পত্তি দখল করে নেয়। এছাড়া নগরবাড়ী-বগুড়া-দিনাজপুর মহাসড়কের বেড়া ইছামতি ব্রীজের পূর্বপাশে সিঅ্যান্ডবি চতুর বাজারের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় সাত কোটি টাকা মূল্যের এক বিঘার বেশি জমি জনৈক ঠিকাদার দখলে করে পাঁকাঘর তুলে দোকান ভাড়া দিয়েছে। এছাড়া বেড়া পৌর এলাকার জোড়দাহ গ্রামের মরহুম আবুল কাশেম জীবিত থাকা কালীন সময়ে সিঅ্যান্ডবি বাসষ্ট্যান্ডের উত্তর পাশে অবস্থিত সওজের পাঁচ ফুট জায়গা দখল করে ৪তলা নর্থ বেঙ্গল আবাসিক হোটেল নির্মাণ করেন। তার চার ছেলে রঞ্জু, রফিকুল, শফিকুল ও মনোয়ার। সম্প্রতি রফিকুল সাঁথিয়া উপজেলার করমজা গ্রামের মৃত-আউব আলীর ছেলে আব্দুল কাদের এর্বং এই গ্রামের মৃত- কোবাদ মল্লিকের ছেলে রন্টু মল্লিকের কাছে সওজের এক শতাংশ জায়গা ২৪ লাখ টাকা বিক্রি করেছে। সেই জায়গায় আব্দুল কাদের ও রন্টু বিল্ডিং নির্মাণ শুরু করলে পাবনা সওজ বিভাগ থেকে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আনোয়ার হোসেন রঞ্জুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ সম্পত্তি তাদের পৈত্রিক বলে দাবি করেন। পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের দাবি, ১৯৬০ সাল সড়ক নির্মাণ কালে জমি হুকুমদখল করে মালিকদের ক্ষতিপুরণের টাকা দেয়া হয়েছে। পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ হুকুমদখলকৃত জমি খারিজ না করায় আরএস রেকর্ড জমির সাবেক মালিক বা তাদের ওয়ারিশদের নামে হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে, ওই জমির মালিক তারা। জমির প্রকৃত মালিকানা সড়ক ও জনপথ বিভাগের। জানা যায়, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ২০১০ সালের ১০ ডিসম্বর পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের বেড়া স্ট্যাক ইয়ার্ডটি দখল করে নেয়। এরপর তারা স্ট্যাক ইয়ার্ডের একটি সেমি-পাঁকা ভবন ও বাউন্ডারী ওয়াল ভেঙ্গেটি ফেলে এবং বড় বড় বেশ কয়েকটি মেহগনি গাছ কেটে নিয়ে গেছে। স্ট্যাক ইয়ার্ডের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে ইউ টাইপের প্রশস্থ হেরিংবন্ড সড়ক। বেড়া পৌরসভা এই সড়কটি নির্মাণ করেছে। গত বছর ষ্ট্যাকইয়ার্ডের ভেতরে অবস্থিত দুই একর আয়তনের একটি পুকুর বালি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে দোকান ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া হবে। প্রভাবশালী ওই ব্যক্তিরা পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারির যোগসাজসে জায়গা দখলে নিয়ে দোকান ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়ে আসছে। তারা ভাড়া ও খাজনার টাকা তুলে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সাথে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। ফলে বেদখল হয়ে যাওয়া সরকারের কোটি কোটি টাকা মূল্যের ভূসম্পত্তি উদ্ধারে সওজ বিভাগের নেই কোন তৎপরতা। বেড়া পৌরসভার প্রকৌশলী খন্দকার শাহ্ মোঃ ফিরোজুল আলম সড়ক নির্মাণের কথা স্বীকার করেন। বেড়া সিঅ্যান্ডবি চতুরবাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি হাট সম্প্রসারনের কথা বলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে বিশাল বিশাল ছাপড়া ঘর তৈরি করে অর্ধশতাধিক পেঁয়াজের আরৎ বসিয়েছে। বেশ কিছু হোটেল রেষ্টুরেন্ট, ফার্নিচার কারখানা, ওয়েলর্ডি কারখানা, গোখামার, মাছ বাজার, মুদিদোকান ও ৩০টির বেশি টংদোকান ভাড়া দেয়া হয়েছে। এছাড়া সপ্তাহের দুই দিন শনি ও মঙ্গলবার ষ্ট্যাক ইয়ার্ডে অবৈধভাবে পাট, পেঁয়াজ, গাছের চারা, ফার্নিচার, রিক্সা ভ্যানসহ নানা পণ্য বিক্রি হাট বসে। প্রতি হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে খাজনা আদায় করা হয়। পরে খাজনার টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, হাট-বাজার থেকে আদায় করা খাজনার টাকা সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মহলটি সওজের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারির যোগসাজসে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে। পুকুর ভরাটের সাথে সওজের ওই কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যোগসাজস ছিল বলে বেড়া সিঅ্যান্ডবি চতুরহাটের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। এদিকে, নগরবাড়ী-বগুড়া-দিনাজপুর মহাসড়কের বেড়া ইছামতি ব্রীজের পূর্বপাশে চতুর বাজারের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের প্রায় এক বিঘা জমি জনৈক নাজিম ঠিকাদার ২০১১ সালে দখলে নিয়ে টিনের ঘর তুলে ভাড়া দিয়ে আসছিল। সম্প্রতি সে টিনের ঘর ভেঙে পাঁকা ঘর নির্মণ করে অনেকগুলো দোকান ভাড়া দিয়েছে। এদিকে প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে থাকা শত কোটি টাকা মূল্যের ভূসম্পত্তি উদ্ধারে যোগাযোগ মন্ত্রনালয় কিম্বা সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মোফাজ্জল হায়দারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সওজের বেড়া ষ্ট্যাকইয়ার্ডের জায়গা কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়া হয়নি। বেড়া পৌর পরিষদ অবৈধভাবে ষ্ট্যাকইয়ার্ডের জায়গা দখল করে কাজগুলি করেছে। ষ্ট্যাকইয়ার্ডের পুকুর ভরাট ও মার্কেট নির্মাণ বন্ধে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ এর দপ্তর থেকে নংÑ ৭৬২/২ (৫) স্মারক পত্রে সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সাঁথিয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের তরফ থেকে কোন সহযোগীতা পাওয়া যায়নি। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশাসনিক সহায়তার অনুরোধ জানিয়ে অতিসম্প্রতি পাবনা জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে সহযোগিতার কোন আশ্বাস পাওয়া যায়নি।
×