ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অভিজিত হত্যা

মেজর জিয়া ও সেলিম আটক হলেই জট খুলবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মেজর জিয়া ও সেলিম আটক হলেই জট খুলবে

শংকর কুমার দে ॥ আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিত রায়কে হত্যার দুই বছর পূর্তি। যে কোন সময়ে বহুল আলোচিত এই হত্যাকা-ের তদন্তে নাটকীয় অগ্রগতি ঘটতে পারে বলে তদন্তকারী সংস্থার দাবি। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বর্তমান প্রধান সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও এই জঙ্গী সংগঠনের অপর জঙ্গী নেতা সেলিম (ছদ্মনাম) গ্রেফতার হলেই এই খুনের জট খুলে যাবে। তদন্তকারী সংস্থার এমনটাই দাবি। এই খুনের মামলার তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি)। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিজিত খুনের ঘটনার পর গত দুই বছরে গ্রেফতার হয়েছে ৮ জন, বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১ জন, পলাতক রয়েছে ৬ জন। পলাতকরা ছদ্মনাম ব্যবহার করায় তাদের প্রকৃত নাম উদ্ধারের চেষ্টা করছে তদন্তকারীরা। তবে গত দুই বছরেও খুনের নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী ও প্রকৃত খুনীকে গ্রেফতার করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ জন্য এখনও তদন্ত অন্ধকারেই রয়ে গেছে বলা হয়। তবে তদন্তকারী সংস্থার দাবি, তদন্তে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামক জঙ্গী সংগঠনটির জঙ্গীরা অভিজিত ছাড়াও গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নীলয় হত্যা, লালমাটিয়ায় আহম্মেদ রশীদ টুটুল হত্যা চেষ্টা এবং সাভারে শান্তা মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিয়াদ মোর্শেদ বাবু হত্যাকা-ে সরাসরি অংশ নেয়। অভিজিত রায়ের বইয়ের প্রকাশক আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনার মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গণজাগরণ মঞ্চকর্মী নাজিম উদ্দিন সামাদ হত্যা এবং কলাবাগানে আমেরিকান দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বি তনয় হত্যার সঙ্গে মূল পরিকল্পনাকারী ও জড়িত তারা। এসব মামলার তদন্তে এবং বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত এবিটির সদস্যদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট এসব তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামিদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক শরীফুল ওরফে হাদী-১ কে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়েছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্ত সূত্র জানায়, প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলায় রিমান্ডে থাকা পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী সুমন ওরফে শিহাব ওরফে সাকিব ওরফে সাইফুলের দেয়া ‘রাজধানীর বনশ্রীর জে ব্লক থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় পুরস্কার ঘোষিত শরিফুল ওরফে শরিফ ওরফে হাদী-১ ওরফে সাকিব ওরফে আরিফ ওরফে সালেহ। সাকিব, শরিফ, সালেহ, আরিফ ও হাদী নাম ব্যবহার করে পরিচয় গোপন করে আসছিলেন ৩০ বছরের যুবক শরিফুল। তার বাড়ি খুলনা অঞ্চলে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর ছাত্র শরীফ একটি এনজিওতে চাকরি করতেন বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল। তিনি সংগঠনের সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়াও আইটি (তথ্য প্রযুক্তি) বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন। এছাড়াও বিভিন্ন অপারেশনের সদস্য নির্বাচন ও সংগ্রহে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। অভিজিত হত্যাকা-ে এই খুনী জঙ্গী সরাসরি অংশ নেয়। দুই বছর আগে একুশে বইমেলা চলাকালেই বইমেলা থেকে মাত্র কয়েকশ গজ দূরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে ফুটপাথে কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিত রায়কে। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী বন্যা আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে মেলা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আক্রান্ত হয়ে নিহত হন অভিজিত রায়। স্ত্রী বন্যাও হামলার শিকার হয়ে একটি আঙ্গুল হারান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে মুক্তমনা ব্লগার সাইট পরিচালনাকারী অভিজিত থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রে। লেখালেখির কারণে জঙ্গীদের হুমকিতে থাকার মধ্যেও বইমেলার সময় স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। এই হত্যাকা-ের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই তদন্ত করতে ঢাকায় আসে, নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে, আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায়, হত্যাকা-ের বিষয়ে আল কায়েদার দায় স্বীকার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অভিজিত হত্যাকা-ের দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বর্তমান কর্ণধার পলাতক শীর্ষ জঙ্গী নেতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া অভিজিত হত্যাকা-ের নির্দেশদাতা। অপর পলাতক আসামি সেলিম (ছদ্মনাম) এই হত্যাকা-ের পরিকল্পনাকারী। তাদের তত্ত্বাবধানেই এই হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার দাবি করা হলেও তারা কেউই গ্রেফতার না হওয়ায় তদন্ত কার্যত: এখনও অন্ধকারেই রয়ে গেছে। তবে হত্যাকা-ের সময়ের ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে অভিজিতকে হত্যার আগে তাঁর আশপাশে জঙ্গী নেতা সেলিম, শরিফুলসহ অন্তত ৬ জনকে অনুসরণ করতে দেখা গেছে। সেলিমকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির কাছে অভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হামলায় আহত হন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ। তাঁরা দুজনই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তারা সেই বছর বইমেলা উপলক্ষে দেশে এসেছিলেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে বইমেলা চলাকালে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে খুন হওয়ার দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন তদন্তকারীরা। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শরিফুল, সেলিম, সাজ্জাদসহ ৭/৮ জন অভিজিত রায়ের গতিবিধি অনুসরণ করেছে। এর মধ্যে শরিফুলসহ ৫ জনকে বেশিরভাগ সময় দেখা যায়। তদন্তকারীদের ধারণা, এই ৮ জনই অভিজিত হত্যায় জড়িত। এ ছাড়া লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদকে হত্যার চেষ্টায় গ্রেফতার করা সিহাব পুলিশকে জানিয়েছেন, অভিজিত হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছেন শরিফুল। ঘটনাস্থলের আশপাশে সন্দেহভাজন ৬ জনের ভিডিও ফুটেজ গত ২১ আগস্ট ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয় তাদের ধরিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি। ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট মহানগর পুলিশের অনলাইন নিউজ পোর্টাল ডিএমপি নিউজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলা হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষস্থানীয় নেতা সেলিম ওরফে ইকবাল ওরফে মামুন ওরফে হাদী-২-কে অভিজিত হত্যায় ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এগুলো তাঁর প্রকৃত নাম নাও হতে পারে। সেলিমের উচ্চতা ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি, গায়ের রং শ্যামলা এবং তিনি চশমা পরেন। বিজ্ঞপ্তিতে তার কোন ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। তদন্তকারীরা ঘটনাস্থল থেকে হত্যাকারীদের রক্তমাখা চাপাতি, চুল, ব্যাগ, অব্যবহৃত সিরিঞ্জ, পত্রিকা, জিন্স প্যান্ট, তুলা, স্যাভলন, টিস্যু পেপারসহ ১৩ ধরনের আলামত উদ্ধার করে সেসব ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) এফবিআই পরীক্ষাগারে পাঠায়। সেই ডিএনএ পরীক্ষার ফল ঢাকায় তদন্তকারী সংস্থার কাছে এসেছে। কিন্তু এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে যে ৮ জন এখন গ্রেফতার আছেন, তাদের কারও সঙ্গে ওই ডিএনএ নমুনা মেলেনি। এ কারণে তদন্ত অনেকটাই অন্ধকারে। অভিজিত রায় মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। কর্মকর্তাদের দাবি, তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। অভিজিত হত্যায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের একজন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের শরিফুল ইসলাম ওরফে মুকুল রানা গত জুনে ঢাকার মেরাদিয়ায় পুলিশের সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। নিহত অভিজিত রায়ের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় গণমাধ্যমকে বলেছেন, পুলিশ যাদের নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে, তাদের গ্রেফতার করুক। আসামিদের ঠিকানা সংগ্রহ করে হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারে। তিনি বলেছেন, মামলা তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলেই পুলিশ বলে অগ্রগতি আছে, আসামিরা শনাক্ত হয়েছে। এর বাইরে তো পুলিশ আমাকে কিছু জানায় না। অভিজিত হত্যার দুই বছর পূর্তিতে এখনও বিচার পায়নি খুন হওয়া অভিজিতের পরিবার।
×