ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিক্সন তালুকদার

অভিমত ॥ মধ্যনগরকে উপজেলায় উন্নীতকরণ জরুরী

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অভিমত ॥ মধ্যনগরকে উপজেলায় উন্নীতকরণ জরুরী

সুনামগঞ্জ জেলার সোমেশ্বরী নদীর তীরে সবচেয়ে উপেক্ষিত, অবহেলিত, অনুন্নত ও দুর্গম জনপদের নাম মধ্যনগর। ২২০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের থানাটিতে ইউনিয়ন সংখ্যা ৪টি, লোকসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৭২০ জন। এই থানার প্রশাসনিক উপজেলা ধর্মপাশা, যার সদর দফতর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে। উপজেলা সদর হতে উত্তর সীমানার দূরত্ব ৫০ এবং মধ্যনগরের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। এলাকাটি অত্যন্ত দুর্গম ও হাওড়বেষ্টিত বিধায় জরুরী মুহূর্তে বা যথাসময়ে সরকারের প্রশাসনিক সুবিধা বা সেবা গ্রহণ করা জনগণের পক্ষে সম্ভব হয় না। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই মধ্যনগর বর্তমান থানা কমপ্লেক্সে স্থাপিত হয় অহঃর উধপড়রঃ চড়ষরপব ঈধসঢ় (অউচঈ)। জনগণের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা লাঘব ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের নিমিত্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ৪টি ইউনিয়ন (মধ্যনগর, চামরদানী, বংশীকু-া দক্ষিণ, বংশীকু-া উত্তর) নিয়ে পুলিশ থানা গঠন করা হয়। ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নিকারের ৮৬তম বৈঠকে মধ্যনগর থানা এলাকার উপযুক্ত ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে মধ্যনগর উপজেলা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে ৮৮তম সভায় ঘোষিত মধ্যনগর উপজেলা বাতিল করে দেয়। উল্লেখ্য, মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়নের জন্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি, সৈয়দ রফিকুল হক এমপিসহ জনস্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকল প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সুপারিশ রয়েছে। মধ্যনগর বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সব সময় অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। কৃষিতে মধ্যনগরের ভূমিকাও ব্যাপক। বিভিন্ন জলমহাল, বিভিন্ন বাজার এবং মধ্যনগর থেকে প্রতিবছর রাজস্ব আয় হয় প্রায় ৩ কোটি টাকা। শুধু মধ্যনগর বাজারেই প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ মণ ধান-চাল কেনাবেচা হয়। বাঁশ, ডিম, কাঠ, পান-সুপারি প্রতিবছর বিক্রি হয় প্রায় ৪০ কোটি টাকার। বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন হতে বিভিন্ন শ্রেণীর পাথর, চুনাপাথর ও কয়লা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয় প্রতিবছর প্রায় ১২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তাহিরপুরের ৩টি শুল্ক স্টেশন মধ্যনগরের বিভিন্ন জলপথের ওপর নির্ভরশীল। এক কথায় মধ্যনগর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- হিসেবে সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকাল হতেই মধ্যনগরবাসী বিশ্বসম্মোহনী অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী। তাঁর নির্দেশেই ১৯৭১ সালে এলাকাবাসী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-১ আসন থেকে প্রতিবারই আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় সুনামগঞ্জ-১ আসন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। মধ্যনগরবাসী নিরন্তর মুুক্তিযুদ্ধের অনির্বাণ চেতনার ধারক ও বাহক। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসানের পিতা ডাঃ আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মধ্যনগর থানার মহেশখলা ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন। তাঁর প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ও তিনি তাতে স্বাক্ষর করেন। আমার লব্ধপ্রতিষ্ঠ দীর্ঘদিনের গবেষণা থেকে যতদূর জানি, সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাঁচবার এসেছিলেন। তাঁর স্নিগ্ধ পদধূলিতে ধন্য হয়েছে সুনামগঞ্জের মাটি। সর্বপ্রথম ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জে প্রথম এসে শিল্প-বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও গ্রাম অনুদান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু বর্তমান স্টেডিয়ামে বিশাল জনসমুদ্রে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘সুনামগঞ্জবাসীর কোন অভিযোগ বা দাবি থাকলে বা কোন সমস্যা হলে শুধু দু’পয়সার একটা পোস্টকার্ডে সবিস্তারে লিখে শেখ মুজিবের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমি তাৎক্ষণিকভাবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা একবার শাল্লা উপজেলায় বিশাল জনসভায় বলেছিলেন, ‘গোপালগঞ্জের উন্নয়ন হলে সুনামগঞ্জের উন্নয়নও হবে।’ আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব যাতে তিনি তাঁর বাবার এবং তাঁর প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেন। হাওড়বেষ্টিত মধ্যনগর একটি অনগ্রসর জনপদ। মধ্যনগর আমার জন্ম এলাকা, আমার শরীরে তারই সোঁদা মাটির গন্ধ। মধ্যনগরের জনগণের সুখে আমি সুখী, তাদের দুঃখে দুঃখী। প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত যুগান্তকারী পদক্ষেপ, ইতিবাচক ও কল্যাণমুখী সেবা পশ্চাৎপদ গণমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর মাধ্যমে তাদের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের নিমিত্তে মধ্যনগরকে অবিলম্বে উপজেলা বাস্তবায়ন করার জন্য, জনস্বার্থে বিদগ্ধ ও প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য, সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মহৎ কাজের সঙ্গে ঈশ্বরের পবিত্র স্পর্শ আছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও আছে বাংলাদেশের মানুষের সেবা করার এক মহৎ হৃদয়। যার বিশালতা আমাদের মধ্যনগরের টাঙ্গুয়ার হাওড়ের ঢেউয়ের মতোই উদার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী মধ্যনগরবাসীর কাছে বিশাল সূর্যের মতো। আমরা মধ্যনগরবাসী তাঁর দিকে সূর্যমুখী ফুলের মতো অধীর আগ্রহে চেয়ে আছি। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, তিনি মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন করে হাওড়ের জলবন্দী মানুষের অসীম সংগ্রামী জীবনের কষ্টের অবসান ঘটাবেন। লেখক : গবেষক ও শিক্ষাব্রতী
×