ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

অভিযোগটাই ছিল সাজানো নাটক

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অভিযোগটাই ছিল সাজানো নাটক

মিথ্যা দিয়ে একটি প্রহসনমূলক গল্পের সূচনা হয়েছিল। যার কোন ভিত্তি ছিল না। ছিল মিথ্যা প্রচারণা ও মানুষের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি করা। সেই অবিশ্বাসের গল্প শুরু করেছিল দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা। তাদের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন আমাদের সুশীল সমাজের একটা অংশ, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য একটি লজ্জাজনক অধ্যায়। গল্পটি শুরু হয়েছিল পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। বিশ্বব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই ষড়যন্ত্রের বীজ রোপণ করেছিল। তবে সেই ষড়যন্ত্রের বীজ তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়েছে। বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের ঋণ বাতিল করেছিল তার প্রমাণ পায়নি কানাডার আদালত। পুরো বিষয়টা ছিল একটা সাজানো নাটক। কেননা, বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করেই দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কলকাঠি নাড়ানো পোড়া মাটির নীতিতে বিশ্বাসী এদেশের বিশ্বাসঘাতকরা। এই ষড়যন্ত্রের প্রধান কারণ ছিল সরকারকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করা ও সরকার যে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দেশ গড়ার মনোবল গড়ে তুলেছিল তা ভেঙ্গে ফেলা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। আরেকটি বিষয় হয়ত এর সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করেছিল। সেটা হয়ত অনেকেই এই তথাকথিত দুর্নীতির গালগল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাননি অথবা সচেতনভাবে সেটাকে এড়িয়ে গেছেন। সেটি হলোÑ সরকারকে দুর্বল করার মাধ্যমে সেই সময়ের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। এটি সম্ভব হয়েছিল যে কারণে সেটি হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব, সততা ও আত্মবিশ্বাসের জন্য। আরও একটি সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে পুরো ষড়যন্ত্র নিষ্ফল হয়েছিল, তা হলো প্রধানমন্ত্রী যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। তখন বিষয়টাকে অনেকেই কাল্পনিক ভাবলেও তা আজ বাস্তব। যে বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে তা হলোÑ এখানে শুধু বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের হাত ছিল না, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দেশীয় ষড়যন্ত্র। বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় এনে তদন্ত করা প্রয়োজন। যদি আমরা অতীত ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখা যায় বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতন ঘটেছিল ব্রিটিশ সামাজ্র্যবাদী শক্তি ও দেশীয় কিছু লোভী ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পেছনে কাজ করেছিল খন্দকার মোশতাকসহ কিছু দেশদ্রোহী ব্যক্তি। পদ্মা সেতুর মিথ্যা দুর্নীতির সঙ্গে এই ধরনের কোন ভেতরের ও কাছের শক্তি সুকৌশলে তাদের ভূমিকা রেখেছিল কিনা তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি একনেকের সভায় সত্যিকার অর্থেই বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তির স্বার্থে আঘাত লাগায় মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল। দুর্নীতির মিথ্যা অপবাদ মাথায় নিয়ে একজন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। অন্যায়ভাবে একজন সচিবকে এক বছর জেল খাটতে হয়েছে। আমি মনে করি, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য এ ঘটনা অত্যন্ত লজ্জার।’ যে মন্ত্রীকে অন্যায়ভাবে পদত্যাগ করতে হলো, যে সচিবকে অন্যায়ভাবে কারাভোগ করতে হলো তাদের ক্ষতিপূরণ কি কোনভাবে করা সম্ভব? সরকার, জনগণ ও রাষ্ট্রের ওপর মিথ্যা গল্প সাজিয়ে যে কলঙ্ক লেপন করা হয়েছিল তার ক্ষতিপূরণ কিভাবে সম্ভব? বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে মিথ্যা অপবাদে জড়িয়ে যে কৃত্রিম গালগল্প তৈরি করা হয়েছিল তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? এখন সময় এসেছে এগুলোর উত্তর খোঁজার। কাল্পনিক গল্পের ষড়যন্ত্র আজও অব্যাহত আছে। সাম্প্রতিককালে একটি ঘটনা থেকে এ বিষয়টি দৃশ্যমান। বাংলাদেশে গণহত্যা নিয়ে ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ মিথস এক্সপ্লোডেড’ নামক বইয়ে পাকিস্তানের অপপ্রচারকারীরা পাকিস্তান বাহিনীর হত্যাকা-ের ছবিকে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা বিহারীদের হত্যা করছে বলে দেখানো হয়েছে, যা জ্বলজ্যান্ত একটি মিথ্যা প্রচারণা। পরাজিত শক্তির এই প্রচারণার সঙ্গে বাংলাদেশের কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তি জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। বিষয়টি সহজভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ যখন বাংলাদেশের জনগণ একাত্তরের ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবিতে সোচ্চার তখন এই ধরনের একটি মিথ্যা প্রচারণার অবতারণা করা হলো। আন্তর্জাতিকভাবেও যাতে গণহত্যা দিবস পালিত হয় সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত পাঠানোর জোর দাবি উঠেছে। এটাকে বন্ধ করার জন্যই এই ধরনের প্রচারণা হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪৫ বছর পরে পাকিস্তানের দৈনিক এক্সপ্রেক্স ট্রিবিউনের এক খবরে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, পাকিস্তান তার সম্পদের হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছে ৭০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করবে। কিন্তু বিষয়টা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং বাংলাদেশের পাকিস্তানের কাছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এটা তো গেল সম্পদ সংক্রান্ত পাওনা। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদের যে রক্তের হোলিখেলা হানাদার বাহিনী খেলেছিল তা তার আর্থিক মূল্য কখনও কি পূরণ করা সম্ভব? ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে যে বাংলা মায়ের মেধাবী সন্তানদের হানাদার ও তার দোসররা নির্মমভাবে হত্যা করে জাতিকে মেধাশূন্য করার প্রয়াস চালিয়েছিল কোন অর্থ-মূল্যেই তা পূরণ করা সম্ভব নয়। যদি পুরো পাকিস্তানকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয় তারপরও পাওনা কোনভাবেই শেষ হবে না। মিথ্যা প্রচারণার গল্প ফাঁদা হয়েছিল সুদূর আমেরিকাতেও। সরকারের বিরুদ্ধে এই মিথ্যা প্রচারণায় বলা হয়েছিল এড রয়েস ও এলিয়ট এ্যাঙ্গেলসহ ছয় কংগ্রেস সদস্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা ও তার ছেলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নিন্দা জানিয়েছেন। রয়েস ও এ্যাঙ্গেল ছাড়াও রিপাবলিকান দলীয় কংগ্রেস সদস্য স্টিভ শ্যাবট, জর্জ হোল্ডিং ও ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য জোসেফ ক্রাউলি এবং গ্রেস মেং এই বিবৃতিতে সই করেছেন বলে দাবি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস ও কমিটির সদস্য এলিয়ট এ্যাঙ্গেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, কোনপক্ষের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নামে ভুয়া বিবৃতি ব্যবহার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় পুরো বিষয়টি ছিল বানোয়াট ও একটি সাজানো নাটক। যারা এক সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাত, মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি হবে বলে গল্প বানাত তাদের এই গালগল্প যে মিথ্যা প্রচারণা ছিল তা আজ দেশবাসী বুঝতে পেরেছে। কারণ, বাংলাদেশ ভারত হয়ে যায়নি। মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যায়নি। তবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে উন্নত বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে বিশাল সমুদ্রসীমা আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে শান্তি ফিরে এসেছে। ছিটমহল বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের আয়তন বেড়েছে। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশ পেয়েছে। তবে কেন এই মিথ্যা প্রচারণা ও গালগল্প ছড়ানো হয়েছিল? কাদের স্বার্থে বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্বঘোষিত সুশীল সমাজ এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল, তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করা দরকার। লেখক : শিক্ষাবিদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
×