ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসির সিয়াম

প্রাণের ভাষা

প্রকাশিত: ২২:২০, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রাণের ভাষা

আমাদের বাড়িতে আজ এক উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রায় দশ বছর পর ছোট চাচা আমেরিকা থেকে সপরিবারে দেশে ফিরছেন। বাবা তাদের এয়ারপোর্টে আনতে গেছেন। শুনেছি আমার বয়স যখন সাড়ে তিন বছর, তখন চাচা স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে সেখানেই বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করলেও, আমি মূলত অপেক্ষা করছি ছোট চাচার ছেলে সিমনের জন্য। ওর বয়স আট বছর। যেহেতু ওর জন্ম, পড়ালেখা, চলাফেরা সবকিছুই বিদেশে, সেহেতু ইংরেজ ছেলেমেয়েদের মতোই হয়ে গেছে নিশ্চয়! ওর কথা শুনে আমার বন্ধুরাও ওকে দেখতে এসেছে। বেশ গর্ব করে আমি ওদেরকে বলছিলাম যে, সিমন বার্গার ছাড়া খেতেই পারে না, সবসময় ইংরেজীতে কথা বলে ইত্যাদি। আর সেসব কথা শুনতে মফস্বল এলাকার ছেলে হিসেবে সবাই বেশ আগ্রহ বোধ করছে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ করে বাড়ির উঠানে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে ট্যাক্সি থেকে চাচা-চাচি আর একটা সুন্দর মিষ্টি চেহারার ছেলে নেমে এলো। খুব সহজেই বুঝতে পারলাম, ওই আমার ভাই সিমন। যেহেতু প্রথমবার চাচি দেশে এসেছেন তাই বাবা আমাদের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। মা’র সঙ্গে পরিচয়ের সময় সবাইকে অবাক করে দিয়ে চাচি মাকে পরিষ্কার বাংলায় সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন ভাবি? আমরা সবাই বেশ অবাক হলাম। মা হাসি হাসি মুখে জবাব দিলেন, ও মা, তুমি তো দেখছি পুরোপুরি বাংলায় কথা বলতে পার!- আপনার দেবর শিখিয়েছে, ভাবি। ছোট চাচা কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, চাচিই নাকি তাকে বাংলা শেখানোর জন্য জোর করেছিলেন। শুনে আমি আরও বেশি রকমের অবাক হলাম। আমরা যেখানে ইংরেজীতে কথা বলা শেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকি, সেখানে একজন বিদেশী মানুষের কিনা বাংলা শেখার জন্য এত আগ্রহ! এবার চাচি হাসি মুখে বললেন, কি করব এত মিষ্টি ভাষা না শিখে পারা যায়? সিমনকে দেখিয়ে চাচা বললেন, এই হলো সিমন সাহেব। উত্তরে সবাইকে আবারও অবাক করে দিয়ে সিমন চটপট করে বলতে শুরু করল, বাবা, তোমাকে না বলেছি আমাকে সাহেব বলবে না। আমার বন্ধুরা ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, কিরে তুই না বলেছিলি ও ইংরেজীতে কথা বলে?- বললাম, আরে আমি সেটাই তো জানতাম। এরপর বাবা আমাকে দেখিয়ে বললেন, সিমন, এই হচ্ছে তোমার শাহরিয়ার ভাইয়া। আমি হ্যালো বলার পর ও এগিয়ে এসে আবারও সুন্দর করে বাংলায় বলল, ভাইয়া, এখন আমি তোমার কাছে চলে এসেছি। সবসময় তোমার সঙ্গে খেলব, ঘুরবো, ঘুমাব। আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে না? ওর কথা শুনে আমার খুব ভাললাগল। আমিই শুধু শুধু ভেবে বসেছিলাম, ওর সঙ্গে কিভাবে মিশব ভেবে! বললাম, অবশ্যই ভাইয়া। এখন থেকে তুমি সবসময় আমার সঙ্গেই থাকবে। কথা শেষ করে ওকে ঘরে নিয়ে গেলাম। রাতে ঘুমানোর সময় জানতে চাইলাম, আচ্ছা সিমন, তুমি বিদেশে ইংরেজদের সঙ্গে থেকে ছোট হয়েও এত সুন্দরভাবে কি করে বাংলা ভাষা শিখেছ?- কেন ভাইয়া, ওই দেশে আমাদের মত অনেক বাঙালী থাকে। আমার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে আছে যারা আমার থেকেও অনেক ভাল বাংলা বলতে পারে। তবে আমি ওদের বলে এসেছি এবার বাংলাদেশে এসে তোমাদের থেকে আরও ভালভাবে বাংলা শিখে যাব।- কিন্তু ইংরেজদের মত ইংরেজীতে কথা বলা নিশ্চয় অনেক গর্বের?- আমার কাছে বাংলা ভাষায় কথা বলতেই বেশি ভাললাগে। যে ভাষার জন্য মানুষ তাদের জীবন দিতে পারে সে ভাষায় কথা বলে আমি খুব গর্ব বোধ করি, ভাইয়া। একমাত্র বাংলা ভাষার জন্যই দেশের মানুষেরা জীবন দিয়েছেন। তাই তো একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান পেয়েছে। তোমরা প্রতিবছর ওই দিনে ভোরবেলায় খালিপায়ে সে সকল ভাষা শহীদদের সম্মান জানাতে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাও, তাই না ভাইয়া? -হ্যাঁ, তবে তুমি এতসব জান কিভাবে, ছোট চাচা বলেছেন?- বাবা কিছু বললেও, তবে ইন্টারনেট থেকেই ভালভাবে জেনেছি। আর আমার ইংরেজ বন্ধুদেরও এসব কথা বলেছি। ওরা আগে ভাবতেই পারেনি নিজের মায়ের ভাষাকে কেউ এত ভালবাসতে পারে। আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম আমার থেকেও ছোট একটা ছেলে যার জন্ম থেকে শুরু করে সবই বিদেশে সে দেশকে, দেশের ভাষাকে এতটা ভালবাসে! যে বাংলা ভাষার মর্যাদা আমার বহন করার কথা ছিল, সেটা এতটুকু একটা ছোট ছেলে সিমন করছে। অথচ কোন অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষায় কথা বলতেও আমার সঙ্কোচ লাগে। মনে মনে আমার মাঝে নতুন করে বাঙালীয়ানা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সিমনকে ধন্যবাদ দিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ায় খুব খুশি হলো সিমন। নিজের হাতে ফুলের তোড়া বানিয়ে শহীদদের শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছে সে।
×