ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাকের নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পোশাকের নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পোশাক রফতানির জন্য সুনির্দিষ্ট বাজারে আটকে না থেকে নতুন নতুন বাজার খুঁজতে এই খাতের উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে তৈরি পোশাক পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ হবে আত্মমর্যাদাশীল একটি দেশ। আর এটি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন দেশে ব্যাপক শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তৈরি পোশাক খাতের কারখানার সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। শুল্ক সুবিধার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে এ সুবিধা আছে। কিন্তু পণ্য রফতানির বিপরীতে আমেরিকাকে ট্যাক্স দিচ্ছি। আমরা বোধহয় তিন বিলিয়নের মতো রপ্তানি করি। আর সাড়ে আটশ’ মিলিয়ন ইউএস ডলার আমরা তাদের ট্যাক্স দিই। আমাদের ট্যাক্সে কিন্তু আবার তারাও চলে। শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দ্বিতীয় ঢাকা এ্যাপারেল সামিট-২০১৭ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। এ শিল্প খাতকে একটি টেকসই উন্নয়ন খাত হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আয়োজিত এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছেÑ ‘টুগেদার এ বেটার টুমরো’। এ ছাড়া ২০২১ সাল নাগাদ তৈরি পোশাক খাতে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্জনে কর্মপন্থা প্রণয়ন নিয়েও আলোচনা হবে এবারের সম্মেলনে। গত ২০১৪ সালের প্রথম এ্যাপারেল সামিট অনুষ্ঠিত হয়। ওই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন (বিজিএমইএ) দিনব্যাপী এই দ্বিতীয় এ্যাপারেল সামিটের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেনÑ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু এবং বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়েদুন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বারোপ করেছে। এ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা সহায়তা করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ববাজারে আমাদের পণ্যসামগ্রীর চাহিদা কীভাবে বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারে আমাদের কাজ করতে হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই। তিনি বলেন, পোশাকেরও তো বৈচিত্র্য আছে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের পোশাক মানুষ ব্যবহার করে। কাজেই সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমি আমাদের ব্যবসায়ীদের বলব, শুধু এক জায়গায় না থেকে, আপনারাও দেখেন কোন দেশে কোন পোশাকের চাহিদা সব থেকে বেশি। প্রত্যেক সিজনের সঙ্গে রঙের বৈচিত্র্যও আছে, সেগুলো দেখে আপনারও কিন্তু বৈচিত্রপূর্ণতা আনতে পারেন। আপনারা যদি এটা দেখে করেন, তাহলে কখনোই আমাদের এই শিল্পটা মার খাবে না। শেখ হাসিনা বলেন, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একমাত্র আমেরিকা আমাদের কোনদিন এ সুবিধা দিল না। এলডিসি কান্ট্রি হিসেবে আমাদের একটা অধিকার আছে, সেটা তো দিলই না। তবুও আমরা পোশাক রফতানির বিপরীতে আমেরিকাকে বড় অঙ্কের ট্যাক্স দিচ্ছি। আমাদের ট্যাক্সে আবার তারা চলে। এটা আবার মনে রাখতে হবে। হাসতে হাসতে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলার পর উপস্থিত ব্যবসায়ীরাও করতালি দিয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাতটিতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের যার ৮০ শতাংশই নারী। তিনি বলেন, আমরা শুধু রফতানিই করব না। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যাতে বৃদ্ধি পায়, দেশের বাজার যাতে সম্প্রসারণ হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেও আমরা আমাদের অর্থনৈতিক নীতিমালা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, তা অর্জনে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার নিশ্চয়তা দেন প্রধানমন্ত্রী। রাজধানীর যানজটের কথা স্বীকার করে লন্ডনেও সড়কে একই ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা বলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, গাড়ির ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে যে আমরা স্বাবলম্বী হচ্ছি, ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হচ্ছে, এটা কিন্তু তারই একটা লক্ষণ। যানজট অবসানে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ঢাকা শহরে অনেকগুলো ফ্লাইওভার আমরা করে দিয়েছি। বিআরটি তৈরি হলে আরও একটু সুবিধা হবে। পোশাক শিল্পঘন এলাকা আশুলিয়ার সড়কটি উন্নত করার আশ্বাসও দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম প্রাইম মিনিস্টার, তখন ঢাকা আশুলিয়া রাস্তাটা করে দিয়েছিলাম। ওখানে যাদের ইন্ডাস্ট্রি আছে আমি তাদের অনুরোধ করেছিলাম, আমরা পারমিশন দিচ্ছি, আপনারা রাস্তা বানান। আপনারা এলিভেটেড রাস্তা করে নিতে পারেন। শুধু মালিকরা বা ওখানকার যারা গাড়ি নিয়ে আসবেন, তারা ওপর দিয়ে যাবেন আর ট্রাকে মাল লোড হবে। কেউ আর সে উদ্যোগ নেন নাই। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে চাই, সদ্ব্যবহার করার দায়িত্ব আপনাদের। শুধু ব্যবসা করে পয়সা কামালে হবে না, কিছু কিছু নিজেদেরও বিনিয়োগ করতে হবে। যত্রতত্র কারখানা না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে তৈরি পোশাক কারখানা করতে বলেন। সারাদেশে ১০০টা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। যত্রতত্র না করে একটা জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে তারা ইন্ডাস্ট্রি করতে পারেন। এখান থেকে অন্তত দুটি অঞ্চল আমরা আপনাদের দিতে পারব। শেখ হাসিনা বলেন, দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএকে সিও ইস্যু করার ক্ষমতা ব্যবসায়ীদের দেয়া হয়েছে। পোশাকশিল্পের স্বার্থে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন এ্যান্ড টেকনোলজি স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এই ফ্যাশন ইউনিভার্সিটি গড়ার পরামর্শও তারই ছিলোÑ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। টেকসই উন্নয়নের জন্য পোশাকশিল্প সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটিও গঠন করে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। পোশাকশিল্পকে নিরাপদ করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গৃহীত উদ্যোগের আওতায় ইতোমধ্যে তিন হাজার ৮৬৯টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৩৯টি কারখানায় ত্রুটি পাওয়া গেছে এবং সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম চলছে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজনের কথা তুলে ধরে উন্নত বিশ্বের ক্রেতা কোম্পানি ও দেশগুলোর সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে আরও বলেন, পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা যাতে ২ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব জমিতে ডরমিটরি স্থাপন করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। গত বছর ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। রফতানি আয় ৩৪ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গত ৮ বছরে ৫ কোটিরও বেশি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে এসেছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ ডলার। মেট্রোরেল ও বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ২০১৮ সালে পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলবে। ইতোমধ্যেই আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছি। ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। গ্যাসের সঙ্কট মোকাবিলার জন্য এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢাকায় ও চট্টগ্রামে ২টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিজিএমইএ’কে দেয়া হবে। এছাড়া ৪ লেনবিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীত করার বিষয়টি আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেনÑ বিজিএমইএয়ের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান এবং সিনিয়র সহসভাপতি মাইনুদ্দিন আহমেদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের অগ্রগতি নিয়ে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে ওঠার পথে তৈরি পোশাক খাতের বড় অবদান রয়েছে। ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনীতি কৃষিনির্ভরতা থেকে শিল্প নির্ভরতার পথে এগিয়েছে, এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটাই সারা বিশ্বের উন্নয়নের পথ। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতির জনকের স্বপ্নের অর্থনৈতিক মুক্তির পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং রফতানি আয় ৩০ বিলিয়ন (৩ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। পিয়েরে মায়েদুন বলেন, ইউরোপ তার মার্কেটে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। এখানকার পণ্য ইউরোপের মার্কেটে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বলেও জানান তিনি। মায়েদুন আরও বলেন, বাংলাদেশ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকের অধিকার, কর্মপরিবেশ ও সকলের অংশীদারিত্বের ওপর জোর দেন তিনি। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট এসময় উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং তৈরি পোশাক খাতের দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা।
×